Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

২৪ ঘণ্টা সেবায় সাড়া কম

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমস দিনরাত সচলে সমন্বয়ের অভাব : সীমিত অবকাঠামো : দ্রুত পণ্য খালাসে নির্বিকার বন্দর ব্যবহারকারীরা
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম সচল রাখা হয়েছে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। বন্দর-নির্ভর দেশের একক বৃহৎ রাজস্ব জোগানদার প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসেও সার্বক্ষণিক (২৪/৭) কাজকর্ম চালু রাখা হয়েছে। বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে সেবার মান বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ্য ও রাজস্ব আহরণকে গতিশীল করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বিগত ১ আগস্ট থেকে বন্দর ও কাস্টমস সার্বক্ষণিক সচল রাখা হয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের আছে নানামুখী সমস্যা আর সীমাবদ্ধতা। এর মাঝেও সাধ্যমতো সেবা প্রদান করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে প্রধান সমুদ্রবন্দর ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এই সার্বক্ষণিক সেবা-পরিসেবার প্রতি বাস্তবে সাড়া মিলছে কম। সেবাগ্রহীতা তথা স্টেক হোল্ডারগণ (বন্দর ব্যবহারকারীরা) দিনের বেলায় সেই আগের মতোই ‘অফিস টাইম’ বেছে নিয়ে বন্দর ও কাস্টমসে ভিড় করছেন। অথচ সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি সংশ্লিষ্ট শাখা, দপ্তর ও ব্যাংকগুলো খোলা রাখা হলেও দেখা যাচ্ছে ওই সময় প্রায় ফাঁকা। শুক্রবার ও শনিবার সেবাগ্রহীতাদের আগমন খুবই কম। সার্বক্ষণিক (২৪/৭) বন্দর-কাস্টমস সচলের কার্যক্রম চালুর পর গত ৪ মাসের বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে সেবাগ্রহীতারা এ ব্যাপারে তেমন ব্যাপকভাবে আগ্রহী এবং অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারছেন না।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং কাস্টম হাউস দিনরাত সচলের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সেবাপ্রদান ও গ্রহণকারী সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, বিভাগ বা প্রতিষ্ঠান, সংগঠন-সমিতিগুলোর মধ্যকার কার্যকর সমন্বয়ের অভাব রয়ে গেছে। তদুপরি বন্দরের পণ্যসামগ্রী বিশেষত কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী যান্ত্রিক সরঞ্জাম ও অবকাঠামো সুবিধা প্রকৃত চাহিদার তুলনায় খুবই সীমিত বা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। যা বন্দরের দৈনন্দিন অপারেশনাল কার্যক্রমকে ভোগাচ্ছে। বন্দরের গতি, সেবার মান ও দক্ষতার উপর পড়ছে এর বিরূপ প্রভাব। সেই সঙ্গে বন্দরে পণ্যসামগ্রী খালাস দ্রæতায়নে বন্দর ব্যবহারকারীদের ঢিলেমি এখনও কাটেনি। এতে করে জট সৃষ্টি হচ্ছে কম আর বেশিমাত্রায়।
বন্দরে এ মুহূর্তে পণ্য হ্যান্ডলিং সহজতর করার জন্য অত্যাবশ্যকীয় প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত একাধিক কন্টেইনার টার্মিনাল, ইয়ার্ড স্থাপন এবং যন্ত্রপাতি সংগ্রহের প্রক্রিয়া ধীরগতিতে তথা জটের মুখে পড়েছে। সম্প্রতি সাউথ কন্টেইনার ইয়ার্ড চালু করা হয়েছে। পতেঙ্গা টার্মিনালের কাজও শুরু হয়েছে। কিছু কিছু যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। কিন্তু কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের মতো বেশকিছু ভারী সরঞ্জামের ঘাটতি, লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল, বৃহৎ কন্টেইনার অবকাঠামো প্রস্তাবিত ‘নতুন বন্দর’ বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ঝুলে আছে। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে বন্দরে আসছে না প্রত্যাশিত গতি, দক্ষতা ও সেবার মান। যান্ত্রিক ও অবকাঠামো সুবিধার অনেক কিছুই জরাজীর্ণ ও পুরনো হওয়ার কারণে ক্ষেত্র বিশেষে কাজ চালানো হচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে।
চট্টগ্রাম বন্দরে গতবছরে আমদানি-রফতানিমুখী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৪ লাখ টিইইউএস’রও বেশি। এক্ষেত্রে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ১৪ শতাংশ। যা বছর বছর বজায় আছে। শিপিং বাণিজ্যে কন্টেইনার পরিবহনের নির্ভরতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে অত্যাবশ্যকীয় ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম এবং কন্টেইনার টার্মিনাল, ইয়ার্ডসহ অবকাঠামো সুবিধা চাহিদার তুলনায় সীমিত হয়ে এসেছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতা, বন্দর ব্যবস্থাপনায় মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ এবং কতিপয় অদক্ষ কর্মকর্তার কারণে ও ভিশনের অভাবে বন্দরের সুষম উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারের স্বাভাবিক ধারণক্ষমতা এখন প্রায় ৪২ হাজার টিইইউএস। অথচ অনেক সময়ই ধারণক্ষমতা উপচে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শিপিং সার্কেলে প্রচলন হচ্ছে, সাধারণত কোন সমুদ্র বন্দরে স্বচ্ছন্দে স্বাভাবিক গতিতে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অন্তত ৩০ শতাংশ ধারণক্ষমতা ও অবকাঠামো খালি রাখার বিধি-বিধান অনুসরণ করা হয়। ‘আঙ্কটাড’ ও বিভিন্ন পোর্ট-শিপিং কনভেনশনে তা অনুসরণীয়। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যবাহী ও খালি কন্টেইনার অনেক সময়ই জমে ওঠে ধারণক্ষমতার কাছাকাছি এমনকি উপরে।
প্রধানমন্ত্রীর নতুন নির্দেশনার পর চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টম হাউসের কার্যক্রম বিগত ১ আগস্ট থেকে সার্বক্ষণিক সচলের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সবার আশাবাদ ছিল ধীরে ধীরে সবকিছুই বদলে যাবে। অথচ শুক্রবার ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটিসহ সন্ধ্যায় ও রাতের বেলায় কাস্টমসে হলরুমে, বিভিন্ন সেকশনে শুল্কায়ন ফাইল ছাড়করণের জন্য স্বাভাবিক হাঁকডাক ও তাড়াহুড়া নেই। গুটিকয়েক সেবাগ্রহীতা আসেন, সেবা নিয়ে ফিরে যান। কিন্তু দিনের বেলায় অফিস সময়ের মতো ভিড় ও ব্যস্ততা চোখে পড়ে না। বন্দর ও কাস্টমসের শত বছরের ইতিহাসে এই প্রথম নতুন নিয়মের ধারায় অভ্যস্ত করে তোলার ক্ষেত্রেও সেবাদানকারী ও গ্রহীতাদের মাঝে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা-সঙ্কট, চেইন ওয়ার্কের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু সমন্বয়ের অভাব, কাস্টমসের জনবলের প্রকট ঘাটতি এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ডিজিটাল বা আইটি খাতের প্রযুক্তিগত দুর্বলতা- প্রভৃতি বাধা-বিপত্তি রয়ে গেছে। এতে করে সার্বক্ষণিক বন্দর ও কাস্টম হাউস সচল রাখতে হোঁচট খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। শুল্কায়ন প্রক্রিয়া প্রত্যাশা অনুসারে দ্রæতায়িত ও গতিশীল করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিগত ২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবদের সভায় ১৭টি দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। এরমধ্যে শীর্ষে ছিল দেশের আদমানি-রফতানি বাণিজ্য গতিশীল করার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সপ্তাহের পুরো সাতদিন ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার লক্ষ্যে অত্যাবশ্যকীয় নির্দেশনা। পরে বিগত ৭ জুলাই থেকে নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে শুক্র ও শনিবার সচল রাখা হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা চলছে কাস্টমস কার্যক্রম।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসে সেবাদানের পরিধি ও গতি আরো প্রসারিত করে বৈদেশিক বাণিজ্য বেগবান করার পথে বেশকিছু সমস্য এবং সমন্বয়হীনতা রয়ে গেছে। শুধুই বন্দর ও কাস্টমস কাগজে-কলমে দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় না। এরসাথে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভাগ ও সংস্থার কাজকর্ম ওতপ্রোত জড়িত। যেমন- কোয়ারেন্টাইন বিভাগ, আনবিক শক্তি কমিশন, বিএসটিআইসহ অনেকগুলো সংস্থার ধাপে ধাপে পরীক্ষণ কিংবা ডকুমেন্টের ভিত্তিতে ছাড়পত্র পাওয়া সাপেক্ষেই আমদানি-রফতানি প্রবাহ ত্বরান্বিত করা সম্ভব। কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে নৌবাহিনীর ছাড়পত্রও প্রয়োজন হয়। ফলে সবগুলো সংস্থার কাজ একই ছাতার নীচে নিয়ে আসা অপরিহার্য। যা বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক বন্দরে ওয়ানস্টপ সার্ভিস হিসেবে গুরুত্বের সাথে পরিচালিত হয়।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসকে আরো গতিশীল, জনবান্ধব ও সেবামুখী আধুনিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে ১৫টি বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা চিহ্নিত করে তা নিরসনের জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক সমন্বয় সভায় সুপারিশ করা হয়। এরমধ্যে ছিল- চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমসের অপারেশনাল সমস্যা সমাধানে সকল পক্ষকে নিয়ে একটি ‘পোর্ট-কাস্টমস অপারেশনাল কমিটি’ গঠন করে কাজকর্ম গতিশীল করা, পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানি নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সার্বক্ষণিক বন্দর-কাস্টমস ছাড়াও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা ও সকাল ৯টা থেকে সবার উপস্থিতি নিশ্চিত করা, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের জনবল ঘাটতি দ্রুত সময়ের মধ্যে নিরসন, কাস্টম হাউসেসের এসাইকুডা প্লাস প্লাস-এর ঘন ঘন বিভ্রাট স্থায়ীভাবে দূরীভূত করে এর সাথে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো (অফডক), বন্দরের কন্টেইনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিটিএমএস) এবং সব ইপিজেডকে সংযুক্ত করে আনা, দ্রুত পণ্য খালাসে সৎ ও স্বনামধন্য ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করে ‘গ্রিন চ্যানেল পদ্ধতি’ চালু, এলসি খোলার সময় যাবতীয় বিবরণ লিপিবদ্ধ করা, জরুরি ভিত্তিতে বন্দরের সব গেটে স্ক্যানিং মেশিন স্থাপন ইত্যাদি। অথচ আজও এসব সুপারিশের সুরাহা মিলেনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ