Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

স্বামী ও তৃতীয় স্ত্রীর ৬ দিনের রিমান্ড

রাজধানী বাড্ডায় মা-ছেলে হত্যা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে, বড় দুই ছেলে বিদেশ থেকে ফিরলে দাপন করা হবে
রাজধানীর কাকরাইলে শামসুন্নাহার করিম ও ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওন হত্যার ঘটনায় নিহতের স্বামী আবদুল করিম (৫৬) ও তার তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তার (২৫) ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল শুক্রবার রমনা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলী হোসেন তাদের আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আাবেদন করেন। শুনানি শেষে মহানগর হাকিম খুরশীদ আলম এই রিমান্ড আদেশ দেন। নিহত মা ও ছেলের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে শামসুন্নাহারের ভাইদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের লাশ বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে। শামসুন্নাহারের বড় দুই ছেলে বিদেশ থেকে ফেরার পর লাশ দাফন করা হবে বলে স্বজনেরা জানিয়েছেন।
এ ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার নিহত শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ আলী বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে নিহতের স্বামী আবদুল করিম, করিমের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমীন মুক্তা, মুক্তার ভাই জনিসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে। পরে বৃহস্পতিবার করিম ও মুক্তাকে আটক করে পুলিশ। তারপর তাদের ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
এর আগে গত বুধবার সন্ধ্যায় কাকরাইলের পাইওনিয়র গলির ৭৯/১ নম্বর বাসার গৃহকর্তা আবদুল করিমের প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহার করিম (৪৬) ও তার ছেলে শাওনকে (১৯) গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
জানা গেছে, আবদুল করিম ও শামসুন্নাহার দম্পতির তিন ছেলের মধ্যে নিহত শাওন সবার ছোট। তাদের বড় দুই ছেলে দেশের বাইরে থাকে। রাজধানীর শ্যামবাজারে আবদুল করিমের ব্যবসা রয়েছে। ঘটনার সময় তিনি সেখানেই ছিলেন।
এ ছাড়া স¤প্রতি চলচ্চিত্র নির্মাণেও বিনিয়োগ করে আসছেন আবদুল করিম।
গত বৃহস্পতিবার রাতে শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ আলী বাদী হয়ে শামসুন্নাহার করিম ও ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওনকে গলাকেটে হত্যার ঘটনায় রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করেন। মামলায় ভগ্নিপতি আবদুল করিম (৫৬), তার তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তা (২৫) এবং মুক্তার ভাই আল আমিন জনিসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলাটি করেন তিনি।
মালার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হত্যাকাÐে রহস্য উদঘাটনের জন্য আবদুল করিম ও তার তৃতীয় স্ত্রী মুক্তাকে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মামলার এজাহারে নিহতের ভাই আশরাফ আলী উল্লেখ করেন, পারিবারিক বিরোধের কারণেই শামসুন্নাহার ও তার ছেলে শাওনকে হত্যা করা হয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় মা-ছেলের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা।
নিহতদের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ ময়নাতদন্ত শেষে জানান, মা-ছেলে ছুরিকাঘাতেই নিহত হয়েছে। দু’জনের শরীরে একাধিক ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে মায়ের চেয়ে ছেলের শরীরে বেশি জখম রয়েছে।
তিনি আরো জানান, মায়ের বুকের ওপরে একটি ছুরার আঘাত ছিল, যা ফুসফুসে আঘাত হেনেছে। আর ছেলের বুকের দুইপাশেই ছুরা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। দু’টি আঘাতই ফুসফুস ভেদ করে গেছে। এরকম একটি আঘাতে যে কারো মৃত্যু হতে পারে।
ময়নাতদন্ত শেষে নিহতদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ভগ্নিপতি মো. জসীম উদ্দীন জানান, নিহতদের লাশ এখন বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে। নিহত শামসুন্নাহারের বড় দুই ছেলে দেশের বাইরে থাকেন। তারা দেশে ফেরার পর লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিনেমার পর্দার কাহিনীই যেন এবার করিমের নিজের জীবনে এসে ধরা দিয়েছে। প্রথম স্ত্রী ও সন্তান খুনের ঘটনায় তারই আরেক স্ত্রীকে আটক করা হয়েছে। শিগগিরই পুরো রহস্য উন্মোচিত হবে। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া খুনিদেরও আইনের আওতায় দ্রæত আনা সম্ভব হবে।
জানা গেছে, আবদুল করিম তিনটি বিয়ে করেছেন। ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রযোজক হওয়ার কারণে তার অনেক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল। তাদের অনেককে নিয়ে তিনি মাঝে মাঝেই বিদেশে উড়াল দিতেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর চার বছর আগে তিনি মুক্তাকে বিয়ে করেন। মুক্তাও চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন। করিমের তিন স্ত্রীই ঢাকায় থাকেন। প্রথম সংসারে তার তিন ছেলে। বড় সন্তান মুন্না যুক্তরাজ্য প্রবাসী, দ্বিতীয় ছেলে অনিক কানাডা প্রবাসী, তৃতীয় ছেলে শাওন মায়ের সঙ্গে নৃশংসভাবে খুন হয়েছে। দ্বিতীয় সংসারে রয়েছে এক ছেলে (১৭)। ডিভোর্সের পর ছেলেকে নিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী ঢাকাতেই বসবাস করতেন। একাধিক নারীসঙ্গ এবং একের পর এক বিয়ের কারণে করিমের সংসারে দীর্ঘদিন ধরেই অশান্তি চলে আসছিল বলে আশপাশের ভবনের বাসিন্দারা জানিয়েছেন। এ কারণে মাঝেমধ্যেই প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহারকে মারধর করতেন করিম।
জানা যায়, কাকরাইলের একটি ছয়তলা বাড়ির মালিকানা ছিল নিহত শামসুন্নাহারের নামে। এ জন্য মুক্তা একটি বাড়ি তার নামে রেজিস্ট্রি করে দেয়ার জন্য করিমকে চাপ দিয়ে আসছিলেন। নিহত শামসুন্নাহারের ভাই মুফতি আশরাফ আলী জানান, যখন তার বোন শামসুন্নাহারের বিয়ে হয়, তখন আবদুল করিম দরিদ্র ছিল। পুরান ঢাকার শ্যামপুরে আড়ৎ ব্যবসা তার জীবন পাল্টে দিয়েছে। পরে ফিল্ম ব্যবসাও শুরু করেন। এই সুবাদে নায়িকাদের সঙ্গে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতেন। তার ভগ্নিপতি করিম এ পর্যন্ত চারটি বিয়ে করেছেন। সর্বশেষ বিয়ে করেন অভিনয় শিল্পী মুক্তাকে। তিনি আরো বলেন, স¤প্রতি মুক্তা ও করিম কাকরাইলের ভিআইপি রোডের ৭৯/১ নম্বর মায়াকানন বাড়িতে গিয়ে ভাঙচুর ও তার বোনকে মারধর করেন। এ ঘটনায় শামসুন্নাহার থানায় জিডি করার জন্য তার সঙ্গে পরামর্শ করেন। জিডি করব করব বলে করা হয়নি। এর মধ্যেই হত্যাকাÐের ঘটনা ঘটে গেল। মুক্তা ও করিম দুজনে তার বোন শামসুন্নাহার ও তার ভাগ্নে শাওনকে খুন করেছে বলে ধারণা আশরাফের।
জানা গেছে, আবদুল করিম একসময় মাথায় করে তরকারি বিক্রি করতেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তিনি কোটিপতি বনে গেছেন। এর পেছনে পুরান ঢাকার আড়ৎ ব্যবসা, জমিজমা ও বাড়ি দখল অন্যতম। তার বিরুদ্ধে আদালতে অর্ধশত মামলা রয়েছে। একপর্যায়ে চলচ্চিত্রে ছবি প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত হন করিম। তার প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহার খুবই পর্দানশিন ছিলেন। তিনি বাড়ির দারোয়ান নোমানকে দিয়ে ভাড়া ওঠাতেন।
মায়াকানন ভবনের ষষ্ঠ তলার ভাড়াটিয়া জাকির হোসেন বলেন, করিমের নৈতিক অধঃপতন দেখে প্রথম স্ত্রী বাধা দিতেন। এ জন্য তাকে প্রায়ই মারধরও করা হতো। কিন্তু তিনি নীরবে সয়ে গেছেন। তার বড় ছেলে মিশু লন্ডন রয়েছেন। মেঝো ছেলে অনিককে ছয় মাস আগে কানাডায় পাঠানো হয়েছে। আর ছোট ছেলে শাওন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ও লেভেলে পড়ত। মায়ের খুনিদের বাধা দেয়ায় শাওনকেও খুন করা হয়েছে বলে তার ধারণা।
প্রতিবেশী মোজাম্মেল জানান, নিহত শামসুন্নাহার খুবই ধার্মিক মহিলা ছিলেন। তিনি সবার সুবিধার জন্য বাড়ির নিচে নামাজের জায়গা করে দিয়েছিলেন।
গতকাল সকালে মায়া কানন বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির নিচের কলাপসিবল গেট খোলা রয়েছে। সিঁড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। এই ভবনেরই চতুর্থ তলায় রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। সেখানেই খুন হন মা-ছেলে। চতুর্থ ও পঞ্চম তলার প্রতিটি ফ্ল্যাটই তালাবদ্ধ। দ্বিতীয় তলায় বসবাস করেন উইলস লিটন ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আবদুল আজিজ। তৃতীয় তলায় রয়েছে একটি অফিস। ঘটনাস্থলে পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
জানা গেছে, করিমের তৃতীয় স্ত্রী মুক্তার বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। মুক্তার বাবা পুলিশের একজন কনস্টেবল। অভিনয়ের সূত্র ধরেই করিমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে তারা বিয়ে করেন।



 

Show all comments
  • রাকিব ৪ নভেম্বর, ২০১৭, ২:৫৬ এএম says : 0
    অপরাধীদের কঠো শাস্তির দাবি করছি
    Total Reply(0) Reply
  • S. Anwar ৪ নভেম্বর, ২০১৭, ৮:১০ এএম says : 0
    "অর্থই সকল অনর্থের মূল"
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রিমান্ড

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ