পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মানুষ আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। শরীর, মন ও আত্মা নিয়ে মানুষ। মানুষের এইসব উপাদান নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে তবুও মানব রহস্যের অনেক কিছুই অজানা। মানুষ যেসব বিষয় নিয়ে চর্চা করে তার একটি হলো ভালোবাসা। দুনিয়াতে সবচেয়ে সুন্দর ও মধুময় সম্পর্কের নাম ভালোবাসা। ভালোবাসা কোনো একদিনের বিষয় নয়, এটা চিরকালের ব্যাপার। ভালোবাসাকে বিশেষ একটি দিনে ঘটা করে পালন করার সংস্কৃতি চালু করার কোনো মানে হয় না। কারণ ভালোবাসা শব্দটি পৃথিবীর কোন দার্শনিক, কবি কিংবা পন্ডিত আবিষ্কার করেননি। যিনি আবিষ্কার করেছেন তিনি আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন মহান আল্লাহতায়ালা। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমাদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। অথচ আমাদের এই নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভিনদেশীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার। এ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে না পারলে আগামী দিনে আরো ভয়াবহতা নেমে আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবো, কোনো রাষ্ট্রে সামরিক আগ্রাসন চালানোর আগে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হতো। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে শুরুতেই বিদেশী শক্তি সে দেশের জনগণের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে দুর্বল করে দিত যাতে করে সামরিক আগ্রাসন চালানো সহজ হয়ে যায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসেও আমরা তা দেখতে পাই। মাছের পচন যেমন শুরু হয় মাথা থেকে, ঠিক তেমনি একটি দেশ বা জাতির পচন শুরু হয় তার সংস্কৃতি থেকে। ভ্যালেন্টাইন ‘ডে’র ইতিহাস যদি মুসলমানের সন্তানেরা জানতো তাহলে এরকম ভালোবাসা দিবসের আয়োজনকে থুথু নিক্ষেপ করে প্রতিবাদ করতো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তারা আজ ভ্যালেন্টাইনের নোংরা সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমাদের দেশে এই বাণিজ্যিক ভালোবাসার সংস্কৃতি আমদানি করেছিলেন সাংবাদিক শফিক রহমান। ১৯৯৩ সালে ফেব্রæয়ারি মাসে প্রথম যায়যায়দিনে ভালোবাসা দিবস সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে এই নোংরা সংস্কৃতির প্রসার বাড়তে থাকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভ্যালেনটাইন ডে উপলক্ষে আমরা কোন সুস্থ ধারার ভালোবাসা দেখিনি। যা দেখছি তা হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকার ফুল দেয়া আর নেয়া। যুবতীর খোপায় যুবকের ফুল বেঁধে দেয়ার ঢলাঢলির অশ্লীল দৃশ্য। একটু খেয়াল করলে দেখবেন রাজধানীর শাহবাগ ও অন্যান্য এলাকায় এই নোংরা সংস্কৃতির জোয়ারে লক্ষ কোটি টাকার ফুল বেচা-কেনা হচ্ছে। পাঁচ টাকার একটি গোলাপ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ক্রয় করতেও অনেকে কুণ্ঠাবোধ করছে না। অথচ এখনো রাজধানীর ফুটপাতগুলোতে হাজারো অভুক্ত মানুষের কংকালসার দেহ দেখা যায়। আজকাল অনেক মুসলিম তরুণ-তরুণী প্রকৃত বিষয়টি না জেনে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। তারা এটি খুবই কম উপলব্ধি করে যে, তারা যা নির্দোষ বিনোদন হিসেবে পালন করে তার শিকড় পৌত্তলিকতায় ভরপুর। এটা যদি তারা জানতে পারতো তাহলে উল্টো এই নোংরা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতো। ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু তথ্য মুসলিম তরুণ-তরুণীদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরছি। ভালোবাসা দিবসের নামকরণ ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ হওয়ার পেছনে রোমানদের ভূমিকা রয়েছে। ২৭০ সালের কোনো এক সময় রোমান স¤্রাট দ্বিতীয় ক্লদিয়াস সা¤্রাজ্যের তরুণ-তরুণীদের বিয়ে না করার নির্দেশ দেন। তার ধারণা ছিল, বিবাহ বন্ধনে যদি পুরুষেরা আবদ্ধ হয়ে যায় তাহলে যুদ্ধের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হবে। রোমের খ্রিস্টান গির্জার পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন রাজার নির্দেশ অমান্য করেন। কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর রাজার কানে এ ঘটনা চলে যায়। রাজার লোকেরা পুরোহিত ভ্যালেন্টাইনকে রাজার কাছে ধরে নিয়ে যায়। আইন অমান্যের কারণ রাজা জানতে চাইলে ভ্যালেন্টাইন রাজাকে জানান, খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসের কারণে তিনি কাউকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলে বারণ করতে পারেন না। রাজা তার কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় রাজা ভ্যালেন্টাইকে খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে প্রাচীন রোমান পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে আসার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন রাজার প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানান। স¤্রাটের নির্দেশ অমান্যের শাস্তিস্বরূপ রাজা ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ দেন। অতঃপর রাজার নির্দেশে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রæয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদÐ কার্যকর করা হয়। তারপরে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রæয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইনন্স ডে’ ঘোষণা করেন। সত্যিকার অর্থে ভ্যালেনটাইনস ডে একটি প্রতিবাদ বা শোক দিবসের নাম হওয়া উচিত ছিলো। তা না হয়ে এটি হয়েছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বিবাহ করা প্রত্যেক মানব সন্তানের মৌলিক অধিকার। সে বিবাহ করার অপরাধে যদি কাউকে মৃত্যুদÐ দেয়া হয় তাহলে এর চেয়ে বড় অবিচার আর কি হতে পারে? তার চেয়ে বেশি মনে কষ্ট দেয় যখন বিবাহের এই সার্বজনীন অধিকার ও কর্তব্য পালনের ঘটনাটি অবলম্বন করে তার ঠিক বিপরীত কাজটি অর্থাৎ বিবাহ বহির্ভূত নারী-পুরুষের মিলনকে উৎসাহিত করার জন্য নোংরামিকে জাগিয়ে তোলা হয়। আর এই সুযোগে কিছু বিজ্ঞাপন ব্যবসায়ী তাদের পণ্যের প্রসার বৃদ্ধির লক্ষ্যে চ্যানেলগুলোতে অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের দৃষ্টির সামনে অশ্লীলতার পসরা তুলে ধরে।
আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন বিশ্বভালোবাসা দিবস উদযাপন করলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো উপকার হবে কি না? যদি না-ই হয়ে থাকে তাহলে কেন ভিনদেশীয় সংস্কৃতির জোয়ারে আমরা গা ভাসিয়ে দিচ্ছি? দিন ক্ষণ ঠিক করে আমাদের বাবা-মা, ভাই-বোনদের কেন ভালোবাসতে হবে? আমার জন্ম তো হয়েছে ভালোবাসার পরশ দিয়ে। জন্মের শুরুতেই আমরা বাবা-মাকে ভালোবেসে বড় হয়েছি। আমাদের মায়েরা শত কষ্ট সহ্য করে ভালোবাসার পরশ দিয়ে আমাদের মানুষ করেন। ভালোবাসা তো আমাদের প্রাণের সম্পদ। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে যেতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসতে পারবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যে দিন সূর্যটা অধিক নিকটবর্তী হয়ে যাবে, আল্লাহর আরশের নিচে আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত শ্রেণির মানুষ আরশের ছায়ার নিচে স্থান পাবে। তার মধ্যে ঐ দুই ব্যক্তি থাকবে যারা আল্লাহর সন্তুুষ্টির জন্য পরস্পরকে ভালোবেসেছিলো।’ আমাদের ইতিহাস ভুলে গিয়ে আমরা ভিনদেশীয় সংস্কৃতি উদযাপন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। বিশ্ব ভালোবাসার নামে যে, বেহায়াপনা-অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়ছে তরুণ-তরুণীরা তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এমনিতেই আমাদের তরুণ-তরুণীদের অপসংস্কৃতির হাত থেকে রক্ষা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তারপর আবার নতুন নতুন দিবস পালনের নামে নোংরামির পথকে প্রসারিত করতে দেয়া মোটেও সুখকর নয়। ভালোবাসা দিবস আমাদের সংস্কৃতি না হলেও মিডিয়ার বদলৌতে সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে। মিডিয়াগুলো ভালোবাসা দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠন প্রচার করে দেশীয় সংস্কৃতিকে আরো পিছনে ঠেলে দিচ্ছে। যারা ইসলামী মূল্যবোধের কথা শুনলেই নাক ছিটকান তাদের কাছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের গুরুত্ব থাকতে পারে। কিন্তু বিবেকমান মুসলমানের বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের প্রতি বিন্দু মাত্র আগ্রহ থাকা উচিত নয়। সমাজের বিবেকমান মানুষের বিবেকের কাছে বিনীত প্রশ্ন করতে চাই, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের মাধ্যমে আমরা কি নারী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণের মতো ঘৃন্যতম কাজ থেকে আমাদের তরুণীদের রক্ষা করতে পেরেছি? যে দেশের চলন্ত বাসে নারীরা ধর্ষিতা হয় সেদেশের জনগণের বিশ্ব ভালোবাসা দিবস মোটেও সুখের বার্তা বহন করে নিয়ে আসবে না। ভালোবাসা দিবসের ফলে সমাজে অসামাজিকতা, অনৈতিকতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নগ্নতা ও অবৈধ যৌনতার প্রতি আসক্তি বাড়ছে। মানবিক, নৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ মারাত্মক হ্রাস পাচ্ছে। ভালোবাসার দিবসে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহর, পার্ক, রেস্তোরাঁ, ভার্সিটির করিডোর, টিএসসি, ওয়াটার ফ্রন্ট, ঢাবির চারুকলার বকুলতলা, আশুলিয়া, পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর হল রুম সর্বত্র প্রেমিক-প্রেমিকার অশ্লীল ভালোবাসার নোংরামিতে জয়জয়কার। একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে নিয়মিত মার্কেটিং করে যুবসমাজের মধ্যে এই ব্যভিচারের প্রসার বাড়াচ্ছে। অবিলম্বে পারিবারিক মূল্যবোধ সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী এই অশ্লীল ভ্যালেন্টাইনস ডে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।