Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাঘের খাঁচায় বন্দি দানিয়াল নবী ও বহুরূপী বখতে নছরের কাহিনী

| প্রকাশের সময় : ১০ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

কে. এস সিদ্দিকী: (পূর্বে প্রকাশিতের পর)/ বখতে নছর চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘থামো থামো, আমিই বখতে নছর।’ দারোয়ান বলল, ‘তুমি মিথ্যাবাদী। বখতে নছরই আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তোমাকে হত্যা করতে।’ অতঃপর দারোয়ান কুড়ালের আঘাতে তাকে হত্যা করে। ভাগ্যের পরিহাস বখতে নছর নবী হযরত দানিয়াল (আ) কে হত্যা করার জন্য নিজের যে দারোয়ানকে নিয়োজিত করেছিল সে দারোয়ানের হাতেই সে নিহত হয়। বখতে নছর তার রাজত্বকালে নিষ্ঠুর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে অসংখ্য লোকের প্রাণ হরণ করে। ইতিহাস তার সাক্ষ্য বহন করে। বহুরূপী এ জালেম বাদশাহ্ বাবেলে (বেবিলিয়ন) যে অকথ্য নির্যাতন চালায় ইতিহাসে তার বিস্তারিত লিপিবদ্ধ রয়েছে। এখানে আমরা হযরত দানিয়াল (আ) সম্পর্কে যে কাহিনী প্রচলিত তার কিছু অংশ তুলে ধরছি।
প্রাচীন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে বেবিলিয়নের বন্দি অধ্যায়। এই বন্দিদের মধ্যে রাজকীয় বংশের কতিপয় লোকও ছিলেন। যেমন: দানিয়াল নবী ও তার তিন বন্ধু। তারা সবাই দেখতে ছিলেন অতি সুদর্শন ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী এবং অতি মেধাবী ও বুদ্ধিমান। এটি ছিল জালেম বাদশা বখতে নছরের যুগ। রাজবংশের ঐ লোকেদের প্রতি তার বিশেষ নজর ছিল। সে নির্দেশ করে যে তাদেরকে রাজকীয় বিশেষ ভান্ডার হতে খাবার সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু খোদা ভক্ত এই পরহেজগার লোকেদের পক্ষে এই খাবার গ্রহণ করা বিপদের কারণ হয়ে দেখা দেয়। মুছাবি শরীয়ত অনুযায়ী, কয়েক প্রকারের গোস্ত খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। তাই তাদের আশংকা ছিল যে, এই বিশেষ রাজকীয় খাবারে নিষিদ্ধ গোস্ত থাকতে পারে। তারা শাহী খাবারগৃহে গমন করেন এবং দায়িত্বপ্রপ্ত কর্মকর্তাকে জানান যে, ‘আপনার অতি অনুগ্রহ হবে যদি আমাদেরকে ১০ (দশ) দিন খাবারের সঙ্গে শুধু ডাল, রুটি ও পানি সরবরাহ করা হয়। এই দিনের পর থেকে আমরা যদি অধিক প্রস্তুত না হই এবং আমাদের চেহারা-অবয়ব আরও চমৎকার না হয় তাহলে আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী আমাদেরকে খাওয়াতে পারেন।’ তাদের অনুরোধ কর্মকর্তা রক্ষা করেন এবং তাদেরকে ১০ দিন খাবারের জন্য শুধু ডাল, রুটি ও পানি ব্যতিত আর কিছুই প্রদান করেননি। বাস্তবে তাদের দাবি সঠিক প্রমাণিত হয়। তাদের চেহারা, সুরত ও স্বাস্থ্য শাহী খাবার গ্রহণকারীদের থেকেও উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় হয়ে যায়। ফলে তখন থেকে তাদেরকে অনুমতি দেওয়া হয় যে, সবসময়ের খাদ্য হবে তাদের জন্য ডাল, রুটি।
যেহেতু দানিয়াল ও তার সঙ্গীরা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান জ্ঞানী, তাদের অসাধারণ গুণে মুগ্ধ হয়ে বখতে নছর তার দরবারে উপস্থিত থাকার জন্য নির্বাচিত করে। এসময় বখতে নছর একটি সোনালী প্রতিমা নির্মাণ করে শহরে স্থাপন করে এবং তার দরবারের আমীর ওমারা ও গণ্যমান্য সকলকে তার পূজা করার নির্দেশ দেয়। প্রত্যেকে রাজকীয় নির্দেশ পালন করতে থাকে। কিন্তু দানিয়ালের তিন বন্ধু এই প্রতিমার পূজা করতে অস্বীকৃতি জানান। দানিয়াল সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত থাকলে তিনিও অনুরূপ অস্বীকৃতি জানাতেন। বাবেলের অধিবাসীরা বখতে নছরকে এই খবর জানিয়ে দেয়। বখতে নছর যখন দেখলো এই লোকগুলো তার নির্দেশের তোয়াক্কা করে না তখন রাগে-ক্ষোভে অগ্নীশর্মা হয়ে এক বিশাল গরম পানির পাত্র নির্মাণ করেন যাতে স্বাভাবিকের তুলনায় সাত গুণ তীব্র জ¦লন্ত আগুন সৃষ্টি করা হয়। বখতে নছর নির্দেশ দেয় যে ঐ তিন ব্যক্তিকে এই অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হোক। সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ পালন করা হয়। কথিত আছে যে, যারা এই লোকদেরকে অগ্নিকূপে নিক্ষেপ করেছিল তারা দূর থেকে আগুনের তাপে ধ্বংস হয়ে যায়। অথচ ঐ তিন ব্যক্তির শরীরে আগুনের সামান্যতম স্পর্শও লাগেনি। খোদার এক ফেরেশতা সেখানে অবতীর্ণ হন এবং তার সঙ্গে নিয়ে আসেন মনোরম শিশির মিসৃত বাতাস। এ ফেরেশতা অগ্নিকূপকে গুলজার বানিয়ে দেন।
বখতে নছর এই বিস্ময়কর ঘটনা শুনে ঘটনাস্থলে গমন করে এবং জিজ্ঞাসা করে যে, ‘তিন জনকেই অগ্নিকূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল কি?’ এ সময় সে দূর থেকে দেখতে পায় যে, চার ব্যক্তি একেবারেই নিরাপদে বের হয়ে আসছে। চার জনের তিন জন দানিয়ালের বন্ধু এবং চতুর্থজন খোদার ফেরেশতা। বখতে নছর এই অলৌকিক ঘটনা দেখে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং ঐ তিন ব্যক্তিকে তার রাজদরবারে উচ্চ আসন দান করে।
হযরত দানিয়াল (আ) সম্পর্কে প্রচলিত নানা কাহিনীর মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, তিনি যে বাদশার রাজত্বে জন্মগ্রহণ করেন সেই বাদশার দরবারে একদিন জ্যোতিষি ও পন্ডিত ব্যক্তিদের একটি দল উপস্থিত হয়। তারা ভবিষ্যত বাণী করে যে, ‘অমুক রাতে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করবে এবং সে আপনার সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেবে।’ একথা শ্রবণ করা মাত্রই বাদশা অবিলম্বে নির্দেশ দান করে যে, ঐ রাত যে শিশু জন্মগ্রহণ করবে তাকে হত্যা করা হবে। হযরত দানিয়াল (আ) যে রাতে জন্মগ্রহণ করেন সে রাতে তার মা তাকে একটি বাঘের ঝোঁপে (জঙ্গলে) ফেলে আসেন। এসময় সেখানে এক বাঘ ও এক বাঘিনী উপস্থিত হয় এবং দানিয়ালকে জিহŸা দ্বারা চাটতে থাকে। এভাবে আল্লাহ তা’আলা তাকে রক্ষা করেন। হযরত দানিয়াল (আ) বাঘের খাঁচায় আবদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি ভিন্ন রকমে বর্ণিত হয়েছে এবং বলা হয়ে থাকে, ঘটনাটি বাদশা বখতে নছরের যুগের। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, হযরত দানিয়াল (আ) এর প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে তাকে তাকে একটি কূপে নিক্ষেপ করে এবং তার পূর্বেই দুইটি সিংহকে ভীষণভাবে ক্রোধান্বিত করে কূপে ছেড়ে দেয়। আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি কূপে দীর্ঘদিন পড়ে থাকেন। কিন্তু সিংহদ্বয় তাকে কোন ক্ষতি সাধন করেনি এবং আল্লাহর ফেরেশতা তাকে সেখানে খাদ্য সরবরাহ করে। কথিত আছে, কূপে নিক্ষেপ করার পর জঙ্গলের হিংস্র জন্তুরা তার নিকট এসে লেজ নাড়তে থাকে এবং তার শরীর চাটতে থাকে।
হযরত দানিয়াল (আ)-কে কেন বাঘের বা সিংহের মুখে নিক্ষেপ করা হয়েছিল নবী কাহিনী লেখকগণ তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এ বর্ণনা অনুযায়ী বখতে নছরের মৃত্যুর পর তার পুত্র বাবেলের সিংহাসন লাভ করে এবং তারই সময়ে বখতে নছরের সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ইরানীদের বিশাল বাহিনী ফোরাত নদী অতিক্রম করে বাবেল অধিকার করে এবং বাবেলের বাদশা নিহত হয়। অতঃপর ইরানের ‘দারা’ নামক বাদশা বাবেলের সিংহাসন লাভ করে। তার নাম ‘সাইরাস’। দানিয়াল এর প্রতি সে ছিল বিশেষ সদয় এবং তাকে খুবই সম্মান করত। বাবেলবাসীরা মূর্তিপূজারী ছিল। হযরত দানিয়াল (আ) ছিলেন মূর্তিপূজাবিরোধী। সাইরাসও ছিল মূর্তিপূজারী। সাইরাস হযরত দানিয়াল (আ)কে মূর্তিপূজারী বানাতে বিভিন্ন প্রকারের পন্থা অবলম্বন করে এবং তাতে সে ব্যর্থ হয়। বিশেষত সোনার নির্মিত মূর্তিপূজা করার জন্য সাইরাস যখন দানিয়ালকে সম্মত করতে পারল না তখন বাবেলবাসীদের সবচেয়ে প্রিয়মূর্তি সোনার তৈরি অজগর সাপ পূজার জন্য দানিয়ালকে উৎসাহিত করে। এক পর্যায়ে স্বয়ং তিনি তা ভেঙ্গে চুরমার করে দেন। এই কৃত্রিম মূর্তি ধ্বংস করায় বাবেলবাসীরা দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে এবং তারা সমবেতভাবে শাহী প্রাসাদে সমবেত হয় এবং দানিয়াল নবীকে তাদের নিকট সমর্পণ করতে দাবি জানায়। প্রথমে বাদশা তাদের এই দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোকদের ক্রোধ ও বিক্ষভের মুখে তাকে নতি স্বীকার করতে হয়। অবশেষে দানিয়াল নবীকে বিক্ষুব্ধ জনগণের কাছে সমর্পণ করা হয়। তারা কয়েকদিন যাবৎ ভুখা (ক্ষুধা অবস্থায়) রাখা সিংহকে খাঁচায় বদ্ধ করে রাখে এবং সেখানে দানিয়ালকে নিক্ষেপ করা হয়। বর্ণনা অনুযায়ী ছয় দিন পর্যন্ত দানিয়াল নবী খাঁচায় আবদ্ধ থাকেন। কিন্তু সিংহদ্বয় তার কোন ক্ষতি করেনি। তিনি খাঁচায় ফেরেশতা পরিবেশিত খাদ্য গ্রহণ করেন। সপ্তম দিবসে তাকে মুক্ত করা হয়। এ সময় তিনি যে দোয়া করেন বিভিন্ন সূত্রে তার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় এবং তার একটি নিবন্ধের শুরুতে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
(সমাপ্ত)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্দি


আরও
আরও পড়ুন