Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে কতিপয় সদস্যের অপকর্মে বিব্রত পুলিশ কর্মকর্তারা

গুম খুনের ভয়ঙ্কর অভিযোগ

| প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে খোদ পুলিশের বিরুদ্ধে খুন, গুমের মতো ভয়ানক অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠছে। বেড়েই চলেছে পুলিশের কতিপয় সদস্যের ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ড। অপরাধীদের দমন করাই যাদের মূলকাজ তাদের বিরুদ্ধেই উঠছে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ। কতিপয় পুলিশ সদস্যের এমন অপকর্মে বিব্রত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবুও থামছে না কতিপয় বেপরোয়া পুলিশ সদস্যের অপকর্ম। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সর্বগ্রাসী নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আইনের রক্ষক যারা তারাও ভক্ষকে পরিণত হচ্ছে।
সীতাকুন্ডে নিরীহ যুবককে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসাতে গিয়ে ঘটে তুলকালাম কান্ড। জনতার উপর নির্বিচারে পুলিশের গুলিতে খুন হন এক যুবক। আহত হন আরও দুই জন। ওই ঘটনায় এক এসআইসহ তিন পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তারা হলেন- এসআই নাজমুল হুদা, কনস্টেবল আবুল কাশেম ও আনসার সদস্য ইসমাইল হোসেন। দুই পুলিশ সদস্য সীতাকুন্ড থানায় কর্মরত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে।
গত বুধবার রাতে সীতাকুন্ড উপজেলার ভাটিয়ারি ইউনিয়নের তেলিপাড়া এলাকায় সাদা পোশাকে অভিযানে যান এসআই নাজমুল হুদা। স্থানীয়রা জানান, এক যুবককে তিনি আটক করে তার পকেটে ইয়াবা রেখে দেন। এরপর তাকে জোর করে থানায় নেওয়ার চেষ্টা করলে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন সেখানে জড়ো হয়। এসময় গ্রামবাসীর উপর গুলি করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। এতে তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে মোঃ সাইফুল নামে এক যুবকের মৃত্যু হয় ওই রাতেই। গুলিদ্ধি অপর দুজনকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। এ ঘটনায় নিহত সাইফুলের ভাই দিদারুল আলম বৃহস্পতিবার রাতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওইদিন সকালে ওই তিন পুলিশ-আনসার সদস্যকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। রাতে মামলার পর তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। এই পুলিশ সদস্যদের দাবি, আসামি ধরতে গেলে গ্রামবাসী তাদের ওপর হামলা করলে আত্মরক্ষা করতে তারা গুলি চালিয়েছিলেন। তবে থানা পুলিশ বলছে ওই এসআই থানাকে না জানিয়ে সাদা পোশাকে এ অভিযানে যান। এবিষয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তারা সাদা পোশাকে অভিযানে গেছে। যেহেতু একটা ঘটনা ঘটেছে, আমরা নিহতের পরিবারের অভিযোগ আমলে নিয়েছি। ওই মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার পর পর পুলিশ সুপার তদন্ত কমিটি গঠন করেন এবং কেউ দোষী হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেরও হুঁশিয়ারী দিয়েছিলেন। সীতাকুন্ডের ওই ঘটনার মতো পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সাদা পোশাকে অভিযানের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানী করার অভিযোগ আছে। কিছু ঘটনা মিডিয়াতে আসার পর পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বেশিরভাগ ঘটনা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। জুলুম নির্যাতনের শিকার অনেকে আদালতে মামলা করছেন।
এদিকে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পরিবহন ব্যবসায়ী শামীম সরদারকে গুম করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ব্যবসায়ীর স্ত্রী চম্পা বেগমের অভিযোগ, তার সঙ্গে তুলে নেয়া আরও ছয়জনকে ঢাকার দু’টি থানায় পৃথক মাদক মামলায় চালান দেয়া হলেও শামীমের কোনো খোঁজ মিলছে না। ঢাকা ডিবির এক সদস্য তার স্বামীকে ফেরত দেয়ার কথা বলে কয়েক দফায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এই ঘটনায় একটি মামলা করেন তিনি। ওই মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। ডিবির সদস্যরা শামীম সরদারের মালিকানাধীন একটি নোহা মাইক্রোবাসও নিয়ে যায়। স্বামী ও গাড়ি ফেরত দেয়ার কথা বলে ডিবি সদস্য মোতাহের হোসেন তিন দফায় চম্পা বেগমের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন বলেও তিনি মামলায় অভিযোগ করেন। স্বামীকে তুলে নেয়ার অভিযোগে ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন চম্পা বেগম। মামলায় ঢাকা ডিবির ১০ সদস্যকে আসামী করা হয়। পিবিআই চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা বলছেন মামলাটির তদন্ত চলছে।
কয়েক বছর আগে নগরীর পাঁচলাইশ থানার পুলিশ হেফাজতে বীমা কর্মকর্তা মোঃ রোকনুজ্জামানের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হয়। টাকার জন্য নির্যাতন করে বীমা কর্মকর্তাকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করে ৬ পুলিশ সদস্য, আনসার ও পুলিশের সোর্সসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন নিহতের স্ত্রী। ওই মামলা তদন্ত চলছে ঢিমেতালে। হাটহাজারী থানার ওসি বেলাল উদ্দিন জাহাঙ্গীর, এসআই মোঃ খায়রুজ্জামান এবং এসআই আবু বক্কর সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে আদালতে মামলা করেন উপজেলার পশ্চিম শিকারপুর এলাকার বাসিন্দা সজল আচার্য। নগরীর এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সোনার বার ছিনতাইয়ের ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিচার চলছে আদালতে। অভিযুক্ত দুই পুলিশ সদস্য হলেন এএসআই মিজানুর রহমান, কনস্টেবল খান এ আলম। তারা কোতোয়ালি থানার এনায়েত বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলেন।
খুন, গুমের মতো মাদক পাচার, সোনার বার ছিনতাই, নিরীহ লোকজনকে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, চার্জশিটে অন্তর্ভুক্তি ও বাদ দেয়ার নামে টাকা আদায়, জমির দখল পাইয়ে দিতে সহায়তা করাসহ পুলিশের বিরুদ্ধে যেন অভিযোগের অন্ত নেই। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তবে এরপরও কতিপয় বেপরোয়া পুলিশ সদস্যের অপকর্ম থামছে না। অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য পার পেয়ে যান। এ কারণে পুলিশে যারা অপরাধপ্রবণ তারা নিত্যনতুন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তবে মহানগর ও জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধ করে কেউ পার পাচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলাও হচ্ছে।
পুলিশের কতিপয় সদস্যের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা সর্বগ্রাসী নৈতিক অবক্ষয়ের ফল উল্লেখ করে বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেস গাজী সালেহউদ্দিন বলেন, দেশে যে হারে উন্নয়ন হচ্ছে, নৈতিক অধপতনও হচ্ছে ঠিক তার উল্টো গতিতে। উন্নয়নের সমান্তরালে নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন নাগরিক তৈরী হচ্ছে না। ফলে এই উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না। সমাজে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিও এর জন্য দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। এখন যে গণতন্ত্র চলছে তাতে সাধারণ মানুষের কোন অংশগ্রহণ নেই। ফলে সরকারকে জনগণের উপর ভরসা না করে পুলিশ বাহিনীর উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এই নির্ভরশীলতা পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্যকে বেপরোয়া করে তুলেছে। এমনিতেই জনগণ এখনও পুলিশ বাহিনীকে তাদের বন্ধু ভাবতে পারছে না। তার উপর এই ধরনের অপরাধ প্রবণতা বাড়তে থাকলে পুলিশ বাহিনীর উপর মানুষের আস্থা শূন্যে নেমে আসবে- যা কারো জন্যই কল্যাণকর হবে না।



 

Show all comments
  • রুবেল ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮, ২:৫৯ এএম says : 0
    সকল অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক।
    Total Reply(0) Reply
  • manik raihan ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮, ৭:০০ পিএম says : 0
    সরকারি অফিস এবং অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেভাবে ইচ্ছা অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। যারা সৎ এবং আন্তরিক, যাদের দেশের প্রতি ভালবাসা আছে, তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। দেখা যায় দুর্নীতিবাজরাই ঘুষের বিনিময়ে পদোন্নতি পায়। যখন দেখা যায় অসৎ, দুর্নীবাজরা অবৈধ টাকার বিনিময়ে পদোন্নতি পেয়ে ভাল পদে যায়, তখন সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তখন তারাও দুর্নীতির পথে পা বাড়ায়। কাজেই সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল্যায়ন করুন। আশাকরি এসব ঘটনা কমে আসবে। বাংলাদেশে যেভাবে দুর্নীতি বিপ্লব ঘটে চলেছে তাতে সরকার এভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নীরব থাকলে, জাতির জন্য ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে?
    Total Reply(0) Reply
  • manik raihan ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮, ৭:০২ পিএম says : 0
    ইনকিলাবকে ধন্যবাদ। আশাকরি আরও দুর্নীতি বিরোধী খবর ছাপিয়ে ইনকিলাব জনস্বার্থে কাজ করে যাবে!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ