Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বঞ্চিতরাই সরকারের প্রতিপক্ষ

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৫ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সরকারের উন্নয়নের জন্য দেশবাসী কেন প্রশংসায় পঞ্চমুখ (বিদেশীদের মতো) হচ্ছে না, তা নিয়ে আক্ষেপ আছে ক্ষমতাসীন মহলে। বলা বাহুল্য, প্রশংসা করার জন্যও সাধারণ জনগোষ্ঠির সমর্থনের প্রয়োজন। যেখানে জাতিকে বিভিন্ন খন্ডে খন্ডিত করে রাখা হয়েছে, প্রতিপক্ষকে কথা বলতে দেয়া হয় না, আদালতকে ব্যবহার করে মানুষকে নির্যাতনের চরম অবস্থায় পতিত করা হয়, সেখানে প্রশংসার দরজা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যায়। বিরোধীদের প্রতি সরকারি দলের নির্যাতন এখন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এমতাবস্থায় প্রশংসা মিষ্টি লাগে না, বরং তেতো হয়ে যায়।
যারা সরকারের প্রশংসা শুনতে আগ্রহী বা সমালোচনা শুনলে ব্যথিত হন তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, প্রশংসা করার জন্য আপনাদের তো কেনা (ক্রয় করা) বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, রয়েছে দলীয় ক্যাডারসহ প্রজাতন্ত্রে চাকুরীরত রাষ্ট্রীয় বেতনভুখরা। অন্যদিকে কোলকাতামনস্ক তাত্তি¡করা তো রয়েছেনই, যারা নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছেন বাংলা-ভারত বন্ধুত্বের দৃঢ়তা ও গাঢ়তার সপক্ষে শক্ত যুক্তি তুলে ধরার জন্য। এরপরও এতো আক্ষেপ কেন? আক্ষেপের নিশ্চয় কারণ রয়েছে। কারণ বয়াতি গানের সুরে যদি বলতে হয় তবে বলতে হয়, ‘বিদেশে গিয়ে যদি ছেলে মারা যায় তবে পাড়া পরশি জানার আগে জানে মা’। যারা আমাদের ‘মা’ এর ভ‚মিকায় অর্থাৎ অভিবাবক তথা সরকার তারা অবশ্যই টের পাওয়ার কথা জনগণ তাদের সম্পর্কে কী ভাবে এবং মন্তব্য করে। দেশে উন্নয়নের নামে লুটপাট হচ্ছে একথা পানিসম্পদ মন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, বন্যা পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ৪২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে তবে লুটপাট হতে পারে, হরিলুট হয়নি। লন্ডনে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেছেন, ‘আমাদের এমপি’রা বিভিন্ন লোকের নিকট থেকে কাজের জন্য টাকা নেয় তবে এটাকে আমি ঘুষ বলবো না।’ গত ২২ অক্টোবর সাংবাদিকদের নিকট দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন, দুদক খুবই স্বচ্ছ। তবে প্রধান বিচারপতির দুর্নীতির তদন্তের বিষয়ে দুদক এখনো সিদ্ধান্ত নেনি (যদিও রাষ্ট্রপতি ১১টি দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রমাণাদি অ্যাপিলেট ডিভিশনের বিচারপতিদের নিকট প্রদর্শন করেছেন)। এখানে অবশ্যই দুদককে প্রধানমন্ত্রীর ‘অভিমানের’ (সিন্হার ভাষ্যমতে) গভীরতা মেপেই অগ্রসর হতে হবে। কারণ কাগজে-কলমে দুদক ‘খুবই’ স্বাধীন হলেও এর ‘স্বাধীনতা’ কতটুকু তা দেশবাসী অবশ্য অবশ্যই টের পাচ্ছে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারগণ বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে আলোচনায় বলেছেন যে, ‘জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাটাই হবে নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ।’ এতে বুঝা যায়, দুই অক্ষরের একটি শব্দ ‘আস্থা’ সর্বক্ষেত্রে সর্বপ্রথম প্রয়োজন। সরকার ‘আস্থাহীনতায়’ রয়েছে কি না তা বুঝার বোধ শক্তি সরকারের থাকে না। কারণ, সরকার প্রধান থাকেন চার দেওয়ালের অভ্যন্তরে। সরকারকে বিভিন্ন তথ্য দেয়ার জন্য যে সকল বেতনভুক্ত সরকারি অ্যাজেন্সি থাকে তারা সরকারকে এমন তথ্য প্রদান করে যাতে সরকার প্রধান উৎফুল্ল হয় বা ‘মাইন্ড’ না করে। আমলারা এটা বোঝে যে, সরকার প্রধান ‘মাইন্ড’ করলে প্রমোশন বা সুবিধা মতো পোস্টিং অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে। জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লাগের সাবেক মন্ত্রী এ.কে. খন্দকার তার লেখা ‘ভিতর বাহির’ বইতে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।
দশ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সরকারের একটি পেটোয়া বাহিনী সৃষ্টি হয়েছে। যারা বিরোধীদের উপর নানা প্রকার অত্যাচার-নির্যাতনে লিপ্ত। এতে সরকারি দলের পেটোয়া বাহিনীকে থানা-পুলিশ আশ্রয়-প্রশয় দিচ্ছে। যে কোন ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে বিরোধীদের মামলা ও চার্জশীট দেয়াই পুলিশের প্রধান কাজ। এলাকায় পেটোয়া বাহিনীই এখন সকল দেন-দরবারের কাজ করে। জমি, বাড়ি, দোকানপাট বিক্রি, ঠিকাদারী প্রভৃতি সবই পেটোয়া বাহিনীদের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি ‘প্রেম’ করতে গেলেও তাদের নিকট ধর্না দিতে হয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর এক জাতীয় দৈনিকে ‘একটি ফরিয়াদ’ শিরোনামে একটি আর্টিকেল পড়লাম। সেখানে একজন মা ‘একটি ফরিয়াদ’ শিরোনামে লিখেছেন ‘গত শুক্রবার ১লা সেপ্টেম্বর কোরবানীর আগের রাতে আমার ছেলে কোরবান হয়ে গেল। এ দুঃখ সইবার ক্ষমতা আমার নাই।’ নিহতের মা ডা. রুখশানা আমিন সুরমা লিখেছেন যে, ‘আমার সন্তান মো. সোহান খান বয়স পনেরো, উচ্চতা ৫ ফিট ৭ ইঞ্চি, ওজন ৫৩ কেজি, গায়ের রং উজ্জ্বল, চেহারাটা বেশ সুন্দর, খিলগাঁও নন্দীপাড়া ব্রিজ ব্যাংক কলোনী নন্দী পাড়া আইডিয়াল স্কুলে পড়তো অষ্ঠম শ্রেণিতে। খুব মেধাবী, সৎ, চরিত্রবান, শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতো না, খুব পরিচ্ছন্ন এবং গোছালো ছিল, প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে এসে আগে কোরআন তেলাওয়াত করতো, তার পর ভাত খেতো। এই বয়সে দু’বার কোরান খতম করেছে। মেয়েদের মতো ঘরের কাজ করতো, বাইরের কোন বাজে আড্ডা ছিল না। সব মিলিয়ে একজন ভদ্র ও ভালো মানুষ। ক্লাস ফাইভে এ প্লাস পেয়েছিলো এবারও সে এ প্লাস পাবে সে আশায় সবাই ছিল। সোহান ভালো নাচতো এবং গাইতো, অনেক স্বপ্ন ছিলো ভবিষ্যতে ওকে নিয়ে।’
আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ে জানতে পারলাম যে, ছেলেটির প্রেম করার অভিযোগে মা ও ছেলেকে একত্রে করে স্থানীয় পেটোয়া বাহিনী অপমান-অপদস্থ করায় অভিমানে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে। মা’কে অপমান অপদস্থ করার পূর্বে ছেলেটিকে পিটানো হয়েছে। কোন মেয়ে বা তার অভিভাবকদের পক্ষ থেকে পেটোয়া বাহিনীর নিকট কেউ অভিযোগ করেনি। পেটোয়া বাহিনী যদি এতোই শক্তিশালী হয় তবে থানা ও কোর্ট কাচারীর প্রয়োজন কী? পুলিশ ও পেটোয়াদের কর্মকাÐে জনগণ অসহায়।
নিরীহ জনগণ মনের ভাব সহজে প্রকাশ করে না। তবে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ পায় তখন নিরব বিপ্লবে গনেশ উল্টে দেয়। এভাবে সময়ে সময়ে পৃথিবীতে বহু গণেশ উল্টে গেছে। উল্টে যাওয়ার পর উপলব্ধি আসে। তবে যদি সরকারের শীর্ষ কর্তা-ব্যক্তিরা ছদ্মবেশে রাজধানী বা গ্রাম অঞ্চলে ঘুরে মানুষের সাথে কথা বলেন তবে তারা দেখবেন, তাদের দলের লোকেরাই শুধু ভালো আছে বা নীতির প্রশ্নে নয় শুধুমাত্র মানসম্মান নিয়ে ভালো থাকার জন্য যারা দলে নাম দিয়েছে তারা ভালো আছে, কিন্তু তারা আছে বিপদে যারা সরকারের বিরোধীদের পক্ষ নিয়েছে। ছদ্মবেশে খোঁজ না নেয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক হাওয়া কোন দিকে বইছে তা উপলব্ধি করা যাবে না। কারণ, হাওয়া যখন উল্টো বয় মাঝি তখন বুঝে না এবং না বুঝলে যা হবার তাই হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
সরকারি প্রচার যন্ত্রের মিথ্যার নিকট জাতি ইতোপূর্বেই পরাস্ত হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনা, গণতন্ত্রের ফানুস উড়িয়ে বিশ্ব জয় করে যারা গদগদ তারা বুকে হাত দিয়ে কেউ কি বলতে পারবেন বাংলাদেশের কোথায় গণতন্ত্র বিদ্যমান? দেশের কবি, সাহিত্যিক, গল্পকার, ছড়াকার তথা লেখকদের একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলা একাডেমি। একজন স্বনামধন্য আওয়ামী ঘরনার বুদ্ধিজীবী সে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। অথচ তিনিও অনির্বাচিত। বাংলা একাডেমির সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত নন, অথচ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। অথচ, এরাই গণতন্ত্রের পূজারী। এর চেয়ে প্রতারণা আর কী হতে পারে? অং সাং সূচিকেও গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও নভেল পুরুষ্কার দেয়া হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য। অথচ লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার জীবন কেড়ে নিলো এই অং সাং সূচির নেতৃত্বাধীন সরকার!
অনির্বাচিতদের দ্বারা সরকার গঠনের প্রক্রিয়া জায়েজ হওয়ার পর এখন গ্রাম পর্যায়েও অর্থাৎ মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, বাজার কমিটিতেও স্থানীয় জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলনের জন্য কোন নির্বাচন নেই। সরকারি দলের নেতারা যাকে পছন্দ করেন তাকেই বিনা নির্বাচনে বানানো হয় কর্মকর্তা। এ অবস্থা তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত। ক্রীড়া ফেডারেশনগুলিতে প্রকৃত ক্রীড়া সংগঠকদের পরিবর্তে বিনা নির্বাচনে দলীয় লোক কর্মকর্তা বানানো হচ্ছে। এমনিভাবে বিনা ভোটের সংস্কৃতি সরকার চালু করায় বঞ্চিত লোকগুলিকে প্রতিপক্ষ বানিয়েছে সরকার নিজেই।
যে দেশের মন্ত্রীরা ‘লুটপাট’কে কোন অপরাধ মনে করে না। অর্থমন্ত্রী যেখানে নিজেই স্বীকার করেন যে, এমপি’রা কাজের জন্য জনগণের নিকট থেকে টাকা নেয়, তবে এ টাকা নেয়াকে তিনি ঘুষ মনে করেন না। প্রধানমন্ত্রী অভিমান করলেই সুস্থ প্রধান বিচারপতি অসুস্থ হয়ে যান। সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ ও ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় করবে তা নিয়ে এতো ভাবনার কী আছে? প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাত্রাতিরিক্ত প্রশয় দেয়ায় কারণেই তারা (বাহিনী) এখন নানা অপকর্মে নিজেদের জড়িত করে ফেলেছে। ইয়াবা চালান দেশে প্রবেশ এবং অর্থের জন্য ইয়াবা হাতে দিয়ে গ্রেফতার করার অভিযোগও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এমতাবস্থায়, সরকারের ভ‚য়সী প্রশংসা মানুষের মুখে আসবে কী করে?
জাতি আজ মিথ্যার নিকট পরাজিত। জাতির বিবেক আজ নিরব নিস্তব্ধ। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতির বিবেকই এ নিরব নিস্তব্ধতা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে পারে।
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বঞ্চিত

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ