Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাতৃভাষা খোদার সেরা দান

মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মহান রাব্বুল আলামিনের অসংখ্য নেয়ামতরাজির মধ্যে ভাষা অন্যতম। ভাষা ছাড়া মানুষের জীবন অচল। সকল জাতির মাতৃভাষা আল্লাহতায়ালার দান। মানুষের যতগুলো জন্মগত অধিকার রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে মাতৃভাষার অধিকার। নির্দ্বিধায় স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে স্বাধীনভাবে মনের সুপ্ত অগণিত ভাব ও আবেগ প্রকাশ করার অধিকার। পৃথিবীতে অসংখ্য জীব-জন্তু রয়েছে। তারা স্ব স্ব ভঙ্গিমায় মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে, কিন্তু কেবলমাত্র মানবজাতিই অর্থবোধক ধ্বনিসমষ্টি বা ভাষার মাধ্যমে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। মানুষকে আল্লাহ সামাজিক জীব করে সৃষ্টি করার কারণে সমাজে পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদানের প্রয়োজন পড়ে এবং এর তাগিদেই ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। সে জন্যই ভাষা হচ্ছে ভাবের বাহন, স্বপ্ন-প্রত্যাশা, আত্মপ্রকাশ ও উজ্জীবনের বাহন।
মানুষের অস্তিত্বের প্রধান তিনটি অবলম্বন হচ্ছে মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি। মানুষের জীবন হচ্ছে তার মাতৃভাষা, দেশের ভাষা, জাতির ভাষা। ভাষা সমাজ গড়ে, আবার সমাজও ভাষা গড়ে। তাই কোনো জাতির ভাষা দ্বারা তার সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। সুতরাং মানব সমাজে ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর এ কারণেই মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন ভাষার মাধ্যমে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’ (সুরা আর রহমান: ৩-৪)। পৃথিবীতে মানব বংশের বিচিত্রতা এবং মানুষের বৈচিত্র্যময় রঙ, রূপ, দেহ-সৌষ্ঠবের পার্থক্য যেমন মেনে নিতে হয়, তেমনি তাদের ভাষার পার্থক্যও মেনে নিতে হয়। ভাষাকে আল্লাহতায়ালার মহান সত্তাকে চেনার, জানা ও তার বিশাল কুদরতকে বোঝার নিদর্শন বলা হয়েছে। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমÐলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। অবশ্যই এতে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন।’ (সুরা রুম: ২২)। মাতৃভাষা যে আল্লাহ প্রদত্ত জন্মগত অধিকার এ আয়াতটি তার প্রমাণ বহন করে। এ জন্য কোনো বিশেষ এলাকার মানুষদের ভাষা-বর্ণের বিচিত্রতার কারণে তাদের অনিষ্ট করার পরিকল্পনাকারীদের ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে। ইসলাম নির্দিষ্ট কোনো এলাকার ভাষাভাষী মানুষদের ধর্ম নয়; বরং গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভাষাভাষী মানুষের ধর্ম।
হজরত আদম (আ.)-এর ভাষা কী ছিল এ বিষয়ে মতদ্বৈধতা ও অস্পষ্টতা থাকলেও তার ভাষা ছিল এক। কিন্তু স্থান-কাল পাত্রভেদে পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে। যেমন পরস্পর দুটি জাতি বসবাস করলে তাদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান ও চেনা জানা হয়। আর সাধারণত নিম্ন জাতি প্রভাবশালী জাতির ভাষা কৃষ্টি, কালচারে প্রভাবিত হয়। পরাভূত জাতি যেমন বিজয়ী-জাতির ভাষা গ্রহণ করে, তেমনি বিজয়ী-জাতিও বিজিতের ভাষা গ্রহণ করে। এতে ভাষার সংমিশ্রণ ঘটে এবং নতুন ভাষার সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষায়ও বিভিন্ন জাতির ভাষার শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে। আর এভাবেই যুগে যুগে বিভিন্ন জনপদে-ভূখÐে অজ¯্র ভাষার উদ্ভব ঘটেছে।
মায়ের সঙ্গে যেমন সন্তানের সম্পর্ক গভীর, মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও তেমনি গভীর। মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের স্বভাবগত এবং তা একটি জন্মগত চাহিদা বটে। ইসলাম মানুষের এ স্বভাবগত ও জন্মগত চাহিদার যথেষ্ট মূল্যায়ন করেছে। প্রত্যেক জাতির জন্য আল্লাহতায়ালা স্বীয় পয়গাম বান্দাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য নবী ও রাসুলের এক সুমহান ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর নানা দেশে নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এক বা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রাসুলের এক মহাসমারোহ ঘটেছে। আর প্রত্যেক নবী ও রাসুলের ওপর ওহী প্রেরিত হয়েছে তার স্বগোত্রীয় ভাষার মাধ্যমে। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির কাছে প্রেরিত সকল নবী-রাসুল নিজ নিজ উম্মতকে যে ওহীর বাণী শুনিয়েছেন তা ছিল তাদের মাতৃভাষায়। এ কারণেই প্রত্যেক নবী-রাসুলের ভাষা ছিল তাদের কওমের, তাদের অঞ্চলের মাতৃভাষা। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যেন তারা তাদের স¤প্রদায়ের কাছে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।’ (সুরা ইবরাহীম: ০৪)। নবী ও রাসুলগণ যদি সুকৌশলে মানুষদের আল্লাহর পথে নিজ মাতৃভাষায় আহŸান না করতেন তা হলে জনসাধারণ তা পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারত না। কারণ, আহŸানকারী যদি এক ভাষার হন, আর তার জাতি হয় ভিন্ন ভাষাভাষী, তবে তার ডাকে কেউই সাড়া দেবে না।
আমাদের মহান আদর্শ ও মানবজাতির পথ নির্দেশক মহানবী (সা.) ছিলেন স্বীয় মাতৃভাষায় অতুলনীয়। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন।’ (মুসলিম: ৫২৩)। কাব্যানুরাগী আরব সমাজে আবির্ভূত রাসুল (সা.) ছিলেন আরবদের সবচেয়ে সুন্দর এবং বিশুদ্ধভাষী। তিনি মাতৃভাষা শুদ্ধ এবং সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন। তাই মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলা আমাদের নবীর সুন্নত।
মহানবী (সা.) হলেন আরবি। মাতৃভাষাকে তিনি এত বেশি ভালোবাসতেন যে, তিনি নিজেই বলেছেন, আমি তিনটি কারণে আরবিকে ভালোবাসি। তন্মধ্যে একটি হল, মাতৃভাষার কারণে। রাসুল (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবি বলেই মহান রাব্বুল আলামিন কোরআনের ভাষা হিসেবে মনোনীত করেছেন আরবিকে। যেন আরব সমাজের প্রতিটি মানুষ কোরআনের বাণী অতি সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! কোরআনকে আমি তোমার নিজের ভাষায় সহজ করে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (আদ দোখান: ৫৮)।
ইসলাম এভাবেই মাতৃভাষাকে ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। কোনো ভাষারই একক কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সকল ভাষাই নিরপেক্ষ। ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব হল উক্ত ভাষার উদীয়মান কীর্তিতে। মন্দ ভাবের পরিচয় ভাষার পরিচয় নয়। আরবিতে মন্দ ভাবও প্রকাশ করা সম্ভব। ইসলাম বিজয়ের পূর্বে লাত, মানাত, উযযার স্তুতিগান গেয়ে নির্জলা শিরক চর্চা হত ও অশ্লীল ভাষায় কবিতা চর্চা হত আরবিতে। আবার এই আরবিতেই তাওহিদী বিপ্লব ঘটেছিল। এখনও আরবি ভাষার অনৈসলামিক ভাবধারা চালু আছে। সুতরাং বলা যায়, ভাষার জন্য ইসলাম নয় বরং ইসলামের জন্যই ভাষা। ইসলাম আরবি ভাষার কাছে ঋণী নয় রবং আরবি ভাষাই ইসলামের কাছে ঋণী। ইসলামের উদীয়মান কীর্তিতেই আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব বেড়েছে। সুতরাং ভাষার কোনো দোষ নেই, বরং এ বৈচিত্র্যময় বিপুল বিশ্বে বিভিন্ন জানপদে নানান ভাষা, বর্ণ গোত্রে বিভক্ত মানুষ আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহান তাৎপর্যময় শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
মাতৃভাষা মানুষের জীবনে কতবড় গুরুত্বপূর্ণ সে দিকের প্রতি লক্ষ্য রেখে মনীষীরা মহামূল্যবান উক্তি প্রদান করেছেন। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, ‘প্রত্যেকরই শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষা হওয়া উচিৎ। অপর ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর।’ সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রাহ.) বলেন, ‘কোনো দেশে দীনি খেদমত করতে অগ্রহী ব্যক্তিকে সে দেশের মানুষের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বোধ পূর্ণ মাত্রায় আয়ত্ত করতে হবে।’ হজরত আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রাহ.) তার এক ছাত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘যদি হিন্দুস্থানে দীনি খেদমত করতে চাও, তবে উর্দূ ভাষায় যোগ্যতা অর্জন করো।’ এমনি আরও অসংখ্য উক্তি পাওয়া যায় মাতৃভাষার সপক্ষে। সুতরাং মাতৃভাষার প্রতি আমাদের প্রেম ও ভালোবাসা থাকতে হবে একান্ত করে।
লেখক: শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদরাসা ঢাকা।



 

Show all comments
  • সাইফ ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ৪:২৬ পিএম says : 0
    ওনেক সুন্দর ও প্রয়োজনীয় এবং অনেক গুরুত্ব পূর্ন লেখা। আমাদের সকলকে আল্লাহ পাক উক্ত তাঁর ও তাঁর হাবিব (সাঃ) এর সঠিক অনুগত্যের তৌফিক দান করুন। লেখক সাহেবকে অনেক ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন