হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? দেশবাসীর এই বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। বিগত নয় বছরে অসংখ্য অপকীর্তি করার পর এবার তারা বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের শরীরে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়ার অপচেস্টায় মেতেছে। গত ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষনা করেছে যে, সারা দেশের সমস্ত হাই স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি তথা শাখা গঠন করা হবে। প্রেসনোটে বলা হয়েছে যে, স্কুল ছাত্রদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়াই হবে হাই স্কুলসমূহে ছাত্রলীগের শাখা গঠনের উদ্দেশ্য। সংবাদটি সব ধরনের মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। এই সংবাদটি শোনার পর সর্ব শ্রেণীর অভিভাবক তথা মানুষের মাঝে প্রচন্ড আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। অসংখ্য মানুষ প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে প্রশ্ন করছেন যে, দেশের যুব সমাজ এবং আগামী দিনের কান্ডারীদের ধ্বংস করার সময় কি এসে গেল?
প্রায় প্রতিদিনই ছাত্রলীগের খবর ছাপা হয় । প্রতিটি খবরই লোম হর্ষক । সকলেই আশংকা করছেন যে, সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে হত্যা, খুন এবং ধর্ষণের যে মহাপ্লাবণ শুরু হয়েছে সেটি কি মাধ্যমিক স্কুলের কোমলমতি ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হবে? ছাত্রলীগের দৌরাত্মে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতেও ছাত্র রাজনীতি প্রায় এক দলীয় হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের বি-টিম কমিউনিস্ট পার্টি ও রাশেদ খান মেননের লেজুড় দুটি ছাত্র সংগঠন ছাড়া অবশিষ্ট বড় দুটি ছাত্র সংগঠনকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে গায়ের জোরে বিতাড়িত করা হয়েছে। ছাত্রলীগকে কেন্দ্র করে যে খবরটিই ছাপা হয় সেটিই হয় খারাপ খবর। ভালো খবর এবং ছাত্রলীগ পাশাপাশি যায়না। কোনো এক ছাত্রকে বেদম প্রহার করা হয়েছে। কারণটি কি? কারণটি হলো সে ছাত্রলীগের হুকুম মানে নাই। কোনো এক ছাত্র বা যুবক সংঘর্ষে মারা গেছে। কারণটি কি? কারণটি হলো ছাত্রলীগের উপদলীয় কোন্দল।কোনো একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে প্রহার করা হয়েছে। কারণটি কি? কারণটি হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঐ শিক্ষকটি ন্যায্য অবস্থান নিয়েছিলেন। প্রশাসন সরকারের পদলেহী । ছাত্রলীগ হলো সরকারের লাঠিয়াল। সুতরাং ঐ শিক্ষকটির বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ হামলে পড়েছে। একটি আস্ত শ্রেণীকক্ষ ভাংচুর করা হয়েছে। কারণটি কি? কারণটি হলো, ছাত্ররা পরীক্ষা পেছাতে চায়। কিন্তু প্রশাসন পেছাবে না। অতএব প্রশাসনের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী হিসেবে সাধারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে গেছে ছাত্রলীগ । প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। নাটের গুরু কে? নাটের গুরু ছাত্রলীগের একজন কেউকেটা।
আমি পরিসংখ্যানের ভারে আপনাদের ভারাক্রান্ত করতে চাই না। তারপরও আপনাদেরকে ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। এই সরকারের আমলে অর্থাৎ বিগত আট বছরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ সমূহে ছাত্রদের মধ্যে মারামারিতে নিহত হয়েছে ১২৫ জন। এদের মধ্যে শুধু মাত্র ছাত্রলীগের উপদলীয় কোন্দলে নিহত হয়েছে ৬০জন। যদি ছাত্রলীগের শাখা খোলার কারণে এই খুনাখুনি এবং রক্তারক্তির লোমহর্ষক ঘটনা বাংলাদেশের আনুমানিক সাড়ে ১৮ হাজার হাই স্কুলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে বছরে কত শত খুনাখুনির বা রক্তারক্তির ঘটনা ঘটতে পারে সেটা আপনারাই অনুমান করুন। যে চাঁদাবাজি এখন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাদের বড়লোক হওয়ার প্রধান উৎস সেই চাঁদাবাজি এখন কোমলমতি হাই স্কুলের অষ্টম নবম বা দশম শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে।
খবরের কাগজে আপনারা পড়ছেন যে, ইদানিং ভাড়াটিয়া খুনিদেরকে দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য বা শত্রæ বা প্রতিদ্ব›িদ্বদেরকে খুন করা হয়। দেখা যাচ্ছে যে, এসব পেশাদার বা ভাড়াটিয়া খুনির অনেকেরই বয়স ১৬ থেকে ২০ বছর। একেকজন পেশাদার খুনিকে নাকি ১০ থেকে ২০ লক্ষ টাকা দেওয়া হয় । এখন হাই স্কুল গুলোতে ছাত্রলীগের শাখা খুলে তরুণ খুনি গড়ার কারখানা তৈরি করা হচ্ছে কি না সেটাও অবিভাবকদেরকে ভেবে দেখতে হবে। ছাত্রলীগের দেখাদেখি অন্যান্য ছাত্র সংগঠনও যদি স্কুলসমূহে শাখা খোলার প্রতযোগিতায় লিপ্ত হয় তাহলে স্কুল লেভেলের পড়াশোনা যে কোন রসাতলে নিক্ষিপ্ত হবে সেটি একমাত্র আল্লাহই মালুম । এর পর প্রতিটি দলের শাখা কমিটির মধ্যে যদি উপদলীয় কোন্দল শুরু হয় তাহলে ভিন দেশের কুরুক্ষেত্র বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হবে।
দুই
ছাত্রলীগ বলছে যে তারা নাকি হাই স্কুলে ছাত্রলীগের শাখা গঠন করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার করবে। সেটি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ। জাতির স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান এর জীবনী, বিভিন্ন সময়ে তার আন্দোলন, তার বক্তৃতা ও বাণী, সাতই মার্চের ভাষণ- এগুলোতো স্কুল লেভেলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে এবং স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত পড়ানো হচ্ছে। ্এরপর আবার তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কি আদর্শ প্রচার করবে? দেশের প্রতিটি মানুষই আশংকা করছে যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচারের নামে ছাত্রলীগ স্কুল লেভেলেও যেটা করবে সেটা হলো, শেখ মুজিবকে দলীয়করণ। ইতিমধ্যেই আওয়ামীলীগ শেখ মুজিবকে শতকরা একশত ভাগ দলীয়করণ করেছে। এখন যদি স্কুল লেভেলেও তাকে দলীয়করণ করা হয় তাহলে আমাদের আশংকা হয় যে, অন্যান্য দলও তাদের নেতাকে মহিমান্বিত করার চেস্টা করবে। কেউ করবে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে, কেউ করবে শহীদ জিয়াউর রহমানকে, কেউ করবে অন্য কাউকে । এভাবে নিজ নিজ নেতাকে মহিমান্বিত করার প্রতিযোগিতায় সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিতর্কিত হয়ে পড়েন কি না সেটির আশংকা প্রবলভাবে থেকে যায়।
এখানে আরেকটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং মূল্যবান প্রশ্ন এসে যায়। স্কুল লেভেলের ছাত্রদের মতো যাদের মন এবং মগজ কাঁদা-পানির মতো হয়ে থাকে তাদের মস্তিষ্কে কি রাজনীতির পোকা ঢোকানো উচিত? তার চেয়ে বড় কথা হলো, ছাত্রদের কি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত হওয়া উচিত? আগে আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন ছাত্রনেতারা বলতেন যে, আমরা কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক নেতার লেজুড় নই। আমরা শুধু ছাত্রদের ন্যায্য দাবি দাওয়া নিয়ে সংগ্রাম করবো। কিন্তু তখন থেকেই আমরা লক্ষ্য করলাম যে, মুখে যতই রাজনীতি নিরপেক্ষতার কথা বলা হোক না কেন, বাস্তবে সবগুলো দলই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়। যেমন (১) ছাত্রলীগ হলো আওয়ামীলীগের লেজুড় (২) ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ছিল মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির লেজুড়। তবে এখন তারা ভারত পন্থী। (৩) ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ছিল পিকিং পন্থি ভাসানী ন্যাপের লেজুড়। তবে এখন তারা ভারত পন্থী । এখন স্কুল লেভেলে যদি এসব ছাত্র সংগঠন শাখা বিস্তার করে তাহলে স্কুল লেভেলের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যেও আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াত পলিটিকস ঢুকে পড়বে।
ছাত্রলীগকে এই সর্বনাশা পথ থেকে নিবৃত্তির উপায় কি ? এখনও সরকারী ক্ষমতার জোরে হোক আর পেশি শক্তির জোরে হোক, ছাত্রলীগই বাংলাদেশের সমস্ত স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান শক্তি। আমলা তন্ত্র ও পুলিশ প্রশাসনের ছায়ার তলে বসে তারা সবগুলো স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে। যদি স্কুলে ছাত্রলীগের শাখা খোলা হয় তাহলে তারা আনুমানিক সাড়ে ১৮ হাজার স্কুলের ওপর ছড়ি ঘুরাবে। এই সরকার যদি স্কুল এবং কলেজে দলীয় রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেয় তাহলে স্কুল লেভেলে ছাত্রলীগের শাখা খোলাও বন্ধ থাকবে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছে ছাত্রলীগ একটি মহা মূল্যবান বস্তু। খালেদার সভায় হামলা করা বা অন্য বিরোধী দলের নেতার সভা বানঞ্চাল করা অথবা প্রতিদ্ব›দ্বী কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীকে মেরে তক্তা বানাতে হবে- এত্তেলা দাও ছাত্রলীগকে। ঝটিকা বাহিনী নিয়ে মূহুর্তের মধ্যেই সব ঠান্ডা করে আসবে। সুতরাং আওয়ামী লীগ কোনো অবস্থায় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে না। সে জন্যই দেখা যাচ্ছে যে, সর্বত্রই ছাত্রলীগের সাত খুন মাফ।
এই মূহুর্তে যেটি প্রয়োজন সেটি স্কুল লেভেলে ছাত্রলীগের শাখা খোলা নয়। এই মূহুর্তে সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন বাংলাদেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে ছাত্রদের কেন্দ্রীয় সংস্থার নির্বাচন অনুষ্ঠান। সর্বাগ্রে শুরু করতে হবে ডাকসুর নির্বাচন দিয়ে। এটি কল্পনারও বাইরে যে আজ থেকে ২৭ বছর আগে ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন) সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারপর ২৭ বছর পার হয়েছে। ১৯৯১ সালে দেশে বহু দলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র এসেছে। যারা সব সময় গণতন্ত্রের পাইওনিয়ার সেই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয় দলই একাধিকবার দেশের সরকার গঠন করেছে। প্রত্যেক দল এবং তাদের সরকার ডাকসু নির্বাচন অপরিহার্য বলে বয়ান দিয়েছেন। কিন্তু ২৭ বছরে কোনো সরকারই ডাকসু নির্বাচন দেননি।
অথচ এই তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না এরা সকলেই ডাকসুর প্রোডাক্ট। এরা সকলেই ছাত্র আন্দোলনের প্রোডাক্ট। আমানুল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খোকন, জিয়া উদ্দিন বাবলু, সুলতান মোহাম্মাদ মনসুর, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রমূখ সকলেই ডাকসুর প্রোডাক্ট। নূরে আলম সিদ্দিকী, আখতারুজ্জামান, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি প্রমূখ ছাত্র আন্দোলনের প্রোডাক্ট। তৃণমূল থেকে শুরু হয় রাজনীতি। তারপর ছাত্র আন্দোলন। তারপর রাজনৈতিক দল তথা রাজনৈতিক নেতা। ভারতেও আজ যারা রাজনৈতিক নেতা, সে বিজেপি, কংগ্রেস বা তৃণমূল, যে দলেরই হোক না কেন, সকলেই তৃণমূল থেকে রাজনীতির মাধ্যমে উঠে এসেছেন।
সেই ট্র্যাডিশন শুরু করতে হবে, এবং অবিলম্বেই। স্কুল লেভেলে ছাত্রলীগের শাখা খোলা অরাজকতার জন্ম দেবে, কোন সমাধান দেবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।