চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মো. আবুল খায়ের স্বপন : সকল প্রসংশা মহান আল্লাহ পাকের জন্য। তাঁর নিগুঢ় ও মহৎ ইচ্ছার বহমানতায় বিশ^জগতের জন্য সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে এ জগতে আগমন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক এবং নারী জাতির মুক্তির ত্রাণকর্তা মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)। হযরত (সা.) এক অন্যান্য নাম যে নাম প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর দিগদিগন্তে কোটি কোটি মানুষের মুখে এবং হৃদয়ে ধ্বনিত এবং প্রতিধ্বনিত হয়। এ নাম তাদের হৃদয়ে বইয়ে দেয় শান্তি এবং আনন্দের ফল্গুধারা। নারী জাতি মহান আল্লাহ পাকের এক অতুলনীয় এবং অভিনব সৃষ্টি। তারা মানব সমাজেরই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ অংশ। কিন্তু ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় দেখা যায় তার ভিন্ন চিত্র। পৃথিবীতে প্রচলিত অন্যান্য ধর্মে নারী জাতিকে সকল “পাপ কর্মের প্রধান উৎস”, “শয়তানের সমতুল্য”, “বিষাক্ত সাপের ন্যায়”, “পুরুষদের প্রতারক”, “আত্মাবিহীন জীব”, “বাঁদী” ইত্যাদি ন্যায় আপত্তি কর শব্দে ব্যবহার করত। তাছাড়া পিতার মৃত্যের পর তার সৎ মা বড় ছেলের বৈধ উত্তরাধিকারী হওয়ার ন্যায় ন্যক্কারজনক রীতিও তৎকালে আরবে বিরাজমান ছিল। হযরত মোহাম্মদ (সা.) কর্তৃক আনীত সার্বজনিন জীবন ব্যবস্থা ইসলামই নারী জাতি সর্ম্পকে যাবতীয় অমানবিক ও অপমানকর ধারণা ও মতার্দশের ভ্রান্তিকর রীতিনীতির চির অবসান করে।
ইসলাম নারীকে যুগযুগ সিঞ্চিত অপমান, লাঞ্ছনা হীনতার পুঞ্জিভূত স্তূপের জঞ্জাল থেকে চিরদিনের জন্য মুক্তি দান করে এবং তাদের ললাটস্থ সহস্রব্দকালের কলঙ্কের সীমারেখা মুছে দেয়। ইসলাম নারীকে সঠিক মানবতার মূল্য দান করে। তাদের স্বাভাবিক সুকুমার বৃত্তি ও সহজাত গুণাবলীর সমন্বয় সাধন করে। ইসলাম নারীকে মমতাময়ী মা হিসেবে যে সম্মান এবং মর্যাদার স্বর্ণ শিখরে অধিষ্ঠিত করেছে তা পৃথিবীতে প্রচলিত অন্যান্য ধর্মে এবং সভ্যতায় সত্যিই বিরল। আজকাল যেখানে কোন কোন সভ্য জাতি মাতৃত্বের স্বীকৃতি দিতেও কুণ্ঠিত সেখানে ইসলাম মাতৃত্বের দাবি পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যেখানে মাতা অমুসলিম হলেও তার প্রতি সহনশীল শালীন, ভদ্র এবং মার্জিত ব্যবহার করার জন্য সন্তানদেরকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলাম কিছু ক্ষেত্রে পিতার চেয়ে মাতাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে। কেননা মাতা তার সন্তানদের জন্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে পিতার চেয়ে বেশি দুঃখ-কষ্ট অমøান বদনে সহ্য করে থাকেন। মাতা দুনিয়ার সকল প্রকার চাওয়া-পাওয়া, সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস বির্সজন দিয়ে জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এবং চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করে তোলেন। আল্লাহপাক মাতার সে অবর্ণনীয় এবং নিদারুন দুঃখ-কষ্ট, ত্যাগ-তীতিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে পবিত্র কোরআনের সূরা লুকমানের ১৪ নং আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, “আমি মানুষকে তাদের মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি, তার মা তাকে কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করেছে, তাকে একাধারে দু’বছর দুধ পান করিয়েছে। কাজেই তোমরা আমার প্রতি এবং তোমার মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, তোমাদের ফিরে আসা তো আমার নিকটেই”। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শিশু বয়সেই তাঁর মা জননী আমেনা মারা যান। হালিমাতুস সাদিয়া ছিলেন তাঁর দুধমাতা। কোন প্রয়োজনে যখনি মা হালিমা নবীজি (সা.)-এর কাছে আসতেন তখনি নবীজি (সা.) তাঁর সম্মানে নিজে উঠে দাঁড়াতেন এবং নিজের পবিত্র চাদর মোবারক তাকে বসার জন্য বিছিয়ে দিতেন।
মহানবী (সা.) নিজে মায়ের মর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং উম্মতে মোহাম্মদী (সা.) কে মায়ের মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে বলিষ্ট ভূমিকা পালনের জন্য আদেশ দিয়েছেন এ প্রসঙ্গে বুখারী এবং মুসলিম শরীফে এভাবে বর্ণিত আছে, “এক ব্যক্তি নবীজি (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন মানুষদের মধ্যে আমার পক্ষ থেকে ভালো সাহচর্যের যোগ্য কে? নবীজি (সা.) বলেন তোমার মা, ব্যক্তিটি বলল তারপরে কে? নবী (সা.) বললেন এরপরও তোমার মা, ব্যক্তিটি আবার জিজ্ঞেস করল এরপর কে, নবী (সা.) বললেন এরপরও তোমার মা, ব্যক্তিটি বলল তারপরে কে, নবী (সা.) বললেন এরপর তোমার পিতা”।
মুসনাদে আহমাদে উল্লেখ আছে হাজেমা (রা.) নামক এক সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন আমি রাসূল (সা.)-এর কাছে জিহাদে শরীক হওয়া সংক্রান্ত ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য উপস্থিত হলাম। তখন নবীজি (সা.) বললেন তোমার মা কি জীবিত আছেন? আমি বললাম হ্যাঁ, তখন নবীজি (সা.) বললেন তুমি ফিরে যাও এবং তোমার মাতার সম্মান এবং খেদমতে লেগে যাও। কেননা তার দু’পায়ের নিচেই বেহেশত রয়েছে”। কেননা মাকে যথাযথভাবে সম্মান দিলে তার উপযুক্ত খিদমত করলে এবং তার হক পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করার সাধ্যমত চেষ্টা করলে সন্তানের জন্য বেহেশত যাবার পথ উন্মুক্ত হয়।
অন্যদিকে মায়ের মনে কষ্ট দিলে, তার অবাধ্য হলে, সে যতবড় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হউক না কেন তার বেহেশত লাভ করা কঠিন। এ প্রসঙ্গে বুখারী শরীফে নবীজি (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা মা’দের সাথে সর্ম্পক ছিন্ন করা, তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা তাদের হক নষ্ট করাকে চিরদিনের জন্য হারাম করে দিয়েছেন”। পিতামাতা উভয়ই সন্তানের কাছে সমান ভক্তি-শ্রদ্ধা পাওয়ার দাবিদার তবে অধিকাংশ মুসলিম মনীষীদের মতে সন্তান একসাথে উভয়ের হক আদায়ে অসর্মথ হলে কিংবা দু’জনের হক সাংঘর্ষিক মনে হলে এমতাবস্থায় মায়ের হকই অগ্রবর্তী হবে, প্রাধান্য পাবে। সন্তানের জন্য মায়ের দোয়া এবং বদদোয়া কোনটাই আল্লাহর দরবার থেকে খালি হাতে ফেরৎ আসে না। মায়ের ফরিয়াদ এবং আর্তনাত উভয়ই আল্লাহর কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য এবং এর ফলাফল অবধারিত।
এতে কোন সন্দেহ এবং সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাম নেই মায়ের মনক্ষুণœতা সন্তানের জন্য ইহকাল এবং পরকাল উভয় জগতের জীবনই অভিশপ্ত এবং এ অপরাধের শান্তি আল্লাহপাক এ জগতেই বান্দাকে প্রদান করে থাকেন এই প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত আছে- আলকামা নামক এক সাহাবী মারা যাচ্ছেন। এমন সময় তার জবান থেকে কালেমা শরীফ বের হচ্ছে না। খবর পেয়ে রাসূল (সা.) এলেন এবং তিনি আলকামার মাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কি পুত্রের উপর অখুশী? উত্তরে তিনি বললেন ইয়া রাসূল (সা.) আমার ছেলে আমার চেয়ে স্ত্রীকে বেশি গুরুত্ব দিত, তার কথা মত কাজ করত। তখন এখন নবীজি (সা.) বললেন ঠিক এ কারণেই আল্লাহপাক তার মুখে কালিমার উচ্চারণ বন্ধ করে দিয়েছেন। তখন নবীজি (সা.) হযরত বিলাল (রা.) কে হুকুম দিলেন আলকামাকে আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দাও। আলকামার মা একথা শুনে চিৎকার করে বললেন আমার চোখের সামনে আমার সন্তানকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলে আমি কেমন করে সহ্য করব। রাসূল (সা.) তখন তাকে বললেন আপনার সন্তানকে ক্ষমা করে দিন তা না হলে সে অনন্ত কাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে এ কথা শুনে মায়ের মন নরম হয়ে গেল তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করে দিলেন এবং আলকামার জবানে কালেমা শরীফ জারি হয়ে গেল”।
এ প্রসঙ্গে মুসলিম শরীফে হযরত আবু হোরাইরা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত আছে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, (বনী ইসরাঈলের এক বুজুর্গ ব্যক্তি) আবিদ জুরাইজ একবার নামায পড়ছিল। এমন সময় তার মা এসে তাকে ডাকল জুরাইজ মনে মনে বলিল নামায পড়িব নাকি মায়ের ডাকে সাড়া দিব। অবশেষ মায়ের ডাকে সাড়া দিল না ইত্যবসরে মা বলিল হে আল্লাহ তাকে ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু দিবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত সে পাপকারীনি এবং বাজারী মহিলাদের না দেখে। একদা জুরাইজ তার ইবাদত গাহে ছিল এমন সময় এক মহিলা তার কাছে আসল এবং অন্যায় কাজের প্রস্তাব দিল আবিদ জুরাইজ তা অস্বীকার করল। অতঃপর ঐ মহিলা এক রাখালের কাছে গেল এবং তাকে দেহ দান করল। ফলে এক একবাচ্চা জন্ম নিল। মহিলা বলল এটা জুরাইজের বাচ্চা। লোকজন রাগাম্বিত হয়ে জুরাইজের নিকট আসল এবং তার ইবাদাত গাহ ভেঙ্গে দিল তাকে গালাগাল শুরু করল ইবাদাত গাহ থেকে নামিয়ে আনল। জুরাইজ অযু করে নামায পড়ল। তারপর ঐ শিশু বাচ্চার কাছে আসল এবং বাচ্চাকে লক্ষ্য করে বলল তোমার পিতা কে? ঐ বাচ্চা বলল রাখাল। লোকজন তখন তাদের ভুল বুঝতে পারল এবং বলল আমরা সোনা দিয়ে তোমার ইবাদত গাহ বাঁধাই করে দিব। জুরাইজ বলল না মাটি দিয়ে বানিয়ে দাও”।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।