Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বাঁচবে না সোনার বাংলাদেশ

ভারতীয় পানি আগ্রাসন থেকে নদী না বাঁচলে

ফয়সাল আমীন | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভেদে উপেক্ষিত দেশ রক্ষার ঐক্যমত//  অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মারপ্যাচ নিয়ে মুখোমুখি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। ধর্মীয় সংগঠনগুলো ছোট খাটো মতানৈক্যে একে অপরের প্রতিপক্ষ। নেতৃত্বশীল সব পর্যায়ের এমন অবস্থা এখন বাস্তবতা। টপ-টু-বটম পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাসের সুযোগে বহিঃদেশীয় আগ্রাসনে বিপন্ন হতে চলছে নদীমাতৃক দেশ তথা সিলেটের অস্তিত্ব। দেশ-মাটি না থাকলে, রাজনীতি, ক্ষমতা, ধর্ম সবকিছু যে অর্থহীন হয়ে যাবে, সেই মৌলিক বিষয়টি উপলব্ধিহীন হয়ে পড়ছে আমাদের কর্মকান্ডে। সামগ্রিক বিবেচ্য বিষয়টি বিবেচনাহীন হওয়ায় দূর ভবিষ্যত এখন চরম ঝুঁকিতে। উজানের পানি আগ্রাসনের কবলে এখন গোটা সিলেট। টিপাইমুখ বাঁধ আমাদের জীব বৈচিত্রকে যেমন ফেলেছে হুমকিতে, তেমনি প্রাকৃতিক পানি ভান্ডার নিয়ে যাচ্ছে তলানিতে। যেকারণে সর্বনাশের পথে বৃহত্তর সিলেটের জীব বৈচিত্র্যের ভবিষ্যত। এনিয়ে শঙ্কিত পরিবেশবাদী সংগঠনসহ এ অঞ্চলের কোটি মানুষ। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এ ব্যাপারে সোচ্চারে হলেও রাজনৈতিক সংগঠন ও নেতৃত্ব রহস্যজনকভাবে নীরব। অথচ সার্বজনীন একটি-ই শ্লোগান ‘সিলেটের নদী সিলেটের প্রাণ-সিলেট বাঁচাতে নদী বাঁচান’। এব্যাপারে সিলেট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট সংগঠক এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অত্যন্ত বিপদ সঙ্কুল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা বসবাস করছি। ভারতের প্রতিটি সরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করেই আমাদের নদ নদীর পানি প্রবাহে অবৈধ কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। বিপরীতে আমাদের রাজনৈতিক দল সমূহ ক্ষমতায় যেতে বা টিকে থাকতে ভারতীয় সরকারের সাথে প্রশ্নবিদ্ধ সর্ম্পক বজায় রেখে দেশের নদ-নদী রক্ষার ন্যার্য স্বার্থ চরমভাবে উপেক্ষিত করেছে।’ তিনি আরো বলেন, শাহবাগে গণজাগরন মঞ্চ হয়, শাপলা চত্বরের হেফাজতের মহাসমাবেশ হয়। কিন্তু দেশের প্রাণ শক্তি নদ-নদী রক্ষায় কেউ কথা বলে না। তিনি আফসোস সুরে বলেন, যেখানে জীবন থাকবে না সেখানে সব কিছুই মূল্যহীন, এও কি তারা বুঝেন না।
সংশ্লিষ্ট একাধিক তথ্য মতে, স্বাধীনতা উত্তরকালেও সিলেট বিভাগে প্রায় দেড় শতাধিক ছোট-বড় নদ-নদীর অস্তিত্ব ছিল। বিগত চার দশকে এর অর্ধেক নদীই সম্পূণ রূপে হারিয়ে গেছে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় নদীকে গাঙ বলা হয়। এইসব নামের মধ্যে নয়া গাঙ, বড় গাঙ বা ছড়া গাঙ নামের ছোট নদীর সংখ্যা অনেক। ভারতের খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা অসংখ্য ঝর্ণা সিলেট বিভাগের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ছড়া নামেই পরিচিত। বাংলাদেশের অনেক জেলার নদ-নদী থেকেও এইসব পাহাড়ি ছড়া অনেক খরস্রোতা। সিলেট বিভাগে একই নামের একাধিক কিছু নদী আছে। যে নদীগুলোর পরস্পরের সাথে কোন সংযোগ নেই কিন্তু নাম এক। সিলেট জেলার কোম্পানিগঞ্জের ধলাই নদী আর মৌলভীবাজারের ধলাই নদী পৃথক দুটি নদী। একইভাবে সিলেটের রতœা ও হবিগঞ্জের রতœা সম্পূর্ণ পৃথক দুটি নদী। সিলেটের সুনাই ও সুনামগঞ্জের সুনই উচ্চারণেও পৃথক নদী। সিলেট বিভাগের সবচেয়ে দীর্ঘ নদী সুরমা। এরপরেই কুশিয়ারা নদী। সুরমা-কুশিয়ারা ভারতের বরাক নদীর শাখা নদী। সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসিদ পয়েন্ট থেকে পৃথক হওয়া সুরমা-কুশিয়ারা সিলেট বিভাগের উপর দিয়ে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে সিলেট-ঢাকা-কুমিল্লা বিভাগের সংযোগস্থলে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। সিলেট বিভাগের প্রায় সমস্ত নদ-নদী সুরমা-কুশিয়ারাতেই মিলিত হয়েছে। যে কারনে সিলেট বিভাগের প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারা। এছাড়া জেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক নদ-নদীর অস্তিত্ব ছিল। বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। কানাইঘাটে লোভা ও নুন, জৈন্তা-গোয়াইনঘাটে সারি, গোয়াইন, ডাউকি, পিয়াইন, বড়গাঙ, রাংপানি, কাফনা। কোম্পানিগঞ্জে ধলাই ও কাটাগাঙ। বিয়ানীবাজারে সুনাই, লোলা নদী, কুড়া নদী, কাকেশ্বর। বিশ্বনাথে বাসিয়া, মাকুন্দা, খাজাঞ্চি। গোলাপগঞ্জে দেওড়ভাগা ও কাকেশ্বর নদী। দক্ষিন সুরমায় বড়ভাগা নদী। ফেঞ্চুগঞ্জে রত্না নদী। বালাগঞ্জে পেকুয়া নদী, কালিয়া নদী। অপরদিকে, প্রবাসী অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলার প্রধান নদী মনু। এ জেলায় প্রায় ২৫টি নদ-নদী ছিল। হাকালুকি হাওরের সাথে সংযুক্ত ছিল অনেক নদী। জেলার রাজনগর, কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউরা, বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা দিয়ে বর্তমানে প্রবাহিত নদ-নদীগুলো হল- গোপলা, কচুয়াখাড়া, উদনা, লাগাটা, বিলাস, করাঙ্গী, কন্টিনালা, ফানাই, গুগালী নদী, জুড়ী, লংলা, ধলাই (কমলগঞ্জ), শাখা বরাক, ডেবনা, পিংলি। সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার প্রায় ৩০টি নদীর অস্তিত্ব ছিল। বর্তমানে খোয়াই, বিবিয়ানা, বিজনা, রত্না (হবিগঞ্জ), শুটকী, করাঙ্গী, ঝিংড়ী, সোনাই, মাধবপুর, সুতাং, ধলেশ্বরী, মনিখাই, কলকলিয়া, শস্যনালী, জুঘনাল, বোয়ালিয়া, ভেড়ামোহনা। বিভাগের হাওর বাওর বেষ্টিত অপর জেলা সুনামগঞ্জ। সিলেট বিভাগের চার জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশী নদ-নদী রয়েছে। প্রায় অর্ধশত নদীর অস্তিত্ব রয়েছে সুনামগঞ্জে। টাঙগুয়ার হাওর ও সুরমা নদীতে মিশে যাওয়া এই নদীগুলোর মধ্যে যাদুকাটা, নলজুর, কালনী, চেলা, চলতি নদী, মহাসিং নদী, কংস নদী, সুমেশ্বরী, পাঠলী, সুনই নদী, বৌলাই নদী পরিচিত নদী। এছাড়াও কাউনাই, উন্দাখালি, চামটি, খাসিয়ামারা-বরাইয়া নদী, গোমাই নদী, মনাই নদী, চুনাই নদী, বাগরা গাঙ, নওয়া গাঙ, ধামালিয়া, বড়াদাল, ভট্টখাল, জামালপুর, বরাবা নদী, বোগাপানি, ধরিয়ানা, ধোয়াই, রূপসা, রক্তি, পৈন্দা, ধনু, দাড়াইন, গন্ডামারা, পাইকরতলাসহ আরও কিছু নদ-নদী রয়েছে সুনামগঞ্জে।
বৃহত্তর সিলেটের এ নদ-নদীগুলো এখন বিপন্ন। বহিঃদেশীয় ও আন্তঃদেশীয় অনাচারে সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীগুলো অস্তিত্ব রক্ষায় লড়ছে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ নদীর উজানে প্রতিবেশী ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ কমে যায়। নদীর তলদেশ ভরাট, ভরাট নদীর অংশ বেদখল হয়ে যাওয়ায় প্রতিবছর নদীর পরিধিও কমছে। সিলেট বিভাগের চার জেলায় প্রায় ২৪টি নদীকে এখন খাল বলেও চিহ্নিত করা কঠিন। এইভাবে ‘নদী নিখোঁজ’ আগামী দিনে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে
বাপার সিলেট জেলা সেক্রেটারী আব্দুল করিম কিম বলেন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতির দুরত্ব ভুলে স্থানীয় জাতীয় স্বার্থে রাজনীতিক নেতাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে সৃষ্ট জাতীয় জাগরেই সম্ভব পানি সমস্যার সমাধান।
মহানগর বিএনপির সহ সভাপতি সালেহ আহমদ খসরু, টিপাই ইস্যতে প্রতিবাদী হ্ওয়ায় আমরা মনে করি আমাদের প্রাণ প্রিয় নেতা ইলিয়াস আলী আজ নিখোঁজ। তারর্পও দেশ রক্ষার স্বার্থে, আমরা কোন রক্ষচক্ষু ভয় করবো।
মহানগর আ’লীগ সেক্রেটারী আসাদ উদ্দিন বলেন, প্রাকৃতিক উৎস রক্ষায় প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধতা, সেকারনে প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব। বিশেষ করে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা পানি আগ্রাসনের ভয়াবহতার বিষয়টি সরকারের নজরে দিতে পারলে, কূটনীতিক সমাধানে, ন্যায্য অধিকার রক্ষায় আমরা সফল হবো।
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল রকিব বলেন, ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি ও সরকার উপলব্ধি অনুযায়ী আগামী নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে চরম বিপর্যয়ে আসবে। পানি আগ্রাসন তার একটি নমূনা।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. জহির বিন আলম, টিপাইবাঁধ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ, সেইধারা টিকিয়ে রাখতে শক্তিশালী কূটনীতিক পদক্ষেপ জরুরী। আমরা ন্যায্য পানি চাই, আমাদের নদ-নদীতে। বাচাতে হবে আমাদের জীব বৈচিত্র। মরা নদীগুলো পানি ভর্তি করতে হবে। অন্যথায় বিফলে সামগ্রিক ব্যবস্থা।



 

Show all comments
  • গনতন্ত্র ১৪ মার্চ, ২০১৮, ৩:০৯ এএম says : 0
    জনগনের ধারনা “দাদু বলেছেন, পানি দিলে বন্যা হবে, না খেয়ে মরবে ভাতে;আমি তোমার সাথে আছি, বোবার মত বসে থাকো গদিতে ৷ “
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ