পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
০ বিলুপ্ত নৌপথ, কৃষি সংস্কৃতিতে বেহাল দশা ০ জীববৈচিত্র্যে পড়ছে বিরূপ প্রভাব
০ মৎস্য সম্পদও ধ্বংসের প্রান্তসীমায় ০ কর্মহীন লাখো পরিবার
ভারতের ভয়াল পানি আগ্রাসনে মরে যেতে বসেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রায় অর্ধশতাধিক নদ-নদী। সময়ের চোরা স্রোতে পাল তোলে ইতোমধ্যে প্রায় ডজনখানেক নদ-নদী মৃত হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। মরে যেতে বসা এসব নদীতে এখন শুধুই ধু ধু বালুচর। ফলে কৃষি সংস্কৃতিতেও নেমে এসেছে বেহাল দশা।
নদ-নদীকেন্দ্রিক জীবিকা হারিয়ে পথে বসেছেন প্রায় লাখো পরিবার। জীববৈচিত্র্যেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। মৎস্য সম্পদও ধ্বংসের প্রান্তসীমায়। অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এক সময়ের যোগাযোগের চালিকাশক্তি নৌপথ। বিলুপ্ত হয়ে গেছে জেলে পল্লীগুলোও। মূলত ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণেই ভয়াবহ নাব্য সঙ্কটে এসব নদ-নদীর এখন মরণদশা।
জানা যায়, নদ-নদীর ব্রহ্মপুত্র নদীর সাথে এ অঞ্চলের মানুষের গভীর মিতালী। বাঙালি জাতির ইতিহাস যেমনি গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে তেমনি এ অঞ্চলের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র মরা গাঙে রূপ নেয়ায় এ অঞ্চলের কৃষি সংস্কৃতিতে নেমে এসেছে বেহাল দশা।
দিন দিন বিশাল বিস্তৃত মরুপ্রান্তর হয়ে উঠছে এক একটি নদ-নদী। অথচ এক সময় এসব নদ-নদীই ছিল মাছের অভয়ারণ্য। পণ্য পরিবহন ও মানুষের যোগাযোগের সুবিধার কারণে নদপারে গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় হাট-বাজার, বন্দর, নগর ও গঞ্জ। এসব এখন শুধুই স্মৃতিময় দীর্ঘশ্বাস।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, যৌবনের জলতরঙ্গে এক সময় উচ্ছ¡ল ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের এসব নদ-নদী। সেই কারণে নদীর সাথে এ অঞ্চলের মানুষের গভীর মিতালী-এ আপ্তবাক্যও ছিল চিরন্তন সত্য। কিন্তু সময়ের গতিধারায় নদীমাতৃক পরিচয়টাও যেন এখন বিলীন হবার পথে।
এসব নদী প্রায় মরেই যাওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রাও বদলে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন করে পরিবেশ বিপর্যয়। এ অঞ্চলের প্রধান নদী স্রোতস্বিনী ব্রহ্মপুত্রেও ভারতের পানি আগ্রাস নীতির মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক আইন-কানুন বা নীতির তোয়াক্কা না করা প্রতিবেশী এ দেশটি’র এমন আগ্রাসনের কবলে পড়ে রীতিমতো হত্যা করা হচ্ছে এসব নদ-নদীকে।
দেখা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে পানির বদলে এসব নদীর বুকে চর পড়ে শুধুই বালু আর বালু। কোথাও কোথাও ছোট-বড় নদীগুলোর বুকে চলে চাষাবাদ। নদীর তলদেশ শুকিয়ে হয়ে উঠে মরুভূমি। এসব নদীগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে শুধুই শোনা যায় দীর্ঘশ্বাস আর কান্না।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র মতে, বৃহত্তর ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্রসহ প্রায় অর্ধ শতাধিক নদ-নদী রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ঝিনাই, আইমন, সুতিয়া, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ঘরোটা নদী, সিমাহালি, নরসুন্দর, বোথাই, নিতারী, সোমেশ্বরী, কংশ, গুনাই, কাঁচামাটিয়া, পানকুরা, সাইদুল, মুগরা, রাংরা, খারমরি, মাহাডেবা, জাদুকাটা, ধানু, বাউলাই, শিরখালি, চেলাখালি, মতিচিক, চালহি, বংশাই, মানস, পুটিয়া, জিনজিরাম, সুবনফিরি, বলেশ্বর, বগাই কংশ, কাউলাই, ধনু, সিলাই, রাজবাড়ী ও খারমেনি।
এর মধ্যে নরসুন্দা ও রাজবাড়ী’কে মৃত নদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাংলা পিডিয়া বইতেও এসব নদীর কথা বলা হয়েছে। মৃত নদ-নদীর এ তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে।
সূত্র মতে, ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তিস্থল হিমালয় পর্বতমালায়। বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি সংলগ্ন এলাকা দিয়ে এর প্রবেশ। এক সময়ের স্রোতস্বিনী ব্রহ্মপুত্র নদ থেকেই বর্তমানের যমুনা নদীর উৎপত্তি হলেও বর্তমানে নদটি স্রোতবিহীন আর নাব্যতা সংকটে ভুগছে। উৎসমুখে জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা থেকে শুরু করে নদের পতিতমুখে কিশোরগঞ্জের ভৈরব পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় আড়াইশ’ কিলোমটিার দৈর্ঘ্যের নদটি বর্তমানে তেজহীন শীর্ণকায়া।
চীনের পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ’র ভাষ্য মতে, ‘ত্রয়োদশ শতাব্দিতে ব্রহ্মপুত্র গঙ্গার ৩ গুণ ছিল। শেরপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র ছিল ১০ মাইল প্রশস্ত। সেই সময় এ ১০ মাইল পাড়ি দেয়ার জন্য ‘দশকাহন কড়ি’ নির্দিষ্ট ছিল। সে কারণে শেরপুরের নাম হয় ‘দশকাহনিয়া শেরপুর।’
তবে কারো কারো মতে, ব্রহ্মপুত্র নদের বিস্তৃৃতি ও অববাহিকা তিব্বত, চীন, ভারত ও বাংলাদেশে বিদ্যমান। এর উৎপত্তি মানস সরোবর লেক ও কৈলাশ পর্বতের মাঝস্থান থেকে। উৎপত্তিস্থল থেকে ব্রহ্মপুত্রের দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৮৫০ কিলোমিটার।
নদটি ভবানীপুর এলাকায় কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর বাহাদুরাবাদ ঘাটের প্রায় ১২ কিলোমিটার উজানে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার হরিচÐি হয়ে জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিকে এসে কিশোরগঞ্জের ভৈরব বাজারের কাছে মেঘনা নদীতে মিশেছে। এটিই এখন পুরনো ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত।
ব্রহ্মপুত্র একসময় বিশাল স্রোতধারা নিয়ে ছিল দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদ। এক সময়কার চঞ্চলা যমুনা নদীও ছিল ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী। মূলত ১৭৮৭ সালের আগে যমুনা নামে কোনো নদী ছিল না। ছিল শীর্ণকায় খাল। যার নাম জানুয়া বা জিনুয়া। ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্রের স্রোতধারা দেওয়ানগঞ্জের কাছে এসে ওই শীর্ণকায় খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়। সেটিই আজকের যমুনা নদী। এদিকে জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ জেলা হয়ে মেঘনায় পতিত হওয়া মূল স্রোতটিই পুরাতন ব্রহ্মপুত্র।
মেজর জেমস রেনেল ১৭৬৩ থেকে ১৭৭৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে অবিভক্ত বঙ্গদেশের একটি ভৌগোলিক মানচিত্র তৈরি করেন। ১৭৮১ সালে প্রকাশিত নদী মানচিত্রের সঙ্গে বর্তমান মানচিত্রের যথেষ্টই পার্থক্য রয়েছে। সবচেয়ে বেশি পার্থক্য দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার ক্ষেত্রে। রেনেলের ম্যাপ বলছে, মেঘনা ব্রহ্মপুত্রের উপনদী। এমনকি যমুনাও। ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ তখন ময়মনসিংহের উপর দিয়ে চাঁদপুরের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হতো। ১৭৮৪ তে ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র তার গতিপথ পরিবর্তন করে। পুরোনো খাত পরিবর্তন করে পরিবর্তিত ব্রহ্মপুত্র যমুনার সঙ্গে যোগ দেয়।
বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র নদের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এ নদের আদি গতিপথ। পানি বিপর্যয়ের কারণে বিপন্নদশার এ নদী অববাহিকায় পরিবেশের উপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। আবহমান কালের কৃষি সেচ ব্যবস্থায় এখন ব্রহ্মপুত্র সহায়কই নয়।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুরের কাছে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়ায় ময়মনসিংহে পানি প্রবাহের মাত্রা কমছে। পানির সঙ্কটে বিপন্ন ব্রহ্মপুত্র নদ বর্ষাকাল ছাড়া বাকী মৌসুমে থাকে পানি শূন্য মরুময়। বছরের পর বছর গড়ালেও ব্রহ্মপুত্র নদ বা অন্যান্য নদীর ভাগ্যাকাশে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ গাঢ় হচ্ছে।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার ২৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে গত ৩৬ বছরে ৭২০ বর্গকিলোমিটারের বেশি নতুন নতুন চর পড়েছে এবং একই সময়ে এর তলদেশ ভরাট হয়েছে প্রায় ২২ ফুট।
জানা গেছে, আদি অবস্থায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের গড়ে প্রশস্থতা ছিল প্রায় ১১ কিলোমিটার। বর্তমানে এর প্রশস্থতা এখন ১২০ মিটার থেকে ২২০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। খনন না করায় নদের বুকে পলি ও বালু জমে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে।
এর মধ্যে গত ৩৩ বছরে নতুন চর জেগেছে ৭২০ বর্গকিলোমিটার।
একই সঙ্গে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্য হ্রাস পাওয়ায় তলদেশ ভরাট হয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬ মিটার অর্থাৎ ২২ ফুট। ফলে নদে শুষ্ক মৌসুমে নদের দুইপাড়ের ফসলি জমিতে প্রতিবছর ভয়াবহ সেচ সংকট দেখা দেয়।
সূত্র মতে, কয়েক বছর আগেও বৃহত্তর ময়মনসিংহে নদ-নদী তীরবর্তী হাজার হাজার একর জমির আবাদ হতো এসব নদ-নদীর পানি দিয়ে। জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধায়ও হাজার হাজার একর জমির আবাদ ছিল ব্রহ্মপুত্রের পানিনির্ভর। উর্বর পলি মাটিতে বাম্পার ফলন হতো। সে অবস্থা আজ আর নেই। যন্ত্রের দাপটে হারিয়েছে উর্বরতা। শীতকালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র এখন হেঁটেই পার হওয়া যায়। এর কারণ উজানে ভারতের আগ্রাসী নীতি। মূলত এ কারণেই যমুনার উৎস মুখ ভরাট হয়ে গেছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের এসব নদ-নদীগুলোতে।
এসব বিষয়ে ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্বে) মো: ইউনুস আলী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদ খননে জামালপুর থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত প্রকল্পের স্টাডি চলছে। কতটুকু খনন করা যাবে, খননের পর কী হবে এসব বিষয় নিয়ে কনসালটেন্ট টিম কাজ করছে।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের অর্ধ শতাধিক নদ-নদীর মরণদশা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশের পানি নীতির সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদের কোন সম্পর্ক নেই। জামালপুরে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখের ৬ কিলোমিটার পুরোপুরি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ওই ৬ কিলোমিটার সবার আগে খনন করা হবে। আর এটি হলেই ব্রহ্মপুত্র নদ পুরোমাত্রায় সচল হয়ে যাবে। নদটি ফিরে পাবে তার হারানো যৌবন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।