Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীর গণপরিবহনে ভাড়ানৈরাজ্য

| প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাজধানীর গণপরিবহনে নৈরাজ্যের অবধি নেই। এর মধ্যে ভাড়ানৈরাজ্য প্রধান। সরকার বাস ও মিনিবাসের জন্য ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। বড় বাসের জন্য কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সা। মিনিবাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সা। সর্বনিম্ন ভাড়া বড় বাসে ৭ টাকা এবং মিনিবাসে ৫ টাকা। দুই ধরনের বাসেই এই ভাড়ায় কমপক্ষে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমণের সুযোগ আছে। প্রসঙ্গক্রম উল্লেখ করা দরকার, রাজধানীতে চলাচলরত ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাসই লক্কড়-ঝক্কড়। অনেক আগেই তাদের আয়ুস্কাল শেষ হয়ে গেছে। এগুলোর বাজারমূল্য বড়জোর ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। অথচ ব্যাংকের সুদসহ ক্রয়মূল্য ৪৭ লাখ টাকা ধরে এসব যানের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এই হিসাবে বলা যায়, সরকারনির্ধারিত এই ভাড়াই বেশী। কিন্তু এ ভাড়ায় যাত্রীরা কোনো বাস বা মিনিবাসেই ভ্রমণ করতে পারে না। তাদের বরং দ্বিগুণ, তিনগুণ এমন কি পাঁচগুণ পর্যন্ত ভাড়া গুণতে হয়। ৯৬ শতাংশ বাস-মিনিবাসেই বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। ‘সিটিং সার্ভিস’ নামের বাস-মিনিবাসে ইচ্ছেমত ভাড়া নেয়া হয়। বিভিন্ন রুটে চলাচলরত বাস-মিনিবাসের ভাড়ার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। একেক যানে একেক ভাড়া। এ নিয়ে কন্টাক্টর-হেলপারদের সঙ্গে যাত্রীদের বচসা, হাতাহাতি, মারামারি অনেকটাই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে। বাস-মিনিবাসগুলোর ব্যতিক্রম বাদে সবই যেমন বাইরের দিক থেকে দৃষ্টিকটু, ডাঙাচোরা-রঙওঠা, তেমনি ভেতরের অবস্থাও শোচনীয়, স্বচ্ছন্দে ভ্রমণের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। যাত্রীসেবা বলতে যা বুঝাই, তার কোনো বালাই নেই। এহেন বাস-মিনিবাসেই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যাত্রীদের চলাচল করতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
তথাকথিত সিটিং সার্ভিসের স্টিকার লাগানো বাস-মিনিবাসগুলোতে রীতিমত ‘ছিনতাই-ডাকাতি’ করা হচ্ছে। অথচ বিআরটিএ’র আইনে সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, এই বেআইনী সার্ভিস বন্ধে বিআরটিএ, পরিবহন মালিক সমিতি ও পুলিশ গত ১৬ এপ্রিল অভিযান শুরু করলে পরিবহন মালিকরা প্রায় ৪০ শতাংশ বাস-মিনিবাস বন্ধ করে দিয়ে যানবাহনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। মারাত্মক দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনায় পড়ে যাত্রীরা। শেষ পর্যন্ত অভিযান বন্ধ করে দিতে হয়। এরপর করণীয় নির্ধারনে বিআরটিএ, মালিক-শ্রমিক সংগঠন, নাগরিক প্রতিনিধি ও পুলিশের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি আলাদা ভাড়া ঠিক করে দিয়ে সিটিং সার্ভিস চালুর পক্ষে মত দেয়। রাজধানীতে এমনিতেই গণপরিবহনের সংকট রয়েছে। প্রতিটি বাস-মিনিবাসেই সিটের অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হয়। অনেক সময় বাঁদুরঝোলা হয়ে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীদের চলাচল করতে দেখা যায়। এমনকি সিটিং সার্ভিসগুলোতেও সিটের অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হয়। গণপরিবহনের সংখ্যা না বাড়িয়ে সিটিং সার্ভিস বহাল রাখা হলে যাত্রীদের কোনো সুবিধা হবে না। ষোলআনা সুবিধা হবে মালিকদের। লক্ষ্য করার বিষয়, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর হলেও যাত্রীদের পকেট কাটার জন্য বাস-মিনিবাসের মালিক-শ্রমিকরা গভীর সখ্যে আবদ্ধ। সেবার বেলায় অষ্টরম্ভা; কিন্তুু বাড়তি ভাড়া আদায়ে তারা একাট্টা, সিদ্ধহস্ত ও বেপরোয়া।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির আয়োজন গত রোববার অনুষ্ঠিত ‘সিটিং সার্ভিসের নামে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় রাজধানীর গণপরিবহনে ভাড়ানৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। ওই আলোচনায় সিটিং সার্ভিসের দৌরাত্ম্য বন্ধে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তরফে ১২ দফার একটি সুপরিশ পেশ করা হয়েছে। সুপরিবেশ বলা হয়েছে, রাজধানীতে চলাচলকারী মোটা বাস-মিনিবাসের ২৫ শতাংশ সিটিং সার্ভিস হিসাবে চলাচল করতে পারে। এ জন্য বাড়তি ভাড়ার হার নির্ধারণের কোনো প্রয়োজন নেই। সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় স্টপেজ মেনে এ সার্ভিস চালাতে হবে। ভাড়ার অংক ও দূরত্ব উল্লেখ করে টিকেট দিয়ে ভাড়া আদায় করতে হবে। মর্জিমাফিক ভাড়া আদায় করা যাবে না। অননুমোদিত কোনো আসন থাকতে পারবে না। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো যাবে না। দাঁড়ানো যাত্রী নেয়া যাবে না ইত্যাদি। এই সুপারিশগুলো কার্যকর করা হলে এবং মানা হলে সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। তবে এতেই বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ভাড়ানৈরাজ্য কেবল সিটিং সার্ভিসের ক্ষেত্রে নেই, সিটিং সার্ভিসের বাইরের সার্ভিসেও রয়েছে। তারও সমাধান করতে হবে। গোটা পরিবহন ব্যবস্থাকে শৃংখলায় আনতে হবে। দৃষ্টিকটু ও আয়ুস্কাল শেষ হয়ে যাওয়া সকল বাস-মিনিবাসের চলাচল বন্ধ করতে হবে। যাত্রী অনুপাতে গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে রাজধানীতে সাড়ে ৬ হাজারের মতো বাস-মিনিবাস চলাচল করে। এদের মালিকদের সংখ্যা ২ হাজারের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সব বাস-মিনিবাসকে কয়েকটি কোম্পানীর আওতায় পরিচালিত করলে শৃংখলা বিধান করা সহজ হবে। সবচেয়ে বড় কথা, যাত্রীদের যথাযথ সেবা নিশ্চিত করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন