পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ-এসডিজি বাস্তবায়নে ব্যাপক তোড়জোড় চলছে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে। এটি জাতিসংঘের কর্মসূচি। এসডিজির মেয়াদকাল ২০১৬-২০৩০ সাল। এর ১৭টি উন্নয়ন অভীষ্টের জন্য ১৬৯টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে ২৪১টি নির্দেশক রয়েছে। এটা পূরণে বাংলাদেশ সরকারও প্রতিশ্রতি দিচ্ছে এবং তৎপরতা চালাচ্ছে। দেশবাসীও কম-বেশি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। কারণ, এর সাথে দেশের সার্বিক উন্নতি, শান্তি ও মর্যাদা জড়িত। সর্বোপরি এমডিজি পূরণে বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্বে মডেলে পরিণত হয়েছে। এমডিজির মেয়াদকাল ছিল ২০০০-২০১৫ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে দেশে তিনটি সরকার তথা বিএনপি সরকার, ১/১১ এর সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করেছেন। তাই এই সফলতার জন্য একক কোন সরকারের কৃতিত্ব নেই। কম-বেশি তিনটি সরকারই কৃতিত্বের অধিকারী। যাহোক, এমডিজি পূরণে দেশ সাফল্য অর্জন করার কারণেই এসডিজি পূরণে সাফল্য অর্জন করার দায়িত্ব বর্তেছে বেশি। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে পূর্বের সফলতা ¤øান হয়ে যাবে। এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, যা আমাদের একার পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই বিদেশি সহায়তা আবশ্যক। দেশের উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা করে আসছে দাতারা দীর্ঘদিন থেকেই। এখনো জিডিপিতে তাদের অবদান ১% হলেও উন্নয়ন খাতে তাদের অবদান প্রায় সিকিভাগ। তাই এসডিজিও যেহেতু দেশের সার্বিক উন্নয়ন, সেহেতু তারা এক্ষেত্রেও সহায়তা করতে আগ্রহী। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম বা বিডিএফ এর তৃতীয় শীর্ষ সন্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় গত ১৭-১৮ জানুয়ারি। সন্মেলনে এসডিজি সফলভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) থেকে আর্থিক প্রাক্কলন প্রণয়ন এবং তা সন্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। সন্মেলনটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার বক্তব্যে দেশের চলমান উন্নতির বর্ণনা দিয়ে এসডিজি পূরণের জন্য উন্নয়ন ফোরামের সকলকেই পূর্ণ সহায়তা করার আহŸান জানান। অতঃপর সন্মেলনে অংশগ্রহণকারীগণ স্ব-স্ব মতামত ব্যক্ত করেন, যা বিস্তারিতভাবে দেশের মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।
বিডিএফ’র তৃতীয় শীর্ষ সন্মেলনে সরকার কর্তৃক উপস্থাপিত প্রাক্কলন মতে, এসডিজি পূরণে বাংলাদেশের বাড়তি প্রয়োজন হবে ৯২,৮৪৮ কোটি ডলার বা ৭৪ লাখ ২৭ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা (যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১৯ গুণ বেশি)। প্রাক্কলিত অর্থের ৮৫.১১% বা প্রায় ৬৩ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এর মধ্যে সরকারি খাতের চেয়ে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তা বেশি। এজন্য বছরে গড়ে ৬.৯১ বিলিয়ন ডলার প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ স্থির করা হয়েছে (বর্তমানে এর পরিমাণ গড়ে ২ বিলিয়ন ডলার)। এ বিষয়ে জিইডি সদস্য ড. শামসুল আলম সন্মেলনে বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে বিভিন্ন খাতে কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হবে প্রতিবেদনে তার একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় যে ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে সেটি অব্যাহত থাকলেও ৯২৮.৪৮ বিলিয়ন ডলার বেশি ব্যয় করতে হবে ২০১৭-২০৩০ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জিডিপি যে হারে বাড়ছে সেটি যদি বজায় থাকে সে ক্ষেত্রে এসডিজি অর্জনে জিডিপির প্রায় ১৯.৭৫ ভাগ অর্থ বাড়তি জোগাড় করতে হবে। বর্তমানে আমাদের জিডিপির আকার স্থিরমূল্যে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। অবশ্য, শুরুর দিকে এত বড় ব্যয় করতে হবে না। তবে ক্রমান্বয়ে অর্থব্যয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এসডিজির একটি লক্ষ্য আরেকটি লক্ষ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নে অর্থ ব্যয় করলে হবে না, সমন্বিতভাবে অর্থ ব্যয়ের উদ্যোগ থাকতে হবে। তবে এর সাথে ‘ওভারল্যাপিং’ হওয়ার বিষয়টিও দেখতে হবে। বেশিরভাগ লক্ষ্য অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর সাথে জড়িত। ২০৩০ সালের মধ্যে এই অগ্রগতি অর্জনের জন্য প্রকৃত জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭% ধরে রাখতে হবে। যা ২০৩০ সাল নাগাদ ৯ শতাংশের ঘরে উন্নীত করতে হবে। পাঁচটি খাত থেকে এসডিজির এই অর্থ জোগাড় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো: সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ, পিপিপি, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক সহায়তা ও এনজিও খাতের অর্থায়ন। অর্থাৎ প্রাক্কলিত অর্থের ৪২.০৯% বেসরকারি বিনিয়োগ, ৩৫.৫% সরকারি খাত, ৫.৫৯% পিপিপি, ১৪.৮৯% বৈদেশিক উৎস ও ৩.৯৩% এনজিও। অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান তার বক্তব্যে বলেন, এসডিজি অর্জনে অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ আছে। তবে তা মোকাবেলা করতে সক্ষম সরকার। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের যে ধারণা দেয়া হয়েছে তার কিছু আসবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ও কিছু আসবে বিদেশিদের থেকে। আগামীর কাজ হচ্ছে সে অর্থায়ন নিশ্চিত করা যা প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রী অব্যাহতভাবে করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়নের মতো গুরু দায়িত্বটিও সরকারকে অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই এসডিজির লক্ষ্যগুলোর অর্জন টেকসই হবে। কিন্তু এজন্য সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করে যাওয়ার সুযোগ দেয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এলডিসি পরবর্তী যাত্রায় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে পিপিপি, এফডিআই, রেমিটেন্স ও রফতানি আয় সচল রাখা। বিশেষ করে রেমিটেন্স কীভাবে বাড়ানো যায় এবং বৈধ চ্যানেলে তার প্রবাহ নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে কাজ করছে সরকার। দেশে যে রেমিটেন্স আসছে, তার ৫০ শতাংশই অবৈধ পথে আসছে। যে পরিমাণ বৈধ পথে আসছে তারও উৎপাদনমুখী খাতে ব্যবহার হচ্ছে না। অর্থাৎ রেমিটেন্স জিডিপির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলেও এ খাত থেকে বিনিয়োগ শূন্য। এর থেকে বিনিয়োগ উৎপাদন খাতে আনার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি বøু-ইকোনামির সম্ভাবনাও কাজে লাগাতে হবে। পিকেএসএফএ চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, এসডিজির ফোকাস হতে হবে মানবসম্পদকেন্দ্রিক। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন না হলে তার সুফল টেকসই হয় না। তাই জনসংখ্যাকে কীভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাÐে সম্পৃক্ত করা যায় তার কৌশল বের করতে হবে। দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হলে এটি অনেকটা কমে যায়। পাশাপাশি টেকসই অর্থনীতির জন্য টেকসই অবকাঠামো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করতে হবে। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায়ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি থাকতে হবে। ইউএনডিপির প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি বলেন, এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশের জন্য তিনটি বড় ঝুঁকি আছে। যেমন: প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, একই প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় ও পিপিপি জোরদার করতে না পারা।
দুই দিনব্যাপী বিডিএফ সন্মেলনে উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনিক দক্ষতা, বাড়ানো, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। এছাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি, জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি ও নারীর প্রতিসহিংসতা বন্ধ, পুষ্টিহীনতা দূর, কারিগরী শিক্ষা বৃদ্ধি ইত্যাদি। সন্মেলনে উন্নয়ন সহযোগীরা সরকারের সাথে একসঙ্গে কাজ করতে সন্মত হয়েছে। তবে এসডিজি বাস্তবায়নে তাদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোন প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। এসডিজি বাস্তবায়নে যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা দেশের স্বাভাবিক কাজকর্ম নির্বাহের পর অতিরিক্ত ব্যয়। যার প্রায় ৮০% নির্বাহ করতে হবে অভ্যন্তরীণভাবেই। দেশের পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক থাকে, তথা রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি স্থিতিশীল থাকে, প্রাকৃতিক পরিবেশ যদি অনুকূল থাকে, সব ক্ষেত্রের উন্নয়ন যদি লক্ষ্যমাত্রা মতে পূরণ হয়, দুর্নীতি, অপচয়, যানজট, জলজট, সন্ত্রাস, দখলবাজী, দলবাজী, চাঁদাবাজী ইত্যাদি যদি বন্ধ হয়, দাতাদের প্রতিশ্রুত সব অর্থ যদি নিয়মিতভাবে ছাড় ও ব্যবহৃত হয়, শিক্ষার গতি, নারীর ক্ষমতায়ন, রেমিটেন্স, রপ্তানী ও আইটির অগ্রযাত্রা যদি অব্যাহত থাকে এবং আর্ন্তজাতিক পরিস্থিতি অনুকূল থাকে, তাহলে এসডিজি বাস্তবায়ন করা কঠিন নয়। কিন্তু এসবের যদি সবগুলো অনুকূল না হয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা সৃষ্টি হয় এবং প্রাক্কলিত অর্থ আদায় যদি সঠিকভাবে না হয়, তাহলে এসডিজি বাস্তবায়ন করা দূরহ হয়ে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। দ্বিতীয়ত: এসডিজি বাস্তবায়নের মেয়াদকাল আগামী ১৩ বছর। স্বাভাবিক নিয়মে এই সময়ের মধ্যে তিনটি সরকার দেশ পরিচালনা করবে। এর প্রতিটি সরকারকেই এসডিজি বাস্তবায়নে সমান আগ্রহ ও নিষ্ঠা থাকতে হবে। কিন্তু তা না হয়ে যদি যে কোন একটি সরকারের বর্ণিত কর্মে গাফিলাতি কিংবা অনিহা থাকে অথবা বার্ষিক রুটিন ওয়ার্ক পালনে যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে সবকিছু ভন্ডুল হয়ে যাবে। এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবকিছুই হার্ড সিডিউল, যা যথাযথভাবে পালিত হলে এসডিজি বাস্তবায়নে সফলতা অর্জিত হবে। নতুবা যে কোন একটা ছুটে গেলে অপূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হবে যা কাম্য নয়। তাই এসডিজি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় ঐক্য আবশ্যক। আর এটা হলেই গণতন্ত্রও সুসংহত হবে। স্মরণীয় যে, গত ২০ জানুয়ারি পিআরআই আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বিডার নির্বাহী চেয়রম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা ৭.২৮% জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। এটা নিয়ে আমরা সুখী হতে পারি। কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভোগার কিছু নেই। কারণ, মধ্যম আয়ের অনেক দেশ আর এগোতে পারছে না। থাইল্যান্ডসহ বহু দেশ মধ্য আয়ের দেশে আটকে আছে। ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ উন্নত দেশ হতে চাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক অবকাঠামো দিয়ে বাংলাদেশ বহুদূর যেতে পারবে না। পরের ধাপে যাওয়ার জন্য বৃহতভাবে সংস্কার প্রয়োজন। উন্নত দেশ হতে হলে ২৪ বছরের মধ্যে দেশের মোট আয় তিন ট্রিলিয়নে উন্নীত করতে হবে। ২৪ বছরের মধ্যে আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতিরআকার ১০ থেকে ২০ গুণ বাড়াতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।