Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গৃহিনীদের কান্না শোনার কেউ নেই?

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:২২ পিএম, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৮

দুপুরে কতদিন আগে ‘স্বাভাবিক ভাত’ খেয়েছি মনে করতে পারছি না। নিত্য দিন দুপুরে খেতে হচ্ছে ভাতের নামের জাউ নয়তো আধা সেদ্ধ চাল। এর মূলে চুলা জ্বলে না। মাসের পর মাস ধরে রাজধানীর বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংকট। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় দুপুরে গ্যাস থাকে না। কোথাও কোথাও লাইনে গ্যাস থাকলে চুলা জ্বলে নিভু নিভু। এই আগুনে রান্না করা দূরহ। ফলে গৃহিনীদের গ্যাসের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। কেউ কেউ মধ্যরাতে সারাদিনের রান্না করে রাখতে বাধ্য হন। দুপুরে বেলা গড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়লে দুপুরের রান্না বিকেলে করেন। সীমিত আয়ের যে সব পরিবারে শিশু ও ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে সেই গৃহিনীদের যন্ত্রণার সীমা পরিসীমা নেই। অথচ এ সংকট সমাধানে রাষ্ট্রের কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই। দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করে এখন কোনো কাজ হয় না। এমনকি ভুক্তোভোগীরা মিটিং মিছিল আন্দোলন করলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। তাহলে কি রাজধানীর গৃহিনীরা গ্যাসের অভাবে চোখের পানি ফেলতেই থাকবে? আর শিল্প কারখানার চাকা?
ভাতের জন্য মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে, দেশান্তরি হয়। মাসের পর মাস বছরের পর বছর গ্যাসের অভাবে সেই ভাত খাওয়ার যন্ত্রনার ঢাকাবাসীর যারা ভুক্তভোগী নন; তাদের কাছে বিষয়টি গুরুত্বহীন বৈকি। কিন্তু যারা গ্যাসের সংকটে টিমটিম চুলার আগুনে ভাত নামের জাউ-আধাসেদ্ধ চাল নিত্যদিন খাচ্ছেন তারা বোঝেন বাসায় খাবার রান্না কত জনগুরুত্বপূর্ণ। প্রায় দুই কোটি মানুষের এই শহরে লাখ লাখ গৃহিনী শুধু গ্যাস সংকট ও গ্যাসের চুলা নিভু নিভুতে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন; নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে তাদের এই ভোগান্তি-কষ্ট দেখার যেন কেউ নেই। রাজধানীর বিস্তীর্ণ এলাকায় বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বাসাবাড়িতে দুপুরে গ্যাস থাকে না। কোথাও কোথাও গ্যাস থাকলেও চুলা জ্বলে নিভু নিভু। নিভু নিভু আগুনে রান্নার খাবার নামে খাদ্যটি কেমন উপাদেয় হয়?
রাজধানীর নাগরিকদের গ্যাসের চুলা ছাড়া রান্নার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে গৃহিনীরা রান্নার জন্য গ্যাসের চুলার উপর নির্ভরশীল। অধিক খরচে স্টোপ বা খড়ির চুলা ব্যবহারে রান্নাবান্না শুরু হলে রাজধানী কার্যত এক মাসের মধ্যেই পরিবেশ দূষনে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। আর ৫ তলা ১০ তলা বিল্ডিং এ রান্নার খড়ি তোলা কি নিরাপদ? আর বিদ্যুতের বিশেষ চুলায় ঘরে ঘরে রান্না শুরু হলে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে যাবে? গ্যাসের চুলার বিকল্প হতে পারে সিলিনন্ডার গ্যাস। সেটার ব্যবহারে কতজনের আর্থিক সংগতি আছে? রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের পরিকল্পিতভাবে গ্যাসের কষ্ট দিয়ে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারে বাধ্য করতে চায়; সেটারও সিদ্ধান্ত আসা দরকার। গ্যাসের ব্যবহারের নীতিমালা অপরিহার্য। বছরের পর বছর এভাবে গ্যাস সংকট চলতে পারে না। রাজধানীর মীরপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা, যাত্রাবাড়ি, শনিরআখড়া, জুরাইন, পাড়া ডগাইর, সায়েদাবাজ, দয়াগঞ্জ, ওয়ারী, মোহাম্মদপুর, বছিলা, আদাবর, পশ্চিম আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, কাফরুল, পশ্চিম ধানমন্ডি, লালবাগ, নবাবপুর, সোবহানবাগ, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, কামরাঙ্গীরচর, উত্তরা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, যাত্রাবাড়ীর একাংশ, দক্ষিণ বনশ্রী, মগবাজার, কমলাপুর, মুগদা, মায়াকাননসহ বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিলে গ্যাসের ভয়াবহ সমস্যা চিত্র পাওয়া যায়। শত অভিযোগ দিয়েও সমাধান মিলছে না। সমাধানে রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগও নেই। ভুক্তোভোগীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান মাসের পর মাস ধরে এ সঙ্কট তীব্র হলেও কোনো সমাধান মিলছে না। কবে মিলবে সমাধান, তারও কোনো হদিস নেই। টানা সঙ্কটে বিপর্যন্ত হয়ে পড়ছে কোনো কোনো অঞ্চলের জনজীবন। জীবন ব্যয় বাড়ছে সব শ্রেণির মানুষের। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের মানুষরা চরম বিপাকে পড়েছেন। অনেকেই হোটেলের খাবার খেয়ে দিন পার করছেন; কেউ গ্যাস সিলিন্ডার এনে প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। কিন্তু যাদের সেই আর্থিক সংগতি নেই তাদের কষ্টের সীমা পরিসীমা নেই।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড সূত্রে জানা যায় দেশে বর্তমানে দৈনিক কমবেশি ৩ হাজার ৫শ এমএমসিএফ (মিলিয়ন কিউবিক ফুট) গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরিতে গড়ে ২ হাজার ৭শ ৪০ এমএমসিএফ উৎপাদন করা হয়। চাহিদার বিপরিতে দৈনিক প্রায় ৮শ এমএমসিএফ গ্যাসের ঘাটতি। বর্তমানে গ্যাসের মুজুদের পরিমাণ প্রায় ১২.৭৪ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট)। এ মজুদ হতে এখনই চাহিদা পুরণ করা হচ্ছে না। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের তথ্য হলো আগামী ২ বছরের মধ্যে বর্তমান মজুদ হতে গ্যাস উৎপাদনের হার সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাবে। পরবর্তীতে বর্তমানে মজুদ হতে গ্যাস উৎপাদনের হার দ্রæত হ্রাস পেতে থাকবে। সুতরাং উৎপাদন বৃদ্ধি ও নতুন গ্যাস মজুদ আবিষ্কার এই মুহূর্তে গ্যাস সেক্টরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আবার সমস্যা সমাধানে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে জানা গেছে, গ্যাসের ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ভূ-তাত্বিক জরিপ ৫৭০ লাইন কিমি দ্বিমাত্রিক জরিপ ১২ হাজার ৮শ কিমি এবং ত্রিমাত্রিক জরিপ ২ হাজার ৮শ ৪০ বর্গ কিমি সম্পন্ন করা হবে। বাপেক্সে ২০২১ সালের মধ্যে ১০৮টি কুপ খনন (৫৩টি অনুসন্ধান কূপ, ৩৫ টি উন্নয়ন কুপ এবং ২০ টি ওয়ার্কাওভার কূপ) খনন করার পরিকল্পনা করেছে। এই কূপগুলো হতে আনুমানিক দৈনিক ৯শ ৪৩ থেকে এক হাজার একশ ৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হবে আশা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে চলতি বছরে দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি ল্যান্ড বেসড এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। গ্যাসের অপচয় ও সিস্টেম লস রোধ, ব্যবস্থাপনা ও জ্বালানি ব্যবহার দক্ষতা বৃদ্ধি লক্ষে সকল আবসিক গ্যাস গ্রাহকের আঙ্গিনায় প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন করা হবে।
এই যে কাগুজে হিসেবে দেয়া হলো এটা নিছক আমলাদের ছেলে ভোলানো গল্প। বাস্তবতা হচ্ছে রাজধানী ঢাকায় তীব্র গ্যাসের সংকট। গ্যাস সংকট নিরসনে স্বল্প মেয়াদী, মধমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া দরকার। শুধু ঢাকার গৃহিনীরাই চোখের পানি ফেলছেন না; শিল্পমালিকরাও গ্যাস সংকটে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছেন। শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংকটের কারণে অসংখ্য কারখানা দিনের বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকছে। কিছু কারখানায় বিকল্প উপায়ে উৎপাদন চালু থাকলেও তাতে উৎপাদন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে পোশাক শিল্পেও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ চলমান গ্যাস সংকটের অন্যতম কারণ অবৈধ গ্যাস সংযোগ। অভিযোগ রয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলোর অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় কিছু কিছু শিল্প কারখানা এবং অঞ্চলে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছে। মানুষের জন্য অত্যান্ত প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাসের বিতরণ ও সরবরাহ নিয়ে নানা রকমের অভিযোগ আছে। এসব আমলে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে গ্যাসের সংকট দূর হবে না। প্রথমেই অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে হবে। কেউ যেন বরাদ্দের অতিরিক্ত গ্যাস না নিতে পারে দেখতে হবে সেটিও। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সিন্ডিকেট করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে অর্থ আদায়ের পরিবর্তে অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। পাশাপাশি খাতাকলমের হিসেব নয়; গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির দিকেও নজর দিতে হবে। বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করতে হবে। তবেই ঘুরবে শিল্পের চাকা; বন্ধ হবে গৃহিনীদের কাঁন্না। ##



 

Show all comments
  • বাবুল ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ৫:১৭ এএম says : 0
    সবাই এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই
    Total Reply(0) Reply
  • Alam ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ৯:৪৫ এএম says : 0
    গাড়িতে গ্যাস দেয়া বন্ধ করতে হবে। গাড়ি চলবে তেলে , গ্যাসে কেন ? গাড়িতে গ্যাস দেয়া বন্ধ করলেই গ্যাস সংকট দূর হবে ।
    Total Reply(0) Reply
  • belal hossen ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ২:৫২ পিএম says : 0
    উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সিন্ডিকেট করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে অর্থ আদায়ের পরিবর্তে অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গ্যাস

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৯ জানুয়ারি, ২০২৩
১৮ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ