Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

নির্বাচনের পর চীনের আরো কাছাকাছি হচ্ছে নেপাল

আল জাজিরা | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এটা ছিল নেপালের নির্বাচনের বছর। ৩১ জানুয়ারি নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ শরণ মাহাত কাঠমান্ডু ভিত্তিক দূতদের কাছে অঙ্গীকার করেন যে তার দেশ এক বছরের মধ্যেই তিনটি নির্বাচনের সব ক’টিই অনুষ্ঠিত করবে- স্থানীয়, প্রাদেশিক ও সংসদীয়। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে মাহাত নিজে হেরে গেছেন এবং তা নেপালি কংগ্রেস পার্টি হতাশাজনক ফল করেছে। তবে সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তার অঙ্গীকার রক্ষার সাফল্য প্রদর্শন করেছে। তিন পর্যায়ের নির্বাচনে প্রথম স্থানীয় কর্মকর্তা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর অনুষ্ঠিত হয় দু’ ধাপের প্রাদেশিক পরিষদ ও সংসদের নিম্নকক্ষের নির্বাচন ।
পর্যায়ক্রমের এ নির্বাচন সমগ্র সরকারী যন্ত্র ও ২ লাখেরও বেশি নিরাপত্তা কর্মীকে এ কাজে জড়িত রাখে। নেপালের ইতিহাসে এ ছিল সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচন। এর ফলে বছরের বেশির ভাগ সময় সরকার জনগণের দুর্দশা নিরসনের জন্য কিছুই করতে পারেনি। সুশাসন স্থবির হয়ে গিয়েছিল, দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়, উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং সরকার সব কিছুর উপরে নির্বাচনকে প্রাধান্য দেয়ায় ভ‚মিকম্প থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন ব্যাপক ভাবে উপেক্ষিত হয়।
নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে মোটামুটি ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। বাম জোট নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য লাভ করে।
কম্যুনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ঐক্যবদ্ধ মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট, ইউএমএল) ও দি কম্যুনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওয়িস্ট সেন্টার) নিয়ে গঠিত বাম জোট হচ্ছে পরিস্থিতির সুযোগে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক পরিণয়। তারা কোনো কার্যকর কর্মসূচি নিয়ে আসতে পারেনি এবং শুধু উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বপ্ন দেখানো শ্লোগানের উপর নির্ভর করেছে।
সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী ও ইউএমএল প্রধান খড়গ প্রসাদ শর্মা অলি ১৯৭০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত সন্নিহিত ঝাপায় তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। সে সব দিনে চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, চীনের পথ আমাদের পথ ইত্যাদি ম্লোগান পশ্চিমবঙ্গের বাতাসে ধ্বনিত হত। তবে অলি সংশোধনবাদের পথ গ্রহণ করেন এবং ১৯৯০-এর দশকে উগ্র জাতীয়তাবাদী বুলি আশ্রয় করেন।
মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দাহাল ওরফে প্রচন্ড জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন। ২০০০ সালে তার বুলি হয়- আমি সংশোধনবাদ ঘৃণা করি। আমি সংশোধনবাদের সাথে কখনো আপোস করি না। ধারণা করা হয় যে পছন্দমত সময়ে সংশোধনবাদীদের সাথে যোগ দিতেই তিনি এ নাটক করেন।
রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় ’৭০-এর দশকে মাওবাদী মটো প্রকৃত চীনা চেয়ারম্যান ও চীনের পথে পরিণত হয।
পাকিস্তান ও শ্রীলংকার সাথে নেপালও চীনের ওযান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবর) উদ্যোগে যোগদান করে। মাওপন্থী যুগল অলি ও প্রচন্ড আশা করছেন যে তারা আন্তঃহিমালয় রেলপথ ,পানি বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণের জন্য যথেষ্ট চীনা অর্থ আকর্ষণ করতে পারবেন ও গোটা নেপালের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে উত্তরপশ্চিম মুখী করবেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সময়ে মার্শাল প্ল্যান ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে যা করেছিল ওবর সে রকম নয়। ওবর মহাপরিকল্পনার লক্ষ্য সাহায্যের পরিবর্তে বাণিজ্য এবং যে সব ঋণ রেয়াতি সুদে দেয়া হবে তা পরিশোধ করতে হবে। যেমন শ্রীলংকা তা বুঝতে পেরেছে হাম্বানটোটা বন্দরকে চীনের কাছে ৯৯ বছরের লিজ দেয়ার সময়। ঋণ লাভের জন্য প্রয়োজন আর্থিক সক্ষমতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা।
পানি বিদ্যুতের সম্বাব্য সম্ভাবনা ছাড়া নেপালের মত একটি ভ‚মিকম্প প্রবণ অঞ্চলে বিনিয়োগে উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। নেপালের রফতানিযোগ্য প্রমাণিত সম্পদ খুব কম। মধেশের সমভূমিতে নির্বাচকরা বামজোটকে ব্যাপক ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
নেপালের অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ বিদেশের মাটিতে পরিশ্রমের ঘাম ঝরানো অদক্ষ ও অল্পদক্ষ শ্রমিকের রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল। বিদেশের উপর নির্ভরশীল একটি অর্থনীতির সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা হয়ত ভ‚রাজনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে বেশি কিছু নয়। ভারত যদি তার ঐতিহ্যবাহী প্রভাব বলয় রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় সেক্ষেত্রে নেপালের বাম জোটের মহাপরিকল্পনার উপর সাঁড়াশির চাপ অনুভ‚ত হতে পারে।
১৯৬০-এর দশকে নেপালের রাজকীয় শাসকরা চীন ও ভারত থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখতেন। এ ধারণার পুনরুজ্জীবনের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর হচ্ছেন মাওবাদী কট্টরপন্থী সি পি গাজুরেল। এ ক্ষেত্রে একটি বড় রকম সমস্যা আছেঃ বেইজিং ও নয়া দিল্লী থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখা ভৌগোলিক ভাবে ঠিক নয়, সাংস্কৃতিক ভাবে বেখাপ্পা, অর্থেৈনতিক ভাবে অসমর্থনীয়, রাজনৈতিক ভাবে অনাকাক্সিক্ষত এবং নেপালের রাজা জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতায় থাকার সময় যা আবিষ্কার করেছিলেন তা হল ক‚টনৈতিক ভাবে বিপর্যয়কর।
সোভিয়েতরা কিউবার জন্য যা করেছিল বা ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আমেরিকানরা যা পশ্চিম জার্মানির জন্য করেছিল, চীনারা যদি নেপালের জন্য সে রকম কিছু করার সিদ্ধান্ত না নেয় তাহলে ভারতের বন্দরগুলো নেপালের লাইফ লাইন হিসেবে থেকে যাবে। ভারত ও নেপালের মধ্যে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও সামাজিক নৈকট্য মানে এক বিপুল সংখ্যক গরীব নেপালি স্থায়ী বা সাময়িক চাকুরির জন্য ভারতের দিকে চেয়ে থাকে। নয়াদিল্লী কোনো প্রতিরোধ ছাড়া তার পিছন দিকে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করবে বলে মনে হয় না।
দক্ষিণের সমতল ভূমি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। নেপালের রাজনীতিতে মধেশ সমভূমির গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। সেখানে নাগরিকত্ব, অন্তর্ভুক্তি, প্রতিনিধিত্ব, স্বায়ত্ত শাসন, মর্যাদা ও ভাষা সমস্যার সমাধান হয়নি। এখন নেপালে নির্বাচন হয়ে গেছে। ফলাফলও প্রকাশিত হয়েছে। তবে বিতর্কিত সংবিধান এখনো তার প্রথম পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়নি। নেপালি কংগ্রেসের দাবি যে নয়া সরকার গঠনের আগেই উচ্চকক্ষের নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সাংবিধানিক বিভ্রান্তি জোরালো হওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট এ নিয়ে আলোচনা করছেন।
মধেশিদের মত অন্য প্রান্তিক গ্রুপগুলো যেমন মুসলিম, আদিবাসী জনজাতি গ্রুপ ও দলিতরা এ নির্বাচনের ফলাফল থেকে বুঝতে পেরেছে যে নির্বাচনে কে লড়াই করল তা বিষয় নয়, অভিজাত সমাজ, সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়, আমলাতন্ত্রের পদস্থরা, ধনকুবের ব্যবসায়ীরা ও হিন্দু পুরোহিতসহ নেপালের স্থায়ী প্রতিষ্ঠান (পিইওএন) যারা আঠারো শতক থেকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নেপালের শাসনভার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে তারাই সর্বদা শেষে জয়ী হয়। উত্তরমুখী ভ‚রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া এ দেশে বেশি কিছু পরিবর্তন হতে যাচ্ছে না।



 

Show all comments
  • তানিয়া ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৩:৪৯ এএম says : 0
    ভালোই হবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ