Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতের পানি আগ্রাসন প্রাণহীন তিস্তা অকার্যকর হতে চলেছে সেচ প্রকল্প

| প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মাহফুজুল হক আনার, দিনাজপুর থেকে : ভারত বাঁধের ফাঁদে ফেলে নদী মাতৃক বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকায় শিকল পড়িয়ে রেখেছে। ইচ্ছা ও প্রয়োজন হলেই ভারত সেই শিকল খুলে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে চলেছে। বর্ষায় পানি দিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে আর খরায় পানি প্রত্যাহার করে নাব্য সৃষ্টি করছে। আর্ন্তজাতিক রীতি নীতির তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশের উৎস মুখে একাধিক বাঁধ ও ড্যাম নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ সেচ সুবিধার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে চলেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিকে ক্রমশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। ভারতীয় এই আগ্রাসী নীতির মুখে কৃষি নির্ভর উত্তরাঞ্চল খরার সময় মরুভুমি আর বর্ষার সময় পানির নীচে ডুবে থাকছে। উত্তরের প্রাণ রেখা হিসাবে পরিচিত তিস্তার উৎসমুখে গোজলডোবা বাঁধ এখন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য মরণ ফাঁদ হয়ে দাড়িয়েছে। কৃষি নির্ভর উত্তরের জেলাগুলোকে ধীরে ধীরে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। জেলেদের ভিখারীতে পরিণত করছে। বর্তমানে নদীর প্রবাহ ঠিক রেখে সেচ কাজের জন্য প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। অথচ পাওয়া যাচ্ছে বড় জোর ৭০০ কিউসেক পানি। বাংলাদেশের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজ থেকে ৯৭ কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে এক কিউসেক পানিও থাকছে না। এ কারণে তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের এই বিশাল পরিমাণ নদীগর্ভ পানি স্বল্পতার কারণে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হচ্ছে। ভাটিতে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ ভারতীয় পানি আগ্রাসনের মুখে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমি থাকলেও ২০১৪ থেকে ২০১৭ মাত্র চার বছরে কমে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে নেমে এসেছে। সেচ প্রকল্পের সুবিধা না থাকায় প্রকল্পের হাজার হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। জীবিকার প্রয়োজনে যারা ইঞ্জিন চালিত পাম্প দিয়ে সেচ দিয়ে আবাদ করছে-অতিরিক্ত খরচের কারনে তারাও আবাদ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। একইভাবে বর্ষার সময় নিজেদের বাঁচাতে উজানে দেয়া গজলডোবা বাঁধের গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকাকে প্লাবিত করে।
জানা গেছে, ত্রি-সেরাতা বা তিন প্রবাহ থেকে তিস্তা। সিকিম হিমালয়ের ৭২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে সৃষ্ট নদীটি দার্জিলিং পাহাড়ের বনের ভিতর দিয়ে সমতল ভূমিতে নেমে এসে পশ্চিমবঙ্গেও দুয়ার সমভুমি হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দের অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কৃড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণি ব্র²পুত্র নদে পতিত হয়। উল্লেখিত জেলাগুলোর লাখ লাখ কৃষকের সেচ সুবিধার পাশাপাশি মৎস্য আহরণের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল এই নদীটি। তিস্তা নদীর উপর উইকিপিডিয়ায় দেয়া তথ্য মতে, ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ ও ৩৯ শতাংশ ভারত এবং ২৫ শতাংশ পানি নদীতে সংরক্ষিত রাখা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় তিস্তা নদীকে ঘিরে ১৯৯০ সালে নীলফামারী’র ডিমলায় গড়ে তোলা হয় তিস্তা ব্যারেজ। ব্যারেজের উজানে একাধিক ক্যানেলের মাধ্যমে লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ক্যানেলের পানিতে মাছ চাষ শুরু হয়। এরই মাঝে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত যৌথ বৈঠকে তিস্তার ৮০ শতাংশ পানি সমানভাবে উভয় দেশ ভাগ করে বাকি ২০ শতাংশ পানি নদীতে প্রবাহমান রাখার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। ভারত এই প্রস্তাবে অসম্পতি জানায় এবং বাংলাদেশ সমান অংশীদার হতে পারে না বলে মত প্রকাশ করে। প্রকাশিত তথ্য মতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিস্তার উল্লেখযোগ্য পানি বাংলাদেশে আসতে দেয়া হলেও ২০১৪ সালে গোজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে শুস্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয় এ সময়ে তিস্তায় ডালিয় ব্যারাজে উজান থেকে আসা পানি প্রবাহ শুন্য। পানি বন্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুয়েমিতা, অনৈতিক ঢিলেমি ও হটকারীতার অভিযোগ আনা হয়। পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ায় নদীর তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালি আর পলি পড়ে তিস্তার বুকে শুস্ক মৌসুমে উত্তপ্ত বালুর স্তুপ সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে বর্ষাকালে প্রচন্ড পানির চাপ নদীর দুই তীরে আছড়ে পড়ে। এ কারনে প্রতিবছর অন্তত ২০ হাজার মানুষ বাড়ীঘর, গাছপালা ও আবাদি জমি হারিয়ে পথের ভিখারী হয়ে যায়। অপরদিকে ভারত গোজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে শুস্ক মৌসুমে পানি প্রবাহের গতিরোধ করে কৃত্রিম ক্যানেলের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ সুবিধা প্রদান করে চলেছে। ভারত তিস্তার উজানে টিনটেক, সেরওয়ালী, রাইয়াং ড্যামের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বিপ্লব ঘটাচ্ছে কৃষিতে আর বাংলাদেশের কৃষি খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। নিঃস্ব হচ্ছে কৃষক ও জেলে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাত দিয়ে আমাদের লালমনিরহাট জেলা সংবাদদাতা আইয়ুব আলী বসুনিয়া জানান, ২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ৬৫ হাজার হেক্টরে সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে সেবার সেচ দেওয়া হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। পানির অভাবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সেচ দেওয়া হয় মাত্র ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার মাত্র ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও পানির প্রবাহ কমে গেলে শেষ পর্যন্ত ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন চার হাজার কিউসেক পানি। সেখানে শুস্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যাচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ কিউসেক।
সূত্রটির মতে তিস্তা নদী অববাহিকার ৫ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। তিস্তায় পানির প্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় সেখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ