ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
৭১২ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। যার ধারাবাহিকতায় জড়িত রয়েছে প্রায় দেড় হাজার বছরের নানা ইতিহাস, কাহিনী। সেনাপতি মোহাম্মদ বিন কাসেম এ দিন সিন্ধু দেশে পৌঁছেন এবং সিন্ধু জয় করে ভারতে সর্বপ্রথম ইসলামী রাষ্ট্র স্থাপন করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়স্ক সেনাপতি বিন কাসেম তার স্বল্পকালীন শাসনামলে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এক বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন এবং সকলের মুখেই ছিল তার নাম এবং সেখান হতে বিদায় নিয়ে যাওয়াকালে হিন্দুরা পর্যন্ত কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এবং তাকে দেবতা বলে আখ্যায়িত করেছিল।
উপমহাদেশের ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে সিন্ধু অভিযানের পটভূমিকা ও পরিণতির বিশদ বিবরণ রয়েছে এবং মুসলমানদের এ গৌরবময় অভিযানকে বিকৃত করার প্রবণতাও যুগে যুগে প্রত্যক্ষ করা গেছে। সেনাপতি বিন কাসেম কেন সিন্ধু অভিযানে বের হয়েছিলেন তা ইতিহাস পাঠকের জানা আছে। নিম্নে আমরা অতিসংক্ষেপে বিন কাসেমের সিন্ধু অভিযানের কাহিনী ও হিন্দুদের দেবতা বিন কাসেমের ভূমিকা কথা স্মরণ করতে চাই।
ইসলামের গোড়ার দিকে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগটি বাদ দিলে উমাইয়া আমলকে দেশ বিজয়ের দিক দিয়ে স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। বিশেষতঃ আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের যুগ ও তার পরবর্তী কিছুকাল। এই সময়ে বিশ্বের এক বিরাট এলাকা মুসলমানদের দখলে আসে। বাবুল ইসলাম বা ইসলামের প্রবেশদ্বার নামে খ্যাত বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধু প্রদেশ ও মুসলমানদের সেই বিজয় অভিযানের অন্যতম নিদর্শন। এই সিন্ধু প্রদেশের মধ্য দিয়েই ইসলাম বিস্তারের স্রোতোধারা সূদুর চীন পর্যন্ত পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছিল। সিন্ধু রাজ্যে যে মহাপ্রতাপশালী রাজার অত্যাচার-নির্যাতনে স্থানীয় অধিবাসীরা অতিষ্ঠ হয়ে আসছিল তার নাম রাজা দাহির।
পৌত্তলিকরাজ দাহিরের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয় উমাইয়া শাসনকর্তা ওয়ালীদ ইবনে আবদুল মালেকের আমলে। ওয়ালীদের নির্দেশে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ পরপর দুইটি অভিযান দাহিরের বিরুদ্ধে পরিচালনা করে ব্যর্থ হলেও তৃতীয় অভিযানে মুসলমানরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেন। এই অভিযানের প্রধান সেনাপতি ছিলেন হাজ্জাজের ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা বীর মোহাম্মদ ইবনে কাসেম। তার বয়স হয়েছিল তখন মাত্র ১৭ বছর।
এই অভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ হিন্দুস্তানীয় জলদস্যু কর্তৃক একখানা আরব জাহাজ লুণ্ঠনকে কেন্দ্র করে। কথিত আছে যে, কিছুসংখ্যক মুসলমান বণিক সিংহলের লঙ্কা উপদ্ধীপে বসতি স্থাপন করে সেখানে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। তাদের মধ্য হতে একজন মুসলমান ইন্তেকাল করলে সিংহলের তৎকালীন রাজা উক্ত মুসলমানদের পরিবার-পরিজনকে একখানা জাহাজযোগে আরবের দিকে প্রেরণ করেন। মতান্তরে রাজা স্বয়ং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ আটটি জাহাজ ভর্তি মূল্যবান উপঢৌকন খলীফা ওয়ালীদ ও হাজ্জাজের নিকট প্রেরণ করেন। ঐ জাহাজযোগে সিংহলে বাণিজ্যরত আরব বণিকগণের স্ত্রী-পুত্র কন্যারাও স্বদেশে ফিরছিল। জাহাজগুলি বোম্বাই উপকূল ছেড়ে সিন্ধুর দেবল ও মাকরান উপকূল অতিক্রমকালে সিন্ধুর জলদস্যু কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়। দুর্বৃত্তগণ নারী ও শিশুদের উপরও অত্যাচার চালায় এবং তাদের আটক করে রাখে। জানা যায় যে, গ্রেফতারের সময় একজন মহিলা চিৎকার করে বলতে থাকে যে, হে হাজ্জাজ, আমাদেরকে সাহায্য কর। হাজ্জাজের নিকট এই ঘটনার খবর পৌঁছলে তার চোখ দিয়ে রক্তাশ্রু নির্গত হতে থাকে এবং তিনি অতিশয় ক্রুদ্ধ হন এবং সিন্ধুরাজ দাহিরের নিকট লিখিত এক পত্রে জানান যে, দুর্বৃত্তদিগকে গ্রেফতার করে তাদের উপযুক্ত শাস্তি বিধান করতে হবে এবং ক্ষতিপূরণসহ মুসলমান নারী ও শিশুদিগকে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু জলদস্যুদের উপর তার কোন কর্তৃত্ব নেই বলে দাহির ক্ষতিপূরণ প্রদানে ঔদাসীন্য প্রদর্শন করেন এবং হাজ্জাজকে স্বয়ং এসে দস্যুদের দমন করার উপদেশ প্রদান করেন। সিন্ধু রাজ্যের এই স্পর্ধাজনিত আচরণে হাজ্জাজের ধৈর্যচ্যুাতি ঘটে এবং তিনি ওয়ালীদের অনুমতিক্রমে আবদুল্লাহ আসলামীকে ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে সিন্ধুরাজ দাহিরকে দমন করার জন্য দেবলে প্রেরণ করেন। কিন্তু দাহিরের সৈন্যদের হাতে আবদুল্লাহ পরাজিত ও নিহত হন। এরপর দ্বিতীয় অভিযান প্রেরণ করা হয় এবং তাও ব্যর্থ হয়।
এসকল অভিযানে ব্যর্থ হওয়ার পর হাজ্জাজ বুঝতে পারেন যে, দাহিরকে পরাজিত করা সহজ নয়, তাই তিনি স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মোহাম্মদ ইবনে কাসেমের নেতৃত্বে ছয় হাজার সৈন্যের একটি সিরীয় ও ইরাকী বাহিনী সিন্ধু আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। মোহাম্মদ ইবনে কাসেমের সমপরিমাণে ঘোড়া ও উট ছিল। তিনি সৈন্য বাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। একভাগে তোপ গোলাবারুদ ও সৈন্যসহ সমুদ্র পথে রওয়ানা করেন এবং অপর ভাগে ছিল ঘোড়সোয়ার জোয়ানরা। তিনিও এই বাহিনীতে থাকেন। মোহাম্মদ ইবনে কাসেম তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে বর্তমান পাকিস্তানের মাকরান অঞ্চল দিয়ে দেবলের দিকে অগ্রসর হন। ব্রাহ্মণ ও দুর্ধর্ষ রাজপুতের দ্বারা সুরক্ষিত দেবল নগর অতি সহজেই মোহাম্মদ ইবনে কাসেমের দখলে চলে আসে। অতঃপর তিনি একে একে হায়দারাবাদের নিকট নিরুন শহর শিহওয়ান ও সিসতান দখল করেন। ইতোমধ্যে সিন্ধুরাজের অত্যাচারে জর্জরিত বহুসংখ্যক বিক্ষুব্ধ মেঠ ও মেঠ সৈন্য স্বেচ্ছায় মুসলিম বাহিনীতে। এই প্রাথমিক বিজয়ের পর মোহাম্মদ ইবনে কাসেমের সৈন্যরা বিপুল আনন্দ উৎসাহের মধ্যে অতি সুশৃংখলভাবে সিন্ধু নদ অতিক্রম করে রাওয়ারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এটা ৫ নভেম্বরের ঘটনা। হিন্দুরাজ দাহির খবর পেয়ে পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের একটি বিরাট বাহিনী সিন্ধুনদের তীরে প্রেরণ করেন। ভোরে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হয়। অত্যন্ত বীরত্বের সাথে উভয় সৈন্যদল কিছুক্ষণ লড়াই করার পর জনৈক আরব সৈন্য অগ্রসর হয়ে রাজা দাহিরকে হত্যা করে।
সিন্ধুরাজ নিহত হওয়ার পর তার বিপুল বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করতে শুরু করে এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের দিকে ধাবিত হয়। মোহাম্মদ ইবনে কাসেমও তাদের ধাওয়া করতে করতে ব্রাহ্মণ্যবাদে উপনীত হন এবং সেখানে আরও একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর উক্ত স্থান মোহাম্মদ ইবনে কাসেম দখল করেন। এই যুদ্ধে রাজা দাহিরের বিধবা পত্মী রাণী রাঈয়ের নেতৃত্বে হিন্দুসেনারা কিছুক্ষণ মোকাবিলা করলেও পরিণামে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। রাণী অগ্নিকুন্ডে আত্মহুতি দিয়ে পরাজয়ের গ্লানি হতে রক্ষা পান এবং ব্রাহ্মণবাদের আধিবাসীরা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় মোহাম্মদ ইবনে কাসেমের নিকট আত্মসমর্পণ করে।
সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। সেনাপতি মোহাম্মদ বিন কাসেম সেখানে কিছুকাল অবস্থান করে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সুসংহত করেন এবং আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। তার এ রাষ্ট্রই ছিল ভারতবর্ষে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র। আগেই বলা হয়েছে যে, তার সুশাসনের ফলে হিন্দুরা তাকে দেবতা হিসেবে গণ্য করতো।
এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, একদিন বিন কাসেম শহরের চকে একটি প্রতিকৃতি দেখে বলেন, তা অবিকল আমার আকৃতি, আমি বুঝতে পারছি না, একাজ কে এবং কেন করেছে। বলা হলো, তা হলো সিন্ধীদের নতুন দেবতা, তারা অবিকল এরূপ আরো একটি প্রতিকৃতি শহরের সবচেয়ে বড় মন্দিরে স্থাপন করেছে এবং তার পূজা করছে। বিন কাসেম বলেন, ইসলাম প্রতিমা পূজার অনুমতি দেয় না। এটি গুনাহ। গুনাহে কবিরা মহাপাপ। এরূপ হতে পারে না। আমরা খোদার নগণ্য বান্দা। তোমরা দ্রুত যাও এবং সেখানে গিয়ে সে দুটি প্রতিকৃতি ধ্বংস করে এসো। অতঃপর নির্দেশ পালিত হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।