Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ছিনতাইকারীদের এই বর্বরতার শেষ কোথায়?

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ভোরের ঢাকায় ফাঁকা রাস্তায় প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে মানুষ। ছিনতাইকারীদের অবিশ্বাস্য বর্বরতার কথা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফিরে যাওয়ার গ্যারান্টি শূন্যের কোঠায়। নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব হলেও সে দায়িত্ব বেনজিরভাবে উপেক্ষিত। ক্ষমতা কারও জন্য চিরস্থায়ী নয়। তারপরও মানুষ ক্ষমতার পাগল। ক্ষমতায় থাকার আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ভাবনা সে ভাবনার মধ্যে ছিটে ফোটাও যদি সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি থাকতো তাহলে দিন-দুপুরে ছিনতাইকারীর হাতে এভাবে মানুষের প্রাণ চলে যেত না। নিকট অতীতে শিশু হত্যার সিরিজ চলেছিল। আর এখন চলছে ছিনতাইয়ের সিরিজ। সামাজিক এই অবক্ষয় এমনি এমনিতে বেড়ে যায়নি। সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের সুশাসন যখন অনুপস্থিত থাকে তখন সেখানে হাজারো অন্যায়ের সূচনা হয়। সামাজিক অন্যায়-অবিচার, জুলুম রোধ করে শান্তি ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা তো সরকারে দায়িত্ব। একটি দেশের সরকার যখন দেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত করে তখন মানুষ সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করে। যেমনটি জেফারসন বলেছেন, রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে। আমেরিকান গণতান্ত্রিক এই নেতার মতে, একটি ভালো সরকারের প্রথম ও একমাত্র লক্ষ্য হলো, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া ও তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ দেখা, তাদের ক্ষতি না করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের জনগণ অনেক ক্ষেত্রেই সেই সুখটুকু উপভোগ করতে পারছে না। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা যদি হয় অনিশ্চিত তখন আর কষ্টের সীমা থাকে না। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও ছিনতাইয়ের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এমনকি ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। তাঁরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, মানুষ খুন করতেও কুন্ঠাবোধ করছে না। রাজধানীতে কয়েকটি মর্মান্তিক নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটলেও পুলিশ ছিনতাইকারী চক্রের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। ছিনতাইয়ের ঘটনা যত বাড়ছে, অপরাধ দমনে পুলিশ বাহিনীর ব্যর্থতার চিত্র ততই স্পষ্ট হচ্ছে।
একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসনের ব্যতয় ঘটে তখনই হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ছিনতাইয়ের মতো অমানবিক ঘটনা ঘটে। ছিনতাইয়ের ঘটনা কোনভাবেই কমানো যাচ্ছে না। সাধারণ পথচারীদের হাতে থাকা ব্যাগ, গায়ের গহনা, টাকা পয়সা, মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য জিনিস শুধু ছিনিয়ে নিচ্ছে তা কিন্তু নয়, ছিনতাইকারীরা অবলীলায় মানুষ খুন করছে। তাদের হাতে মানুষের নিহত হওয়ার ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। দুরপাল্লার বাস, ট্রেন বা লঞ্চ থেকে রাজধানীতে নেমেই তিক্ত ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় অনেকের। হেঁটে, রিকশায়, বাসে, প্রাইভেটকারে কিংবা নিজের গাড়িতে যেভাবেই হোক না কেন, যে কোনো সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়তে পারে। এরা গুলি করে বা ছুরি মেরে সবকিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে। মোটর সাইকেল বা গাড়িতে করে এসে রিকশাযাত্রীদের ব্যাগ ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁচকা টানে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ভাড়ায় চালিত অটোরিকশর খাঁচা লাগানোর পরে এখন ছাউনি কেটে নেওয়া হচ্ছে মোবাইল বা ব্যাগ। যানজটে ভোগান্তির এই শহরে লাখো মানুষ ঠিকমতো চলতে না পারলেও ছিনতাইকারী ঠিকই সবকিছু লুণ্ঠন করে পালিয়ে যাচ্ছে। সিসি ক্যামেরা, যানবাহনের ডিজিটাল নম্বরপ্লেট থাকা সত্তে¡ও সনাক্ত করা যাচ্ছে না ছিনইকারীদের ব্যবহৃত যানবাহনগুলো। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত সাত মাসে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে প্রাণ গেছে ৭ জনের। তাদের মধ্যে ৫ জনের প্রাণ গেছে ভোরেরদিকে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে। সর্বশেষ ২৬ জানুয়ারির একই দিনে রাজধানীর সায়েদাবাদ ও ধানমন্ডি এলাকায় ছিনতাইকারীদের হাতে দু’জন প্রাণ হারিয়েছে। ধানমন্ডির মিরপুর রোডে কাক ডাকা ভোরে টানা পার্টির শিকার হন বেসরকারি হাসপাতালের আয়া হেলেনা বেগম। সায়েদাবাদ এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত হয়ে দৌড়ে হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন ব্যবসায়ী ইব্রাহিম। কিন্তু ছিনতাইকারীদের নিষ্ঠুরতার শিকার এ ব্যবসায়ী প্রাণে বাঁচতে পারেননি। তাদের করুণ নৃশংস মৃত্যুর দায় কে নেবে?
গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় শুধু ভোরেই ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে পাঁচজন। এর মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নারী, পুরুষ, শিশু ও ছাত্র রয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর দয়াগঞ্জের রেলব্রিজ এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় মায়ের কোল থেকে পড়ে নিহত হয় সাত মাসের শিশু আরাফাত। সন্তানের চিকিৎসার জন্য শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় এসেছিল দম্পতিটি। ১৩ জানুয়ারি রাতে শেরেবাংলানগর এলাকায় ইসকেন্দার হাওলাদার নামে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালককে ছিনতাইকারী চক্র হত্যা করে তার গাড়িটি নিয়ে যায়। ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর টিকাটুলিতে এক শিক্ষিকাকে ছিনতাইকারীর কবল থেকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হয় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খন্দকার আবু তালহা। ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিউটের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ফরহাদ আলম ছিনতাইকারীদের শিকার হয়ে মারা যান । ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে যখন কোনো মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে তখনই কেবল ছিনতাইয়ের বিষয়টি বড় হয়ে উঠে। অথচ প্রতিনিয়ত মানুষকে ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হচ্ছে। সেসব ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। অনেকে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে থানায় যায় না। ফলে ছিনতাইকারীরা প্রশ্রয় পেয়ে দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে। তারা প্রকাশ্যেই ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, রাজধানীর প্রায় শতাধিক স্পটে প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। চিহ্নিত এসব স্পটে ছিনতাইয়ের সাথে কারা জড়িত আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর তা অজানা থাকার কথা নয়। এদের গ্রেফতার করে আইনের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করলে রাজধানী থেকে ছিনতাই বহুলাংশে কমে যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। তবে পুলিশকে রাজনৈতিক দমন-পীড়নে যেভাবে ব্যস্ত রাখা হয় তার ছিটে ফোটাও যদি ছিনতাই প্রতিরোধে ব্যবহার করা হতো তাহলে বর্বর ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে সাধারণ মানুষকে এভাবে জীবন দিতে হতো না।
পুলিশের ভাষ্যমতে, গত চার বছরে ছিনতাইয়ের ঘটনা ক্রমাগত কমছে। তবে মানবাধিকারকর্মী ও ভুক্তভোগীরা অনেকে পুলিশের এমন তথ্যের সঙ্গে একমত নন। ঢাকা মহানগর পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ২৫৬টি, ২০১৫ সালে ১৭২টি এবং ২০১৬ সালে ১৫০টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মামলা হয়েছে মাত্র ১৪২টি। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহা. নূরুল হুদা মনে করেন, অপরাধ কমে গেছে, এটা বলার জন্য পরিসংখ্যান কম দেখানোর ধারণা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। মামলা নিতে হবে এবং দ্রæত নিষ্পত্তি করতে হবে। তিনি আরো বলেন, মানুষ যখন দেখবে পুলিশের কাছে গিয়ে প্রতিকার পাচ্ছে তখন পুলিশের ওপর তাদের আস্থা বাড়বে। এতে অপরাধও কমে আসবে। ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, যেসব ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হয় কেবল সেগুলোর ক্ষেত্রেই পুলিশ বা আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে। কিন্তু এর বাইরে রাতে কিংবা দিনদুপুরে যারা ছিনতাইয়ের শিকার হন তাদের খোঁজ খবরটুকু কেউ রাখে না। ধারাবাহিকভাবে বর্বরোচিত ও নৃশংস এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও ছিনতাইকারীদের আইন প্রয়োগকারী বাহিনী গ্রেফতার করতে পারেনি। ফলে ছিনতাইকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে পুলিশের তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই অপরাধের লাগাম এখনই টেনে ধরতে না পারলে সামনে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন