হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
এক অধৈর্য্য অসহিষ্ণু পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সেদিন দেখা গেল সাংবাদিক সন্মেলনে। গত ২৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মন্ত্রীকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কত দিনের মধ্যে শেষ হবে? উত্তরে এক রুষ্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কোন টাইম ফ্রেম দেওয়া যায় না। এরকম কোনো টাইম ফ্রেম দিয়ে লাভও নাই। এই প্রত্যাবাসন চুক্তির কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা আছে কি না, তেমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, আইন থাকলেও কি, বা না থাকলেও কি? আইনতো যখন তখন লঙ্ঘন করা হয়। এই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে কি না, তেমন এক প্রশ্নে মন্ত্রী বিরক্ত হন। বলেন, এটি নাকি একটি হাস্যকর প্রশ্ন। তিনি বলেন, গোটা পৃথিবী একদিকে, আর আপনারা বলেন, এটা কোন চুক্তিই হয়নি। এরপর মন্ত্রী যেটা বলেন, সেটি শুনে তো উপস্থিত সাংবাদিকদের এবং সেই সাথে অন্যদেরও আক্কেল গুড়–ম। এটি জাতীয় স্বার্থ বিরোধী হয়েছে কিনা, তার উত্তরে রাগত স্বরে মন্ত্রী বলেন, জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হলো কিনা, সেটি কে ঠিক করবে? সেটিতো ঠিক করবে সরকার। সরকারই ঠিক করবে, কোনটি জাতীয় স্বার্থের অনুক‚লে আর কোনটি জাতীয় স্বার্থ বিরোধী।
আগেই বলেছি, মন্ত্রীর এই উত্তরে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। জাতীয় স্বার্থ কিসে রক্ষিত হবে সেটি যদি এককভাবে সরকারের এখতিয়ার হয় তাহলে সেখানে জনগণের ভূমিকা কি? মন্ত্রী উল্টা বলেছেন। সংবিধানে বলা আছে যে, দেশের সার্বভৌমত্ব ন্যাস্ত রয়েছে জনগণের হাতে। জনগণই দেশের মালিক-মোক্তার। সেই জনগণকে তিনি মোটেই পাত্তা দিলেন না। আর দেবেন কীভাবে? সারা জীবন তিনি তো ছিলেন একজন আমলা। চাকরি থেকে রিটায়ার করে তিনি এমন একটি সংসদের এমপি হয়েছেন যেটি আবার বিনা ভোটের সংসদ। ২০১৪ সালের যে নির্বাচনে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সেই সংসদ নির্বাচনে দেশের ১৫ শতাংশ মানুষও ভোট দেয়নি। অনুরূপভাবে তিনিও ১৫ শতাংশের বেশি ভোট পাননি। সুতরাং যে কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনা করুন না কেন, তিনি জনগণের প্রতিনিধি নন। কাজেই জনগণের মনের কথা তিনি বুঝবেন কীভাবে? তিনি তো একাই ১৬ কোটি জনগণের প্রতিনিধি সেজে বসে আছেন।
\দুই\
সংবাদ সন্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী আরেকটি মারাত্মক কথা বলেছেন। এই কথাটি না শুনলে বিশ্বাস হতে চায়না যে যিনি বলছেন তিনি কি বাংলাদেশের মন্ত্রী? নাকি মিয়ানমারের মন্ত্রী? পররাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ মাহমুদ আলী বলেছেন, মিয়ানমারের ইচ্ছে অনুযায়ীই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৯২ সালের চুক্তি মিয়ানমার অনুসরণ করতে চেয়েছিল। সেভাবেই চুক্তিটি করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফিরিয়ে নেয়া। এতে ত্রæটি-বিচ্যুতি আছে কি নাই, এটা নাই সেটা নাইÑএসব বলে লাভ নাই। স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী গত ৯ অক্টোবর ২০১৬ এবং ২৫ আগস্ট ২০১৭ এর পরে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী বাস্তচ্যুত রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের ফেরত নেবে মিয়ানমার। মন্ত্রী বলেন, ফিরিয়ে নেয়ার কোন টাইমফ্রেম দেয়া যায় না। প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার হলো, এরকম কোনও টাইমফ্রেম দিয়ে কোনও লাভও নেই। শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সাংবাদিক সন্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত এই চুক্তি হওয়ার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, ১৯৯২ সালের ওই চুক্তি অনুসরণযোগ্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। সরকারের প্রায় সমস্ত মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতারা এক সুরে বলেছেন যে, শেখ হাসিনার পাঁচ দফার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করতে হবে। তারা আরো বলেছেন যে, জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনানের সুপারিশমালা মোতাবেক এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো সেখানে তাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবিও মানা হয়নি, আবার কফি আনানের সুপারিশও অনুসরণ করা হয়নি। শেখ হাসিনার প্রথম দাবি ছিল, মিয়ানমারকে নিঃশর্তে সহিংসতা এবং জাতিগত নিধন অবিলম্বে এবং চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে এই দাবি উত্থাপন করেছিলেন গত ২১ সেপ্টেম্বর। এটি দু’মাস আগের ঘটনা। এ দু’মাসে রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং জাতিগত নিধন বন্ধ হয়নি। তিনি চেয়েছিলেন যে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব অবিলম্বে রাখাইনে একটি অনুন্ধানী টিম পাঠান। সেই টিম তো দূরের কথা, কোন টিমকেই রাখাইনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তার তৃতীয় দাবি ছিল, মিয়ানমারের সব ধর্মের এবং নৃতাত্বিক জাতিগোষ্ঠীকে রক্ষা করা হোক। এজন্য জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে মিয়ানমারের একটি নিরাপদ অঞ্চল গঠন করা হোক। সেই প্রস্তাব সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে। অপর দাবি ছিল, কফি আনানের রিপোর্ট অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে বাস্তবায়ন করা হোক। সবশেষে দাবি ছিল, তারা যে ফেরত যাবে সেটি যেন স্থায়ী হয়।
\তিন\
কফি আনানের রিপোর্টে ছিল, রাখাইন মুসলমানদের নাগরিকত্বকে বিভিন্নভাবে যাচাই বাছাই করা, আইনের চোখে তাদের অবাধ চলাচল, তাদেরকে অন্যান্য নাগরিকের মত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়া ইত্যাদি। লক্ষ করার বিষয় এই যে কফি আনান কমিশনের রিপোর্টে প্রধান ফোকাস ছিল নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব। এই নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয় ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে। তখন ছিল বার্মায় সামরিক আইন। ক্ষমতায় ছিলেন সেনা প্রধান জেনারেল নে উইন। দেখা যাচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান- কারো দাবি বা সুপারিশ বা রিপোর্টকে এই চুক্তিতে মোটেই পাত্তা দেয়া হয়নি। নাগরিকত্বের ইস্যুটির ধারে-পাশে যাওয়া হয়নি। বার্মায় ফিরে গেলে তাদের ওপর আবার যে পাশবিক অত্যাচার, জুলুম, ধর্ষণ, খুন, অগ্নিসংযোগ এবং গণহত্যা চালানো হবে না, তার কোন নিশ্চয়তা এই চুক্তিতে নেই। তাহলে কার স্বার্থে এই চুক্তি করা হলো? এই চুক্তি করা হয়েছে মিয়ানমারের স্বার্থে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিক সন্মেলনে বলেছেন যে, কোন চুক্তি বাংলাদেশের স্বার্থে যাচ্ছে কি না, সেটি কে দেখবে, সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না। চুক্তি বা কোন বিষয় বাংলাদেশের স্বার্থে গেল কিনা সেটি দেখবে জনগণ। এই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। রক্ষিত হয়েছে বার্মা এবং ভারতের স্বার্থ।
\চার\
১৯৯২ সালে যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় তখন বাংলাদেশের অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন মাহমুদ আলী, যিনি আজ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি এই সমস্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন। কিছুদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনিই তো বলেছেন যে, ১৯৯২ সালের চুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। সেই চুক্তি ইতোমধ্যেই বাতিল হয়ে গেছে। তাছাড়া তখনকার পরিস্থিতি এবং এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। মাহমুদ আলী জানেন যে সমস্যার মূলটি কোথায়। সেই মূলটি হলো রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং তাদের প্রতি জাতিগত বৈষম্য। এই দুটি বঞ্চনার অবসান চেয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা। এবং এ কারণেই ১৯৭৮ সাল থেকে বার বার রোহিঙ্গাদের ওপর বর্মী শাসক গোষ্ঠির হিং¯্র হামলা হয়েছে এবং তাদেরকে রাখাইন তথা বার্মা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এই সমস্যার সমাধান যতদিন না হবে ততদিন রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এই জাতিগত নিধন এবং গণহত্যা চলতেই থাকবে। এই বিষয়টি আমাদের মত সাধারণ মানুষ যদি বুঝতে পারে তাহলে মাহমুদ আলীর মত আজীবন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট এবং ফরেন সার্ভিসের লোক কেন বুঝবেন না সেটা আমরা বুঝতে অক্ষম।
এখন যেটি ঘটল সেটি মিয়ানমারের প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার শামিল। ইচ্ছে হলো আর রোহিঙ্গা মুসলমানদের মেরে কেটে, ধর্ষণ করে, লুটপাট করে এবং ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে তাদের বিতাড়িত করা হবে। আবার ইচ্ছে হবে তাদের মর্জি মত ফেরত নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে আবার তাড়িয়ে দেওয়া এবং ফেরত নেওয়ার এই ছেলেখেলা কতদিন চলবে?
এ কথা সত্য যে, চীনা প্রস্তাবে সমস্যার মূল চিহ্নিত করা হয়নি। বার্মার সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে তারও কোনো উল্লেখ নেই তার তিন দফা ফর্মুলায়। বলা বাহুল্য, চীন এবং ভারতের মধ্যে অনেক বৈরিতা থাকলেও রোহিঙ্গা মুসলমান প্রশ্নে দুইটি দেশই মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে। এটি যেমন সত্যি, তেমনি এটিও সত্যি যে আমেরিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় এই ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের সমালোচনা করেছে। জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই বর্মী সামরিক জান্তার এই বর্বর জুলুমকে জাতিগত নিধন, গণহত্যা এবং মানবতা বিরোধী অপরাধ বলে কঠোর সমালোচনা করেছে। যারা এই মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে তাদেরকে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে যথাযোগ্য ট্রাইব্যুনালে বিচারের দাবি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই দাবি যখন ক্রমশই জোরদার হচ্ছিল ঠিক তেমন একটি সময় এই ধরনের একটি অর্থহীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। এটি এমন একটি বিষয় যাকে খোদ দুইটি দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারও চুক্তি বলছে না। তারা এটাকে সমঝোতা স্মারকও বলছে না। তারা এখন বলছে যে, এটা নাকি একটি ব্যবস্থা বা অ্যারেঞ্জমেন্ট। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রোহিঙ্গা সংকটের মতো একটি গভীর সংকটে কোন চুক্তি না করে, কোন সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর না করে একটি ব্যবস্থা করে ৭/৮ লাখ লোককে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়ার মতো ব্যবস্থার কথা কেউ কোনদিন শোনেনি।
এর ফলে লাভ হলো কার? যখন মিয়ানমার তিনটি দেশ বাদে সারা দুনিয়ার ধিক্কার কুড়াচ্ছে, যখন নোবেল বিজয়ী সু চির নিন্দায় সারা বিশ্ব ছিঃ ছিঃ করছে, যখন বার্মার জেনারেল এবং সিনিয়র সেনা অফিসারদের যুদ্ধাপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার আওয়াজ জোরদার হচ্ছে, তখন কোন চুক্তি না করে এই ব্যবস্থা সম্পাদিত হলো। ফলে মিয়ানমারের জাতিগত নিধন, গণহত্যা এবং মানবতা বিরোধী অপরাধ চাপা পড়ল, সু চির ধুলায় লুণ্ঠিত ভাবমর্যাদা আবার নতুন করে উজ্জ্বল হওয়ার সুযোগ পেল এবং বর্মী হানাদার জেনারেলরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর জিল্লতি থেকে মুক্তি পেল।
আর বাংলাদেশ? ১৬ কোটি লোকের দেশ হওয়া সত্তে¡ও, লাখ লাখ শহীদের দেশ হওয়া সত্তে¡ও এবং মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য ধারণ করা সত্তে¡ও আত্মসমর্পণ করল সেই বার্মার কাছে যাদের জনসংখ্যা মাত্র ৬ কোটি, যাদের নেই মার্শাল রেসের কোনো ঐতিহ্য। সেই বীর বাঙ্গালী আজ মগ হার্মাদদের দস্যুতা এবং ক‚ট প্যাঁচের কাছে প্রচন্ড মার খেল।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।