পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংবাদপত্রগুলোও বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। ভাষা আন্দোলনে সংবাদপত্রগুলো কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল এর প্রকৃত প্রমাণ পাওয়া যায় ২১ ফেব্রæয়ারির ঘটনাসংবলিত ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারিতে প্রকাশিত তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক-এর শহীদ সংখ্যার প্রচার মাত্রা দেখে। ১৯৪৮-১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন চলাকালে প্রকাশিত হতো আবুল কালাম শামসুদ্দিন সম্পাদিত দৈনিক আজাদ, আবদুস সালাম সম্পাদিত পাকিস্তান অবজারভার, আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিক দৈনিক ইত্তেহাদ, সাপ্তাহিক সৈনিক, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। এ ছাড়াও বাংলা ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে যে সব পত্রিকার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল সেগুলো হলো, ঢাকা থেকে খন্দকার আবদুল কাদেরের সম্পাদনায় ‘নতুন দিন’, ফেনী থেকে খাজা আহমদের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘সংগ্রাম’ এবং চট্টগ্রাম থেকে প্রগতিশীল গোষ্ঠীর ‘সীমান্ত’, মাহমুদ আলীর সম্পাদনায় সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘নওবেলাল’। এসব সংবাদপত্র খবর, প্রতিবেদন, সংবাদ-নিবন্ধ, উপসম্পাদকীয় এবং কবিতা, গান, কার্টুন ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে ব্যাপক জনমত সংগঠিত করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য থেকে পদত্যাগ করে এক অনন্য দৃষ্টাস্ত স্থাপন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করায় অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালাম সরকারি নির্যাতন ভোগ করেন এবং তাকে কারাগারে আটক করা হয়।
সাপ্তাহিক সৈনিক প্রথম প্রকাশিত হয় ১৪ নভেম্বর, ১৯৪৮ (২৮ কার্তিক, ১৩৫৫)। সৈনিক শুরু থেকেই বাংলা ভাষা প্রশ্নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। সৈনিক বাংলা ভাষা বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারিতে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে এবং কয়েকজন শহীদ হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার পর ২৩ ফেব্রæয়ারি প্রকাশিত হয় সপ্তাহিক সৈনিক-এর শহীদ সংখ্যা। লাল কালিতে ও লাল বর্ডার দিয়ে প্রকাশিত এই সংখ্যায় খবরের উল্লেখযোগ্য শিরোনামগুলো ছিল, ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ। গত বৃহস্পতিবার ৭ জন নিহত, ৩ শতাধিক আহত, ৬২ জন গ্রেফতার, শুক্রবারেও ব্যাপক সংখ্যক লোক হতাহত, রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা করার শপথ বিঘোষিত’। সাপ্তাহিক সৈনিক-এর এই সংখ্যার জনপ্রিয়তা এতই ছিল যে, মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে হাজার হাজার কপি পত্রিকা বিক্রি হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ একইদিনে তিনটি সংস্করণ বের করতে বাধ্য হন।
ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে ১৯৪৭ সালের ২২ জুন কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ এই শিরোনামে লেখক-সাংবাদিক আবদুল হকের একটি প্রবন্ধের প্রথম অংশ ছাপা প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় অংশটি ছাপা হয় ২৯ জুন। প্রবন্ধটিতে বাংলার ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে বলা হয়, ‘আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি বলতে বাধ্য থাকব? আমাদের দেশে যারা বাস করে সেই সব ইংরেজ বা উর্দু-হিন্দি ভাষীরা কেন বাংলা শিখতে বাধ্য হবে না? আমার মতো এই যে, এদেশে যেসব ভারতীয় অথবা অবাঙালি বাস করবে, তাদের বাংলা শিখতে হবে, যদি তারা এদেশে বাস করতে চায় এবং আমাদের সঙ্গে চলতে চায়। বাংলা শেখা তাদেরই গরজ। তাদের জন্য ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি শেখা আমাদের গরজ নয়, বরং আমাদের পক্ষে ঘোর অমর্যাদাকর।
১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলার বেশ কটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক তখন ছাপা হতো ৯ হাটখোলা রোডের প্যারামাউন্ট প্রেস থেকে। ইত্তেফাক প্রথম পৃষ্ঠায় ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রæয়ারির ঘটনাবলীর সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘দেশের কাছে লাল ফেব্রæয়ারির শহীদদের ডাক আসিয়াছে।’ ‘বাংলা ভাষা সংগ্রামকে সফল করিয়া রক্তের প্রতিশোধ নাও।’ ‘নুরুল আমিনও প্রতিশ্রæতির পিচ্ছিল পথে পা বাড়াইয়াছে। জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন সরকার আজ মিলিটারির জোরে বাঁচিয়া আছে।’ শুধু ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রæয়ারির ঘটনাবলিই নয়, পরেও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এই পত্রিকাটি।
তরুণ প্রাণের অকৃত্রিম হৃদয়াকুতি এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের একটি উপযুক্ত পত্রের প্রকাশনার তাগিদ থেকেই ১৯৪৯ সালের জুন মাসে ঢাকার ১০৭ ইসলামপুর থেকে প্রকাশিত হয় ‘অগত্যা’। এর কর্ণধার ছিলেন প্রতিভাদীপ্ত একদল সমবয়সী তরুণ। পরবর্তীকালে এদের অধিকাংশই স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। অগত্যার প্রকাশক ও মুদ্রাকর হিসেবে নাম ছাপা হতো আবু সাঈদ নাসির-এর এবং সম্পাদক ফজলে লোহানী। ‘অগত্যা’ ছাপা হতো পুরনো ঢাকার রমাকান্ত নন্দী লেনের পাইওনিয়ার প্রেস থেকে। ১৯৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে ১৯৫২ সালের দ্বিতীয় দফা সর্বাত্মক বাংলা ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত সময়কালে বিদ্রæপাত্মক এবং তীব্র সমালোচনামূলক ভাষায় যেভাবে মাসিক ‘অগত্যা’ অবাঙালি ও উর্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, তা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। সামগ্রিকভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সপক্ষে সেই দুঃসময়ে মাসিক ‘অগত্যা’ ছিল বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠস্বর। নিদারুণ আর্থিক সংকটে ১৯৫২ সালের মার্চ মাস থেকে অগত্যার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।