Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অর্থনৈতিক হেজিমনি বনাম ভঙ্গুর গণতন্ত্রের বাংলাদেশ

মো. নাদিমুদ্দীন | প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ কেইনস বলেছিলেন, অর্থনীতিবিদরা যেটা দশ বছর আগে বলে যান রাজনীতিবিদরা ঠিক দশ বছর পরে সেটা নিয়ে বুলি আওড়ান অথবা গন্ডগোল পাকান। ফরাসি দার্শনিক এন্ডমন্ড বার্ক অষ্টাদশ শতাব্দিকে ‘অর্থনীতিবিদদের যুগ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন এবং এ কথাটি এখনোও সমভাবে প্রযোজ্য। কারণ অর্থনীতি এখন সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে পরিণত হয়েছে। একই সাথে অর্থনীতিদরা বিখ্যাত হয়েছেন তাদের অর্থনৈতিক তত্তে¡র অন্তর্নিহিত সামজিক দর্শনের জন্য। এইজন্য কেইনস বলেছেন, সাধারণ অর্থনীতিদ ও রাজনৈতিক দার্শনিকদের চিন্তাধারাকে লোকে যতটুকু প্রভাবশালী বলে মনে করে, আসলে প্রভাবটা তাঁর চেয়ে অনেক বেশিÑ সেগুলো ভ্রান্তই হোক কিংবা সঠিকই হোক। সত্য বলতে কি, দুনিয়াটা এই অর্থনীতির তত্তে¦রদ্বারা একরকমভাবে চালিত হচ্ছে। বিশ^ব্যাপী বিভিন্ন দেশের আটপৌরে মানুষেরা অনেকেই মনে করে যে, তারা মতাদর্শের সাথে প্রভাবিত হচ্ছে না, কিন্তু দেখা যাবে, আসলে তাঁরা কোন না কোনভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। বস্তুত রাজনীতিবিদরা আজকে যা বলছেন, সেটি কোন না কোন অর্থনীতিবিদ তাঁর আগেই বলে গিয়েছেন।
বর্তমান বাংলাদেশে অর্থনীতিদরা তুলনামূলক সুবিধাজনক পর্যায়ে রয়েছে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ক্রমান্বয়ে উন্নতি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন একটি প্রতিধ্বনিশীল শব্দ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। দেশের সমসাময়িক প্রবৃদ্ধি বিবেচনা করে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একে উন্নয়ন বিস্ময় বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান একে উন্নয়নের ক্রস রোড হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, বাংলাদেশ ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৭.১১% প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.৪% উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে একটি বামন প্রতিষ্ঠান বলে বিবেচনা করা হলেও এডিবি বলেছে এই বছর দেশের প্রবৃদ্ধি ৭% এর মধ্যেই থাকবে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মতো ছোট একটি দেশে এই ধরনের প্রবৃদ্ধি দেশের উন্নয়নের জন্য বড় আর্শীবাদ। রফতানি খাতে আমাদেও প্রশংসনীয় অগ্রগতি, বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং গার্মেন্ট শিল্পের ক্রমবর্ধমান সফলতা বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বড় ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৩০ সালে বৈশ্বিক মহামন্দার কারণে মানুষের চাহিদা কমে যায়। বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্তে¡ও মানুষের চাহিদার অভাবে বাজার ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং মহামন্দা প্রায় ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হয়। ক্লাসিক্যাল বা ধ্রæপদী অর্থনীতিবিদদের সকল নিগূঢ় তত্ত¡ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ কেইনস ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের গোঁড়ামি দূরে ঠেলে দিয়ে নতুন তত্ত¦ হাজির করেন। তিনি বলেন, শুধুমাত্র উৎপাদনের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ করলে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হবে না। কারণ একই সাথে মানুষের হাতে সেই পরিমাণ তারল্য থাকতে হবে যাতে মানুষ চাহিদা পূরণ করতে পারে। তিনি মহামন্দা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হিসেবে সরকারকে সামনে নিয়ে আসেন। বলেন, সরকার তাঁর অর্থনৈতিক কার্যপ্রণালী বা টুলসগুলো ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে চাহিদা তৈরি করবে ফলে অধিক চাহিদা বাজারে সরবরাহ বাড়াবে এবং অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হবে। তিনি আরো বলেন, ভোগ হলো অর্থনীতির চাকা। মানুষ যত বেশি ভোগ করবে সকল কিছুর চাহিদাও তত বাড়বে। কারণ মানুষ বেশি পরিমাণে কিনবে। অধিক চাহিদা মিটানোর জন্যে উৎপাদন বাড়বে এবং প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে।বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৬ সালে এক হিসাব মতে বাংলাদোশের সরকারি চাকরিজীবীদের বছরে ৮.৩১% ভোগ প্রবনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা মোট জিডিপির ৫.৮৯ শতাংশ এবং অন্যান্য গৃহস্থালী সংক্রান্ত সাধারণ মানুষদের ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে ২.৯৩ শতাংশ হারে। দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর মোট ভোগ প্রবনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ৩.৩২ শতাংশ যা মোট জিডিপির ৭৫ শতাংশ। অবশ্য দারিদ্র্য হ্রাসে ভোগ বৃদ্ধি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করলেও ভবিষ্যতে করবে কিনা তা একটি আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়।
কেননা এই ভোগ একটি আধিপত্য বা হেজিমনি›র উৎসে পরিণত হয়েছে।সরকার সেই সুযোগটি নিচ্ছে। সরকার অর্থনৈতিক টুলস, যেমন বিলাস বহুল বাজেট, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ, ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে অর্থায়ন এবং সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি সহ বিভিন্নভাবে প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে অধিক চাহিদা তৈরি করছে। মানুষ এখন তাদের ভোগের ঝুড়িটা অনেকখানি সম্প্রসারণ করেছে এবং আগের থেকেও বর্তমানে অধিক ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছে। এই আধিপত্য বা হেজিমনির কারণে মানুষ রাষ্ট্র কর্তৃক অনেক গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক অধিকার বঞ্চিত হলেও এর বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার তাড়না ও প্রয়াসটা হারিয়ে ফেলেছে। এইটা নব্য-উদারতাবাদের পৃথিবীর পক্ষে সবচেয়ে বড় বিজয় যে, মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে সেটা দেখতে পেলে সেটি তার চারপাশের অন্যান্য প্রভাবকের কারণে তার অনুধাবন আসছে না। কারণ তাঁরা মনে করছে আমরা তো বেশ ভালই আছি, কোন ধরনের অর্থনৈতিক অভাবের সম্মুখীন হচ্ছি না।
বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক ভাবধারা কেমন তা চারপাশে একটু তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে। বর্তমান সরকারের বিগত চার বছরের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের তাকালে দৃশ্যমান হয়, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন ও শাসক দলের অভ্যন্তরে দ্বন্ধ,বিভেদ ও অনৈক্য বৃদ্ধি। বাড়ছে সরকারের অন্যায্য কর্মকান্ডের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ না থাকায় এবং সরকারের যথেষ্ট সুনজরের অভবে আর্থিক ও ব্যাংক খাতে জনগণের টাকার বিপরীতে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লুটপাট বাড়ছে। দেশে প্রতিদিন গুমের সংখ্যা বেড়েই চলছে, হত্যাকান্ড দেখতে পাচ্ছি প্রতিনিয়ত যার কোন বিচার হচ্ছে না। যাও বিচার হচ্ছে তাও অপরাধীরা আইনের ফাঁকে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। যার ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অনেক ঘটনা ঘটছে।অনেকে হয়তো বাংলাদেশকে তুলনা করতে পারেন সিঙ্গাপুর অথবা মালয়েশিয়ার সাথে এই বলে যে,এসব রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক বিষয়সমূহ উপেক্ষিত হওয়া সত্তে¡ও তথাকথিত অর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তো হচ্ছে। এটা থেকে ধারণা করা যেতেই পারে যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে এই ধরনের প্রচ্ছন্ন স্বপ্ন লুক্কায়িত। কিন্তু আশার দিক হলো, এই দেশে ৫ বছর পরে একটি নির্বাচনী আবহাওয়া প্রবাহিত হয় এবং বলপ্রয়োগের ফলে সেখানে একধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ব্যক্তির নির্ধারিত ভোগের ঝুড়ির মধ্যে যদি বেশ কিছু নতুন ভোগ্যপণ্য যুক্ত হয় তাহলে ওই ভোক্তার স্বাধীনতা বাড়ে। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টোটি ঘটছে। ভোক্তার ভোগ প্রবনতা বৃদ্ধি হওয়া সত্তে¡ স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে।ফলে ধারণা করাই যায়, এই ভোগ প্রবণতা অন্য সব কিছুর উপর আধিপত্য বা হেজিমনির মতো কাজ করছে। অ্যান্টনিও গ্রমাসি যদিও কাল মার্ক্সের অর্থনেতিক নিয়ন্ত্রণবাদী তত্তে¡র বিপরীতে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কথা বলেছেন কিন্তু সেটা যে ভোগের মাধ্যমেও করা যায় সেটা একটি আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু অমর্ত্য সেনের কথা শুনলে খুব আতংকিত হতে হয়, কারণ তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্র দুর্ভিক্ষ বয়ে নিয়ে আনতে পারে। ফলে আজকের ভোগ আগামী দিনের দুর্ভোগে পরিণত হতে পারে।সুতরাং সরকারকে আগামী নির্বাচন গণতান্ত্রিক ভাবধারা বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে।
উন্নয়নের এই মহাসড়কে সরকারকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা ভাবতে হবে। সুষ্ঠু, অবাধ এবং স্বাধীন নির্বাচন কমিশনারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সমুন্নত করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের মতো ভঙ্গুর গণতন্ত্রের রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক হেজিমনির ধারণা যথেষ্ট আশাব্যাঞ্জক নাও হতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন