Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চীনের নৌঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উদ্বেগ

গোয়াদরের উন্নয়নে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ

রয়টার্স : | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পাকিস্তানের একটি ছোট মাছ ধরার শহর গোয়াদর। এখানকার লোকদের মন জয় ও একটি গভীর পানির সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতে চীন বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সন্দেহ যে এ বন্দর একদিন চীনা নৌবাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
আরব সাগরে প্রসারিত একটি বন্দর সম্বলিত ধলি ধূসরিত গোয়াদর শহরে চীন একটি স্কুল নির্মাণ করেছে ও ডাক্তার পাঠিয়েছে।
তারা এখানে একটি বিমান বন্দর, হাসপাতাল, কলেজ ও জরুরি প্রয়োজন পানি অবকাঠামোর জন্য মঞ্জুরি হিসেবে প্রায় ৫০ কোটি ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। আরব সাগর জাহাজযোগে বিশে^র সবচেয়ে ব্যস্ততম তেল ও গ্যাস পরিবহন লেন।
চীনা মঞ্জুরির মধ্যে রয়েছে একটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নির্মাণের জন্য ২৩ কোটি ডলার। গবেষক ও পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের মতে, বিদেশে চীনের বৃহৎ বিনিয়োগগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
গোয়াদর প্রকল্পটি অন্যান্য দেশে বেইজিং-এর সচরাচর কর্মকান্ডের ব্যতিক্রম। চীন পাশ্চাত্য ঋণদান পদ্ধতির বদলে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ঋণ দেয়ার পক্ষে যা সাধারণত চীনা মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে দেয়া হয়।
চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক বিষয়ক একটি গ্রন্থের লেখক ও ওয়াশিংটন ভিত্তিক জার্মান মার্শাল ফান্ড থিংক ট্যাংকের গবেষক অ্যান্ড্রু স্মল বলেন, চীনা মঞ্জুরির কেন্দ্রীভবন রীতিমত বিস্ময়কর। তিনি বলেন, চীন ব্যাপক ভাবে সাহায্য বা মঞ্জুরি দেয় না এবং যখন সে তা দেয় উদারভাবেই দেয়।
পাকিস্তান খোলামেলা ভাবে এ সাহায্যকে স্বাগত জানিয়েছে। এদিকে বেইজিং-এর অস্বাভাবিক বদান্যতা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সন্দেহে ইন্ধন যুগিয়েছে এ ভাবে যে গোয়াদর মার্কিন নৌ প্রাধান্যের প্রতি চীনের ভবিষ্যত ভ‚কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ।
স্মল বলেন, সব কিছু এ কথাই বলে যে চীনের বহু লোকের কাছেই গোয়াদর দীর্ঘমেয়াদে শুধু বাণিজ্যিক পরিকল্পনা নয়।
বার্তা সংস্থা রয়টারস এ ব্যাপারে মন্তব্যের জন্য চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করলেও তারা কোনো সাড়া দেয়নি।
বেইজিং ও ইসলামাবাদ গোয়াদরকে চীন-পাকিস্তান অর্থেৈনতিক করিডোরের (সিপিইসি) মুকুটে ভবিষ্যতের রতœ হিসেবে দেখে। সিপিইসি এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার ৬০টিরও বেশি দেশে স্থল ও নৌ পথে এক নতুন সিল্ক রোড নির্মাণের বেইজিং-এর বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের প্রধান প্রকল্প।
গোয়াদরকে আন্ত্ঃ জাহাজ চলাচল কেন্দ্র ও মেগাপোর্ট হিসেবে রূপান্তরের পাশাপাশি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে যেখান থেকে রফতানি ভিত্তিক শিল্পগুলো তাদের পণ্য বিশ^ব্যাপী সমুদ্রপথে বিশ^ব্যাপী প্রেরণের সুযোগ পাবে। জ¦ালানি পাইপ লাইন, সড়ক ও রেলপথের একটি নেটওয়ার্ক গোয়াদরকে চীনের পশ্চিম অঞ্চলের সাথে যুক্ত করবে।
গোয়াদরের বন্দর বাণিজ্য ২০১৮ সালে ১.২ মিলিয়ন টন থেকে ২০২২ সালে ১২ মিলিয়ন টনে উন্নীত হবে বলে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা জানান। বন্দরে ৩টি নতুন ক্রেন স্থাপন করা হয়েছে এবং ৫টি বার্থে আগামী বছরে ড্রেজিং করে বন্দর গভীরতা ২০ মিটার করা হবে।
কিন্তু গোয়াদরের ক্ষেত্রে রয়েছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। গোয়াদরে খাবার পানি সহজ প্রাপ্য নয়, বিদ্য্রুত বিচ্ছিন্নতা সাধারণ বিষয় এবং বিদ্রোহীরা গোয়াদরে চীনা প্রকল্পগুলো ও বালুচিস্তানে হামলার হুমকি দিচ্ছে।
সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর। চীনা ও অন্যান্য বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সৈন্য ও আর্মড পুলিশের কনভয় বেষ্টিত হয়ে চলাচল করে। বেইজিং বালুচিস্তানে বিদেশীদের অবিশ^াস দূর করার চেষ্টা করছে। বহু অধিবাসীই বলছেন, তার গতি খুব ধীর।
গোয়াদরের এক আইন প্রণেতা এসার নুরী বলেন, স্থানীয় মানুষ সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট নয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের অসন্তোষে ইন্ধন যোগাচ্ছে।
পাকিস্তানি কর্মকর্তারা গোয়াদরের অধিবাসীদের ধৈর্য ধরার আহবান জানিয়ে লবণমুক্তকরণ কারখানা ও বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের অঙ্গীকার করেছেন।
সতর্কতামূলক কথা
চীনের গোয়াদর প্রকল্প শ্রীলংকার অনুরূপ প্রকল্পের বিপরীত ধর্মী যেখানে হাম্বানটোটা গ্রামকে একটি বন্দর কমপ্লেক্সে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তবে তা চীনা ঋণে।
গত সপ্তাহে শ্রীলংকা আনুষ্ঠানিক ভাবে হাম্বানটোটা বন্দরের পরিচালনভার সহহজ ঋণ পরিশোধের বিনিময়ে ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে হস্তান্তর করেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে শ্রীলংকায় রাস্তায় বিক্ষোভ হয়েছে। বহু শ্রীলংকানই একে সার্বভৌমত্বের প্রতি আঘাত বলে মনে করে।
গোয়াদরের মত হাম্বানটোটাও এশিয়া ও আফ্রিকায় চীনের বন্দর নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার অংশ যা ভারতের জন্য উদ্বেগজনক। ভারত চীনের ক্রমবর্ধমান নৌশক্তি দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়ার আশংকা করছে।
তবে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বলছেন, হাম্বানটোটার সাথে গোয়াদরের তুলনা করা অনুচিত। কারণ গোয়াদর প্রকল্পে ঋণের পরিমাণ অনেক কম।
গোয়াদরে চীনারা বিমান বন্দর ছাড়াও একটি হাসপাতাল ২৫০ শয্যায় সম্প্রসারণে ১০ কোটি ডলার, পানি অবকাঠামো উন্নযনে ১৩ কোটি ডলার এবং একটি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক কলেজের জন্য ১ কোটি ডলার ব্যয় করবে।
গোয়াদর বন্দরসহ সিপিইসির তদারকি পার্লামেন্টারি কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর মুশাহিদ হোসেন সৈয়দ বলেন, চীন ও পাকিস্তান সিপিইসির আওতায় কোন কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সে বিষয়ে যৌথ খভাবে সিদ্ধান্ নেবে।
চীন গোয়াদরের নতুন বিমান বন্দরের জন্য ৭ হাজার মিটার দীর্ঘ রানওয়ের কথা বলে। কিন্তু পাকিস্তান ১২ হাজার মিটার রানওয়ের জন্য চাপ দেয় যাতে এয়ারবাস ৩৮০ও নামতে পারে এবং তা সামরিক উদেএশ্যও ব্যহার করা যায়।
২০০০-২০১৪ সময়কালে ১৪০টি দেশে চীনা অর্থ সহায়তা বিষয়ে তথ্য সংগ্রাহক যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক রিসার্চ ল্যাব এইডডাটা’র নির্বাহী পরিচালক ব্রাড পার্কসের মতে, চীনা সাহায্যের পরিমাণ নজিরবিহীন।
২০১৪ সাল থেকে বেইজিং এক লাখ জনসংখ্যার গোয়াদরের জন্য মঞ্জুরি ও রেয়াতি ঋণ হিসেবে ৮০ কোটি ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করে। এর আগে ১৫ বছরে ২০ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার সমগ্র পাকিস্তানের জন্য চীন প্রায় ২৪০ কোটি ডলার রেয়াতি ঋণ ও মঞ্জুরি দেয়।
পার্কস বলেন, পাকিস্তানে চীনের অতীত কর্মকান্ডের মানদন্ডে গোয়াদর ব্যতিক্রম।
হৃদয় ও মন
প্রাথমিক লক্ষণ থেকে দেখা যাচ্ছে হৃদয় ও মন জয়ের চীনা উদ্যোগ গোয়াদরে ফল দিতে শুরু করেছে। সালাম দাশতি (৪৫) বলেন, বালুচিস্তান পশ্চাদপদ ও অনুন্নত , কিন্তু চীনারা আসার পর আমরা উন্নতি দেখতে পাচ্ছ্ িতার দ’ু সন্তান চীনের নির্মিত স্কুলে পড়ে।
কিন্তু সামনে বড় ধরনের সমস্যা আছে। হাজার হাজার লোককে পুনর্বাসন করতে হবে। এখন তারা একটি সংকীর্ণ উপদ্বীপে একতলা কংক্রিট নির্মিত বাড়িতে বাস করছে। খালি পা জেলেরা তাদের ধরা মাছ এনে নতুন তৈরি হওয়া আবর্জনা ভরা রাস্তায় গাদা করে। বহু জেলেই বন্দর চালু হলে তাদের জীবিকা হারানোর ভয় করছে।
আগামী দশকগুলোতে গোয়াদরের জনসংখ্যা ১৫ গুণ বাড়বে বলে স্থানীয় অধিবাসীরা অনিবার্য ভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার আশংকা করছে। শহরের প্রান্তে বালিয়াড়ির পাশাপাশি জমি ব্যবসায়ীদের নির্মাণ করা ভবন দৃষ্টি কাড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিরাপত্তা সমস্যার কারণে গোয়াদর বন্দরের আগের উন্নয়ন চেষ্টাগুলো ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণে চীন বালুচিস্তানকে শোষণ করতে চাইছে বলে বিদ্রোহীদের এ ধারণা বেইজিং নিরসনের চেষ্টা করছে।
পার্কস বলেন, এ ধারণা চীনের উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে। এটা প্রায় নিশ্চিত সত্য যে তারা স্থানীয়দের মন জয় করে তাদের বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে চাইছে।
ইসলামাবাদে চীনা দূতাবাসের উপ মিশন প্রধান ফিজিয়ান ঝাও গত মাসে টুইটে বলেন যে প্রতিদিন আপনি নতুন পরিবর্তন দেখতে পাবেন। এটা গোয়াদরের উন্নয়নে চীনাদের আন্তরিকতাকে প্রদর্শন করে।
নৌ সুবিধা
পাকিস্তানকে বন্দরটি ফেরত দেয়ার আগে গোয়াদরে বিনিয়োগের জন্য চীন আগামী চল্লিশ বছর পর্যন্ত বন্দরের ৯১ শতাংশ রাজস্ব লাভ করবে। বন্দর পরিচালনাকারী চায়না ওভারসিজ পোর্টস হোল্ডিং কোম্পানি ২০ বছরেরও বেশি সময় বড় ধরনের কর আরোপ থেকে মুক্ত থাকবে।
পাকিস্তানের নৌ বিষয়ক মন্ত্রী হাসিল বিজেঞ্জো বলেন, এ অঞ্চলে চীনাদের উপস্থিতি গত দু’শ বছরের অভিজ্ঞতার বিপরীত যখন রাশিয়া ও ব্রিটেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পারস্য উপসাগরের উষ্ণ পানির বন্দরগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
তিনি রয়টারসকে বলেন যে চীনারা খুব মসৃণ ভাবে এখানে এসেছে , তারা উষ্ণ পানির বন্দরে পৌঁছেছে। তারা যা বিনিয়োগ করছে তা উষ্ণ পানির বন্দরে পৌঁছার জন্য একটি চীনা বাদামের চেয়েও কম।
জুনে যখন পেন্টাগনের এক রিপোর্টে বলা হয় যে গোয়াদর চীনের একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হতে পারে, যে উদ্বেগ ভারতও ব্যক্ত করেছে, বেইজিং তা বাতিল করে দিয়েছে।
চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র উ সিয়ান বলেন, চীন পাকিস্তানে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করছে এ একেবারেই অনুমান নির্ভর কথা।
বিজেঞ্জো ও অন্য পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বলেন, চীন নৌ উদ্দেশ্যে গোয়াদর ব্যবহার করার কথা বলেনি। তিনি বলেন, বন্দরটি মূলত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হবে। তবে আগামী ২০ বছরে বিশ^ কোথায় যায় তার উপর সব নির্ভর করছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চীন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ