Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিপিডির পর্যালোচনায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি

| প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০১৭ সালকে দেশের ব্যাংকিং খাতের কেলেংকারির বছর হিসেবে অভিহিত করেছে। বলেছে, ওই বছর কুঋণ ও সঞ্চিতির ঘাটতি বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে অপরিশোধিত ঋণ। এতে গুটি কয়েকজনের প্রাধান্য তৈরি হয়েছে। আর জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া ব্যাংকগুলো কার্যকর না হয়ে বরং জটিলতার সৃষ্টি করেছে। জড়িয়ে পড়েছে টাকা পাচারের সঙ্গেও। এসব অনিয়ম প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার উল্টো ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে সেখানে পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছে। সিপিডি কেবল ব্যাংকিং খাতই নয়, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের সামগ্রিক অর্থনীতির প্রকৃতি, ধারা ও প্রবণতার প্রথম অন্তবর্তীকালীন পর্যালোচনাও উপস্থাপন করেছে। এই পর্যালোচনা তুলে ধরতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়েনি। গুণগত প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় আশানুরূপ কর্মসংস্থান হচ্ছে না। কমছে না দারিদ্র বিমোচনের গতির হার। এই পর্যালোচনায় আরও স্থান পেয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যু, বন্যা ও খাদ্য আমদানি সংক্রান্ত বিষয়। আর প্রশ্ন তোলা হয়েছে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির সরকারি হিসাব নিয়ে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত অর্থনৈতিক পর্যালোচনার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন সিপিডির ফেলো, বিশেষ ফেলো, নির্বাহী পরিচালক ও গবেষণা পরিচালক। ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বিভিন্ন ব্যক্তিখাতের ব্যাংকে প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে মালিকানার বদল হয়েছে। ব্যক্তিখাতের ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনা ঘটছে। তিনি সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকেই দায়ী করেছেন। তার মতে, খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে। সরকার খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হিসাব দিচ্ছে। কিন্তু বাজারের সঙ্গে তার গরিমল দেখা গেছে। টাকার ওপরও চাপ বাড়ছে। এসব দিকের বিবেচনায় ২০১৭ সালে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল হয়ে গেছে। চাপের মুখে পড়েছে। প্রসঙ্গত তিনি উল্লেখ করেছেন, আমরা সংস্কারের কথা বলেছিলাম, যা না এগিয়ে বরং পেছনের দিকে গেছে। ব্যাংকিং খাত এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। 

পর্যালোচনায় ব্যাংকিং খাতসহ বিভিন্ন খাতের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা হতাশাজনক। ব্যাংকিং খাত, বলার অপেক্ষা রাখেনা, অর্থনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। এই খাতটির অবস্থা শোচনীয়। অনিয়ম-দুর্নীতিতে প্রায় ডুবতে বসেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন, রেমিটেন্স, রফতানি আয়, আমদানি ব্যয়, রাজস্ব আদায় প্রভৃতিতে নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষনীয়। বিনিয়োগে সুখবর নেই। কর্মসংস্থানে ধীরগতি। মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়েছে। আয় বৈষম্য বেড়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরীব আরও গরীব হয়েছে। সিপিডির হিসাবে, সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশের খানাপ্রতি আয় ২০০৫ সালে ছিল ১১০৯ টাকা যা কমে ২০১৬ সালে ৭৩৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ধনী ৫ শতাংশের খানা প্রতি আয় এই সময়ে ৩৮৭৯৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৮৯৪১ টাকা। ২০১০ সালে দেশের মোট সম্পদের ৫১.৩২ ভাগ ছিল সর্বোচ্চ ধনী ৫ শতাংশের কাছে। অন্যদিকে ০.৪ ভাগ ছিল সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশের কাছে। ২০০০ থেকে ২০০৫ সালে দারিদ্র হ্রাসের হার ছিল ১.০৮ শতাংশ, যা ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালে নেমে এসেছে ১.০২ শতাংশে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার ৩.০৩ থেকে কমে হয়েছে ১.০৯ শতাংশ। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, যদি একটি দেশের ভেতরে ক্রমান্বয়ে আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে তা প্রবৃদ্ধির হারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ যে দেশে যত বেশি বৈষম্য আছে সে দেশে প্রবৃদ্ধির হার ওপরের দিকে নিয়ে যাওয়া তত বেশি সমস্যা। একথা সবারই জানা, একটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশের ওপর নির্ভর করে। কোনো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি বলতে শুধু রাস্তা-ঘাট, দালানকোঠা ইত্যাদির নির্মাণ বা উন্নয়ন বুঝায় না। এইসঙ্গে জনজীবনমানের উন্নয়ন ও স্বাচ্ছন্দও বুঝায়। এই শেষোক্ত ক্ষেত্র আমরা যে না এগিয়ে পিছিয়ে পড়ছি, বিদ্যমান বাস্তবতা তার সাক্ষ্য দেয়। সিপিডির অর্থনৈতিক পর্যালোচনাও এটা উঠে এসেছে।
সরকারের দাবি, দেশের শনৈ শনৈ উন্নয়ন হচ্ছে। দেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। এই দাবির পক্ষে সড়ক, সেতু, রাস্তাঘাট, বন্দর, বিদ্যুৎ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গৃহীত ও বাস্তবায়নাধীন বড় বড় প্রকল্পের বিবরণ হাজির করা হচ্ছে। উল্লেখ করা হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির খতিয়ান। অবকাঠামো উন্নয়ন উন্নয়নের অংশ এবং উপায়ও বটে, সে কারণে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন একটি স্বাভাবিক ব্যপার। কিন্তু এজন্য জনগণের উন্নয়ন ও স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি উপেক্ষার শিকার হতে পারেনা। আমজনতার অবস্থা বিপর্যয়কর। তাদের দিন যাপন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র খাদ্য কিনতেই তাদের আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান দিয়ে এই বাস্তবতা আড়াল করা যায় না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আসলে কাদের হচ্ছে, তা কারো অজানা নয়। মুষ্টিমেয় কিছুলোক এ্ই প্রবৃদ্ধির সুফল ভোগ করছে। দিনে দিনে তারা ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে। মাথাপিছু আয়ের হিসাব আসলে গোঁজামিলের হিসাব। একজন ধনী ব্যক্তির আয় আর একজন দিনদরিদ্র ব্যক্তির আয় আকাশ-পাতালের চেয়েও ফারাক। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্য রয়েছে। গড় হিসাবে মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করে সেই বৈষম্য ঢাকা যায় না। বলা যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান উন্নয়নের নির্ভরযোগ্য সূচক নয়। আমজনতার উন্নয়ন ও স্বাচ্ছন্দ্যকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। একেই সব উন্নয়নের লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করতে হবে। অর্থনীতির বর্তমান নাজুক পরিস্থিতি উত্তরণে এই নির্বাচনের বছরে সরকার কতটা কি করতে পারবে, আমরা জানি না। বিনিয়োগ, বন্ধ্যাত,¡ মূল্যস্ফীতি, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে রয়েছে। সিপিডি বলেছে, অর্থনৈতিক সংস্কার জরুরি। তবে এ বছর তা এগোবে না সঙ্গতকারণেই। তার পক্ষ থেকে রক্ষণশীল আর্থিক ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় পরিমিতি, শৃংখলা ও স্বচ্ছ¡তা বিধানে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে আমরা আশা করি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন