Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঝন্টুর ভরাডুবি নগরবাসীর মুখে উল্লেখযোগ্য ৪ কারণ

রসিক নির্বাচন নিয়ে নগরজুড়ে চলছে বিশ্লেষণ

হালিম আনছারী, রংপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও এখনও নগর জুড়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে নজিরবিহীন ভোট আর সাবেক মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর শোচনীয় পরাজয়ের বিষয়টি নিয়ে। অফিস-আদালত, দোকান-পাট, পাড়া-মহল্লা সর্বত্রই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে সাবেক মেয়র ঝন্টুর ভরাডুবির বিষয়টি। বিশেষ করে ঝন্টুর বিশাল ভোটের ব্যবধানে মোস্তফার কাছে পরাজয়ের বিষয়টি সবখানেই সরব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তার এই শোচনীয় পরাজয়ের পেছনে বিভিন্ন জন বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করলেও কমবেশি সকলে ব্যক্তি ঝন্টুকেই দায়ী করছেন। দায়ী করছেন তার দুর্ব্যবহার, ক্ষমতার দাপট, অহমিকা, দুর্নীতি, নগর উন্নয়নে ব্যর্থতা ও দলীয় সমন্বয়হীনতাকে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র ঝন্টুর শোচনীয় পরাজয়ের কারন হিসেবে আওয়ালীগের একাধিক নেতাকর্মী ও নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে মুলতঃ ৪টি কারনই সবার মুখে উঠে এসেছে। এর মধ্যে নগরবাসীর সাথে তার অসদাচারন-দুর্ব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতি, নগরের উন্নয়নে ভুমিকা না রাখাই উল্লেখযোগ্য।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীর সাথে কথা হলে তারা জানান, মুলতঃ তার দুর্বব্যবহার নগর উন্নয়নে ব্যর্থতা এবং দুর্নীতির কারনেই ভরাডুবি হয়েছে। এখানে আওয়ামীলীগের পরাজয় হয়নি। হয়েছে ব্যক্তি ঝন্টুর। কেননা, তিনি যে ভোট পেয়েছেন তা আওয়ামীলীগের। বরং তার আচরণ, দলীয় নেতাকর্মীদের অবমুল্যায়ন দলীয় সমন্বয়হীনতার কারণে আওয়ামী লীগের ভোটের একটি অংশ অন্য প্রতীকে গেছে। দলের অনেকেই ক্ষোভে ভোট দিতেও যায়নি।
অনিয়ম-দুর্নীতি
সচেতন নগরবাসীর অনেকেই জানিয়েছেন, বিগত ৫ বছর মেয়র পদে থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন তিনি। প্রায়ই মানুষের সাথে খারাপ আচরণ ও মুখ খারাপ করে কথা বলেছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের কোনদিনও মুল্যায়ন করেননি। নগর উন্নয়নে কোন ভুমিকা রাখেননি। ভুমিকা রেখেছেন কাগজে-কলমে। নগরীর প্রতিটি রাস্তা-ঘাট যার স্বাক্ষী হিসেবে পড়ে আছে। কাগজে-কলমে উন্নয়ন, বিলবোর্ড আর ডকুমেন্টরী তৈরী করে নগরবাসীকে দেখালেই উন্নয়ন হয় না। মানুষ এখন অনেক সচেতন। ব্স্তাবতা বোঝে। তার আমলে নগরীর উন্নয়ন ছিল কাগুজে-কলমে। কিছু ড্রেন নির্মান ছাড়া আর কোন কাজই হয়নি।
টেন্ডার ছাড়া কোটি কোটি টাকার কাজ করা, স্বজনদের নামে বেনামে কোটি কোটি টাকার কাজ দেয়া, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না নিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দুই শতাধিক ব্যক্তিকে চাকরি প্রদানের অভিযোগ রয়েছে সাবেক মেয়র ঝন্টুর বিরুদ্ধে। এতে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেয়া হয়নি। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া গোপনে সম্পন্ন করা হয়। এসব অভিযোগে ইতিমধ্যে দুদক সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন বিভাগের অনেক জব্দ করেছে।
অভিযোগ আছে, রংপুর নগরীর চিকলী বিনোদন কেন্দ্রে টেন্ডার আহŸান না করেই প্রায় ৫ কোটি টাকার অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন ঝন্টু। কোনও নিয়ম নীতি ছাড়াই বিগত ৫ বছরে বিনোদন কেন্দ্রটি নিজস্ব কর্মচারীদের দিয়ে পরিচালনা করেছেন তিনি।
ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করার জন্য দুদক এর প্রধান কার্যালয়ের উপ পরিচালক আব্দুস ছোবহানকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনেক ফাইল জব্দ করে নিয়ে গেছেন। তদন্ত এখনও চলছে। এছাড়াও তার আস্থাভাজন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্র জানিয়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার
বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিগত ৫ বছর মেয়র পদে থাকাকালীন ঝন্টুর কাছে কেউ কোনও সমস্যা নিয়ে গেলে তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করা হতো। স্থানীয়দের অভিযোগ বা আবেদনের কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দেয়া, যাকে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দেয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সিনিয়র-জুনিয়র কিছুই দেখতেন না, মুখে যা আসতো, তাই বলে গালাগাল দিতেন। অফিস কক্ষ থেকে বের করে দিতেন। এ বিষয় নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে নগরবাসীর। অপমান-অপদস্ত হওয়ার আশঙ্কায় তার কাছে কেউ যেতে চাইতেন না। এসব কারণে নগরবাসী ঝন্টুর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।
জেলা আওয়ামীলীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জানিয়েছেন, ঝন্টুর খারাপ আচরণের কথা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেই তিনি অশোভন আচরণ করতেন। তার বাসায় দেখা করতে গেলে নিজস্ব লোক ছাড়া কখনই দেখা করতেন না। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে মিডিয়ায় বলে দিয়েছেন, ঝন্টুর পরাজয়ের অন্যতম কারণ হলো সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার খারাপ আচরণ ও অনিয়ম-দুর্নীতি।
নগরের উন্নয়নে ব্যর্থ
সিটি কর্পোরেশনের অনেকেরই মতে, নগর উন্নয়নে বিগত ৫ বছরে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন সাবেক মেয়র ঝন্টু। নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক ছাড়াও বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার অধিকাংশ রাস্তাই দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে থাকলেও তিনি ৫ বছরে সেগুলো সংস্কারের কোনও উদ্যোগ নেননি। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনে নতুন করে যুক্ত হওয়া ১৮টি ওয়ার্ডে একটি বাতিও লাগানো হয়নি। ফলে ওই সব এলাকার পৌনে ২ লাখ ভোটার তার ওপর ছিলো রুষ্ট।
অভিযোগ, রংপুর নগরীর প্রধান সড়ক জাহাজ কোম্পানি সড়ক, রেলওয়ে স্টেশন সড়ক, তাজহাট সড়ক, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সড়কসহ নগরীর বেশিরভাগ সড়কের বেহাল দশা হলেও বিগত ৫ বছরেও ঐসব সড়ক সংস্কারে কোনও পদক্ষেপ নেননি।
রংপুর নগরীর বেহাল ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নে কিছুটা কাজ হলেও সেগুলো পরিকল্পিত না হওয়ায় কাজে আসছে না। নগরীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত ঐতিহাসিক শ্যামা সুন্দরী খাল বেদখল হয়ে ক্রমেই তা ড্রেনে পরিণত হলেও এ বিষয়ে কোনও উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পাশাপাশি যানজট নিরসনেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেছেন, সিটি নির্বাচনে ঝন্টুর পরাজয়ের জন্য ঝন্টুই দায়ী, আওয়ামী লীগ দায়ী নয়। এখানে আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়নি হয়েছে ঝন্টুর। তার অতীত কর্মকাÐের জন্য ভোটাররা তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যে ৬২ হাজার ভোট তিনি পেয়েছেন এটা ওনার ভোট নয়, নৌকার ভোট। ভোটাররা নৌকাকে ভালোবেসেই এই ভোট দিয়েছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর রংপুর জেলা শাখার নেতৃস্থানীয় একজন বলেছেন, সাবেক মেয়র ঝন্টুর ক্ষমতার অপব্যবহার আর নগরবাসীর প্রতি খারাপ আচরণের যোগ্য জবাব দিয়েছেন ভোটাররা।
দলীয় সমন্বয়নহীনতা
সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হলেও ৫ বছর মেয়র পদে আসীন থাকার সময় কোনদিনই দলীয় কার্যালয়ে আসেননি কিংবা দলের কোনও কর্মসূচিতে অংশ নেননি। মেয়র থাকাকালীন দলের নেতাকর্মীদের কোন সহায়তা বা মুল্যায়ন করেননি। দলের সিনিয়র নেতারাও তার কাছে কোনদিন কোন মুল্যায়ণ পাননি। এ কারণে দলের নেতাকর্মীরাই তাকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মন থেকে গ্রহণ করেননি। নির্বাচনে প্রার্থীতা চূড়ান্ত হওয়ার আগে বিভিন্ন পর্যায়ের ১৮ জন নেতা মেয়র পদে নির্বাচন করার জন্য প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রার্থী ও জেলা ও মহানগর নেতাদের ডেকে ঝন্টুকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়ার ঘোষণা দেন এবং সবাইকে তার পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দেন। তখন যারা মেয়র প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন তারা হতাশ হয়ে ফিরে আসেন। অবশ্য দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর ঝন্টু জেলা আওয়ামী লীগের সভায় নিজেই উপস্থিত হয়ে নির্বাচনে তাকে সহায়তার আহŸান জানান এবং তার ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চান। কিন্তু তিনি সাধারণ নেতাকর্মীদের মন গলাতে পারেননি।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মÐল বলেন, যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। যদি নেতাকর্মীদের কাছে, সর্বোপরি নগরবাসীর কাছে গ্রহনযোগ্য কোনও ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়া হতো, তবে ফলাফল অন্যরকম হতো।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর পরই জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা ঝন্টুর বাসভবনে নির্বাচনে প্রচারণাসহ বিভিন্ন কর্মকাÐ সম্পন্ন করার জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব দেন। কিন্তু ঝন্টু তাতে সায় না দিয়ে একক সিদ্ধান্তেই সবকিছু করেন। এমন কি ঝন্টু কখন কোথায় গণসংযোগ করবেন তাও ঠিকমত দলীয় নেতাদের জানানো হতো না। ফলে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগে ২/৪ জন নেতা ছাড়া জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীই উপস্থিত থাকতেন না। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ভোটের দিন কোন ভোট কেন্দ্রে কারা পোলিং এজেন্ট থাকবেন, কারা ভোট কেন্দ্রে থাকবেন এসব ব্যাপারেও কোনও পরিকল্পনা করা হয়নি। এসব কাজ একক ভাবে ঝন্টু নিজেই করেছেন। যার ফলশ্রæতিতে নির্বাচনের দিন ৪০টি কেন্দ্রে তার কোনও পোলিং এজেন্ট ছিল না। মূলত ঝন্টু দলীয় নেতাকর্মীদের চাইতে নিজের লোকদের ওপরই বেশি আস্থাশীল ছিলেন। যে কারনে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। এমনকি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনও ইশতেহারও ঘোষণা করা হয়নি। এসব কারনেই এবারের নির্বাচনে তার ভরাডুবি হয়েছে।

 

 



 

Show all comments
  • ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১:১৬ পিএম says : 0
    ঝনটু হারলো এবং লাঈল পাস করল মোস্তফার গুন গুলো কেউ লিখলেনা
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রংপুর সিটি

২১ ডিসেম্বর, ২০১৭
২০ ডিসেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ