Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অনিরাপদ বোতলজাত পানি

| প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকতে হলে নিরাপদ সুপেয় পানি এবং ভেজাল ও দূষণমুক্ত খাদ্য অপরিহার্য শর্ত। বলাবাহুল্য, আমাদের নাগরিক জীবনে সুস্থ্য ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার এই অপরিহার্য শর্তের কোনটিই পুরণ হচ্ছেনা। একদিকে ভেজাল ও বিষযুক্ত খাবার অন্যদিকে দূষিত পানির শিকার হয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ নানাবিধ রোগাক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। বিশেষত: ঢাকা শহরে ব্যাপকহারে পানিবাহিত রোগের শিকার হওয়ার পেছনে রয়েছে একদিকে ঢাকায় পানি সরবরাহের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসার মাননিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা অন্যদিকে এই ব্যর্থতার সুযোগে বেড়ে ওঠা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারের মান নিয়ন্ত্রনে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারির ব্যর্থতা। একসময় ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি নগরবাসি সরাসরি পান করলেও এখন ঢাকা শহরের বেশীরভাগ এলাকায় তা’ নানাভাবে পরিশোধন করেও পানযোগ্য করা যাচ্ছেনা। তীব্র র্দুগন্ধ এবং বিষাক্ত সব বায়োকেমিকেল মিশ্রিত হয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় শহরের অফিস আদালত, হোটেল-রেস্তোঁরা থেকে শুরু করে ফুটপাতের চায়ের স্টল পর্যন্ত বোতলজাত ও জারের পানির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বোতলজাত ও জারের পানি আপাত:দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ মনে হলেও এসব পানির বেশীরভাগই নিরাপদ বা বিশুদ্ধ নয়। সাম্প্রতিক এক গবেষনায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে সরবরাহকৃত জারের পানির শতকরা ৯৮ ভাগেই মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ই-কোলি ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
দেশের কয়েক কোটি মানুষ কিডনি সমস্যা, হেপাটাইটিস, ক্রনিক ডিসেন্ট্রির মত রোগে আক্রান্ত। সেই সাথে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ডায়রিয়ার মত জরুরী স্বাস্থ্য সংকটে পতিত হচ্ছে। এসবই পানিবাহিত স্বাস্থ্য সমস্যা। বাসা বাড়িতে ব্যবহার্য ও পানীয়ের সাথে সিসা,নাইট্রেট, আর্সেনিক, ক্রোমিয়ামসহ নানা ধরণের ভারী শিল্পবর্জ্য, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের উপস্থিতি আমাদের জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করছে। ঢাকা শহরের কোথাও কোথাও ওয়াসার পানির লাইন ৫০-৬০ বছরের পুরাতন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহর চারপাশে অপরিকল্পিতভাবে ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও দুই কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেই। প্রায় ৩০০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে ওয়াসা সরবরাহ করছে প্রায় ২০০ কোটি লিটার। অর্থাৎ পানির ঘাটতি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তবে যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে তার মান এবং যে পানি সরবরাহ করতে ওয়াসা ব্যর্থ হচ্ছে তার বিপরীতে সুপেয় পানির ঘাটতি মেটাতে বোতলজাত পানির যে রমরমা বাণিজ্য চলছে সে পানির মান নিয়েই এখন যত প্রশ্ন। ওয়াসার মত প্রতিষ্ঠান ঢাকার নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানির যোগান দিতে পারছেনা। আবার সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিএসটিআই’র মত মাননিয়ন্ত্রণকারি সংস্থাগুলো বাজারজাত কারি বোতলজাত পানির স্বাস্থ্যসম্মত মান নিশ্চিত করার কোন কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না।
সরকারী একটি প্রতিষ্ঠানের আওতায় পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষনায় ঢাকার ২৪টি পয়েন্ট থেকে ২৫০টি পানির জার এবং ৩৫টি বোতলজাত পানির নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রায় সবগুলোর জারের পানিই পানের জন্য অনিরাপদ বা দূষণযুক্ত। অর্থাৎ ওয়াসা বা নলক‚পের পানিকে প্রয়োজনীয় পরিশোধন না করেই জারে ভরে নিরাপদ পানি বলে বিক্রি করা হচ্ছে। একজন নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পানির মত এতো জরুরী একটা বিষয়ে যে গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল তা এখানে দেখা যায়না। অথচ কলম্বোর মত শহরে প্রতিদিন তিনবার সরকারীভাবে পানি পরীক্ষা করে দেখা হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। একদিকে নগর কর্তৃপক্ষ বা ওয়াসার মত প্রতিষ্ঠান নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা, অন্যদিকে বেসরকারী উদ্যোগে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে স্থাপিত ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বা সরবরাহকৃত পানির মান রক্ষায়ও সরকারী সংস্থাগুলোর কোন মাথাব্যথা নেই। এর ফলে একদিকে স্বাস্থ্যখাতে দরিদ্র মানুষের সংকট ে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে,অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতে সরকারী ব্যয়ও বাড়ছে। মানুষ অর্থব্যয় করে দূষিত পানি পান করছে। অথচ সরকার প্রতি বছর স্বাস্থ্যখাতে যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে, তার একটা বড় অংশই ব্যয়িত হয় পানি বাহিত রোগের পেছনে। শুধুমাত্র নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং পানি ব্যবহারে জনসচেতনতা বাড়ানো সম্ভব হলে স্বাস্থ্য সমস্যা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। গবেষনায় ঢাকা নগরীর চিত্র বেরিয়ে এলেও দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। একদিকে নদ-নদীর পানি পরিশোধনের অনুপযোগি হয়ে পড়ছে, ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হওয়ার কারণে সর্বত্রই দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। ওয়াসার পানির সরবরাহ লাইনগুলো সংস্কার ও নিরাপদ করার পাশাপাশি নদ-নদীর পানিতে শিল্পদূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। নিরাপদ পানির নামে দূষিত-ক্ষতিকর পানি সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে এবং পানির সব উৎসের ওপর মনিটরিং এবং মান নিয়ন্ত্রণের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি উদ্যোগে জার বা বোতলজাত পানি সরবরাহের বাণিজ্যিক উদ্যোগ নিতে হবে।



 

Show all comments
  • Md.Emran chowdhury ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১০:১১ এএম says : 0
    তাহলে নিরাপদ পানির কি কোন সমাধন নাই ? যেমন ফুটানো পানি -
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন