Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কিশোর অপরাধের নির্মম শিকার

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রামে ভয়ঙ্কর কিশোর অপরাধের নির্মম শিকার স্কুল ছাত্র আদনান ইসফার (১৫)। আলোচিত এ খুনের ঘটনায় সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ পাঁচজনকে গতকাল (বৃহস্পতিবার) গ্রেফতারের পর পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে কিশোর গ্রুপের জুনিয়র-সিনিয়র দ্ব›েদ্ব এ খুনের ঘটনা ঘটেছে। ভিডিও ফুটেজে পাওয়া ছবির সূত্র ধরে ওই পাঁচজনকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার এক ছাত্রলীগ নেতার বাড়ি থেকে পাকড়াও করা হয়। পুলিশ বলছে, গ্রেফতারকৃতরা বন্দরনগরীর জামালখান-চকবাজার-গণি বেকারি এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত। তাদের গডফাদার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রউফ। চট্টগ্রাম কলেজ-মহসিন কলেজে আধিপত্য বিস্তার এবং এলাকায় চাঁদাবাজির জন্য এসব কিশোরদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেন ওই নেতা। হত্যাকান্ডের সময় খুনিরা যে পিস্তল ব্যবহার করেছিলেন সেটি তাদের দিয়েছিলেন এলাকার এক রাজনৈতিক বড় ভাই। ওই পাঁচজনের কাছ থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছুরিটি উদ্ধার করা হলেও ওই পিস্তলের হদিস মিলেনি।
চট্টগ্রাম নগরীর পাড়া-মহল্লা, অলিগলিতে বাড়ছে কিশোর অপরাধীদের দাপট। এরা নিজেদের মধ্যে হানাহানির পাশাপাশি চাঁদাবাজি, মাস্তানি, মাদক সেবন ও ব্যবসার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগের কতিপয় নেতা এসব উঠতি যুবকদের হিরোইজমকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত রয়েছেন। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে কিশোর অপরাধের ভয়ঙ্কর বিস্তার ঘটছে। সবকিছু জেনেও নির্বিকার থাকছে পুলিশ প্রশাসন। বিষয়টি স্বীকার করেন নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন বলেন, কিশোর অপরাধ দমন পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য পারিবারিক শিক্ষা জরুরী। তিনি বলেন, কিশোর অপরাধীরা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদদেরও ভাববার সময় এসেছে। আদনান হত্যাকান্ডের ঘটনায় যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা উঠতি যুবক হলেও কিশোর কাল থেকেই তারা নানা অপরাধে জড়িত। এদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে বলে জানান তিনি।
মঙ্গলবার দুপুরে প্রকাশ্যে নগরীর ব্যস্ততম জামাল খান মোড়ে কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। কয়েকজন যুবক অস্ত্র হাতে তাকে ধাওয়া করে উপর্যপুরি ছুরিকাঘাত করে। সেখানে তার মৃত্যু হয়। অসংখ্য মানুষের সামনে খুনের ঘটনা ঘটলেও সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। আলোচিত এ খুনের ঘটনার পর সড়কে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ থেকে পুলিশ ছয়জনকে চিহ্নিত করে। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নেয়া চারজন ফটিকছড়ি উপজেলার সমিতিরহাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মোঃ ফয়সালের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ওই বাড়ি থেকেই পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। অপর একজনকে নগরীর বাদুরতলা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হল নগরীর চান্দগাঁওয়ের হাজেরা তজু কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মঈন খাঁন, সাব্বির খান ও মুনতাছির মোস্তফা, চকবাজার ডিসি রোডের হলি ফ্লাওয়ার স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী এখলাছ উদ্দীন আরমান এবং নগরীর সদরঘাট ইসলামিয়া ডিগ্রী কলেজ থেকে সদ্য এইচএসসি পাস করা আবদুল্লাহ আল সাঈদ। তাদের সবার বয়স ১৮ বছর বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাদের সবার বাসা চকবাজার এলাকায়।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-দক্ষিণ) শাহ মোঃ আব্দুর রউফ বলেন, মহসিন কলেজের মাঠে খেলা, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ এবং হিরোইজম প্রদর্শন করতে গিয়ে এই হত্যাকান্ড ঘটার কথা জানিয়েছে তারা। তিনি জানান, খুনের শিকার আদনানও একটি গ্রুপের সদস্য। ক্রিকেট খেলা নিয়ে ওই গ্রুপের সাথে গ্রেফতারকৃতদের গ্রুপের বিরোধ ছিল। এর জের ধরে ওইদিন তাকে হত্যা করা হয়।
পুলিশ জানায়, আদনান খুনের সাথে জড়িতরা সবাই নগরীর চন্দনপুরা পশ্চিম গলির বাসিন্দা আব্দুর রউফের অনুসারী উঠতি সন্ত্রাসী। এসব কিশোর ও উঠতি সন্ত্রাসীদের নিয়ে গত এক বছরে চট্টগ্রাম কলেজ-মহসিন কলেজকেন্দ্রিক ছাত্রলীগ নামধারী একটি বলয় গড়ে তোলে সে। মহসিন কলেজের ছোট গেইটের পাশে আগে শিবিরের যেসব মেস ছিল, সেগুলো পুলিশ একসময় তল্লাশি চালিয়ে খালি করে। একটি মেসের দু’টি কক্ষ দখলে নিয়ে রউফ কয়েকজন কর্মীকে সেখানে রাখেন। আর রউফের গ্রুপের কর্মীরা সবসময় আড্ডা দেন ‘মেজ্জান হাইলে আয়্যূন’ হোটেলে। আব্দুল রউফ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। স্থানীয়রা জানায়, আব্দুর রউফের নেতৃত্বে গড়েউঠা জুনিয়র সন্ত্রাসীরা পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা গণহারে চাঁদাবাজি ও চাঁদার দাবিতে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করছে। এমন কয়েকটি ঘটনায় চকবাজার থানায় মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি।
গতকাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন বলেন, গ্রেফতারকৃতরা আব্দুর রউফের অনুসারী এটা নিশ্চিত। তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও রয়েছে। আদনান হত্যাকান্ডে রউফের সম্পৃক্ততা আমরা এখনও পাইনি। এ ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেলে তাকেও গ্রেফতার করা হবে। বড় ভাই, ছোট ভাই যাদের বিষয়ে তথ্য পাব, তাদের গ্রেফতার করব। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। মামলা থাকার পরও রউফ কেন গ্রেফতার হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সে জামিনে আছে কিনা জানি না, তবে তার বিরুদ্ধে কোন ওয়ারেন্ট থাকলে অবশ্যই তাকে গ্রেফতার করা হবে।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, খুনের ঘটনায় আদনানের বাবা এলজিইডি খাগড়াছড়ির প্রকৌশলী আকতারুল আজম বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় গ্রেফতার পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।
খুনীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ
স্কুলছাত্র আদনান ইসফার হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে নগরীর কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। নগরীর জামাল খান মোড় এলাকা থেকে এই বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে এসে মানববন্ধনে সমবেত হয় শিক্ষার্থীরা। এসময় শিক্ষার্থীদের হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিল- চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের মেধাবী ছাত্র আদনান ইসফারের হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে মানববন্ধন। ওই ব্যানারে ‘রউফ গ্রুপের সাঈদ, মঈন, খান সাব্বির ও জিলহাজসহ খুনিদের ফাঁসি দাবি’ করা হয়। মানববন্ধনে থাকা শিক্ষার্থীরা বলেন, দিনের বেলায় জামাল খানের মত জায়গায় একজন ছাত্রকে ছুরি মেরে খুন করা হল। এটা মেনে নেয়া যায় না। এভাবে স্কুলছাত্র খুন হওয়ায় শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা ‘নিরাপত্তাহীনতায়’ ভুগছেন বলেও জানান শিক্ষার্থীরা। সমাবেশে কয়েকশ শিক্ষার্থী যোগ দেয়।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ