Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাজধানীর বাড্ডায় পরকীয়া প্রেমের জেরে জোড়া খুন

উমর ফারুক আলহাদী | প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০১৭, ৬:৩৩ পিএম

রাজধানীর বাড্ডায় পরকীয়া প্রেমের জেরে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। বাবা-মেয়ে হত্যাকাণ্ডে প্রধান সন্দেহভাজন খুনি ও নিহত জামিল শেখের স্ত্রী আরজিনা ও প্রেমিক শাহীনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার ভোরে খুলনা থেকে শাহীনকে গ্রেফতার করা হয়। শাহীনের স্ত্রী এবং তাকে ঢাকায় আনা হচ্ছে। নিহত জামিল শেখের স্ত্রী আরজিনা বেগমের সঙ্গে শাহীনের পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। পারিবারিকভাবেই ১২ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই আরজিনার পরকীয়া প্রেমের বিষয়টি জানতে পারেন তার স্বামী। কিন্তু সন্তানদের কথা বেবে এবং লোকলজ্জার কারণে আরজিনাকে ছাড়তে পারেননি জামিল। হত্যাকাণ্ডে ২০/২২ দিন আগেও আরজিনা তার মায়ের কাছে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাকে বুঝিয়ে জামিল শেখ ও তার স্বজনেরা আরজিনাকে বাসায় ফিরিয়ে আনেন। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আরজিনাকে তালাক দিতে পারেননি তার স্বামী। এমনটি জানিয়েছেন নিহতের স্বজনেরা ও পুলিশ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বাড্ডা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাখাওয়াত হোসেন গতকাল ইনকিলাবকে বলেন,রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় জোড়া খুনের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আরজিনার পরকীয়া প্রেমিক ও মামলার আসামি শাহিন মল্লিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সেই সাথে শাহীনের স্ত্রীকেও আনা হয়েছে। তিনি জানান, গতকালই ময়নাতদন্তের পর লাশ দুইটি নিহতের ভাইদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। লাশ দুইটি দাফনের জন্য গোপালগঞ্জ জেলা সদরের করপাড়া ইউনিয়নের বনপাড়া গ্রামে নিয়ে গেছেন স্বজনেরা।
তিনি আরো জানান,নিহত জামিলের ভাই শেখ শামীম হোসেন বাদী হয়ে নিহতের স্ত্রী আরজিনা বেগম ও তার পরকীয়া প্রেমিক শাহিন মল্লিককে আসামি করে বাড্ডা থানায় এ মামলা করেন। মামলা নং ৪। বৃহস্পতিবার রাতেই ৩০২/৩৪ ধারায় মামলাটি নথিভুক্ত হয়। মামলা নথিভুক্ত হবার পর নিহতের স্ত্রী আরজিনা বেগমকে গ্রেফতার দেখানো হয়। শাহিন মল্লিককে গ্রেফতারে পর থানায় এন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আজ তাদের আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করা হবে। পাশাপাশি অন্যান্য আসামীদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন আরও জানান, শাহিন মল্লিক পেশায় রং মিস্ত্রি। মামলায় পরকীয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। নিহতের পরিবারও একই দাবি করেছে। স্ত্রী আরজিনা ও তার প্রেমিক শাহিনের যোগসাজশে জোড়া খুন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়,জামিলের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের করপাড়া ইউনিয়নের বনপাড়া গ্রামে। পাঠান ভিলার ৩ তলায় দুটি কক্ষে ভাড়া থাকতেন বেসরকারি একটি অফিসের গাড়ি চালক জামিল। গত কোরবানির ঈদের পর স্ত্রী আরজিনা (৩০), মেয়ে নুসরাত (৭) ও ছেলে আলফিকে(৩) নিয়ে ওই বাসায় উঠেন জামিল।
পুলিশ জানায়, শাহীন নিহত জামিল শেখের সঙ্গে সাবলেট ভাড়া থাকতেন। এর সুবাদে জামিলের স্ত্রী আরজিনা সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। শাহীন ছাড়াও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরো তিন থেকে চারজন জড়িত ছিল।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে বাড্ডা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী ওয়াজেহদ আলী বলেন, পরকীয়া প্রেমের কারণেই জামিলকে ও তার সন্তানকে খুন করা হয়েছে। বিষয়টি জিজ্ঞাসাবাদে নিহতের স্ত্রী আরজিনা বেগম স্বীকার করেছেন। গতকাল ভোরে খুলনার লবণচোরা থানার মোহাম্মদনগর এলাকা থেকে আরজিনার প্রেমিক শাহীনকে গ্রেফতার করার পর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। শাহীনের সঙ্গে তার স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ঢাকায় আনা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, আমরা প্রথম থেকেই সন্দেহ করছিলাম এটা পরকীয়া প্রেমর কারণে হতে পারে। অর্থাৎ নিহতের স্ত্রীর সঙ্গে কারো পরকীয়া আছে। শেষ পর্যন্ত তাই সত্য হলো।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের গুলশান বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, আরজিনাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথম দিকে সে অসংলগ্ন তথ্য দিলেও একপর্যায়ে সে হত্যাকাণ্ডে নিজে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। চার-পাঁচ মাস ধরে এক যুবকের সঙ্গে তার পরকীয়া প্রেম চলছিল। তার নাম শাহীন। প্রেমে বাধা দেওয়ার কারণে সেই প্রেমিকসহ দু’জনে জামিল শেখ ও নুসরাতকে হত্যা করেছে।
নিহতের স্বজনরা জানান,স্বামী জামিলের সঙ্গে স্ত্রী আরজিনার সম্পর্ক ভালো ছিল না। বিয়ের পর থেকেই তাদের পরিবারে অশান্তি লেগে ছিল। আরজিনা মোবাইলে বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথা বলতেন। এ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াও হয়েছে অনেক। নতুন এই বাসায় ওঠার আগে আরজিনা রাগ করে সাভারের ইপিজেড এলাকায় তার মায়ের বাড়িতে গিয়ে দুই মাস ছিলেন। পরবর্তীতে নিহত জামিলের বোনের জামাই সাভার গিয়ে আরজিনাকে বাড্ডায় স্বামীর বাসায় নিয়ে আসেন।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান,জামিল শেখ গোপালগঞ্জ সদরের করপাড়া ইউনিয়নের বনপাড়া গ্রামের মৃত বেলায়েত শেখের ছেলে। পারিবারিক পছন্দে জামিল প্রায় ১২ বছর আগে গোপালগঞ্জের মেয়ে আরজিনাকে বিয়ে করেন। জামিল তখন একটি প্রাইভেট কোম্পানির গাড়ি চালাতেন।
উপার্জন ভালই ছিল। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। শুরুতে সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু, পরে সমস্যা দেখা দেয়। জামিল কর্মক্ষেত্রে চলে গেলে আরজিনা তার দূর সম্পর্কের এক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে দীর্ঘ আলাপ করত। পরে সেটিই পরকীয়ায় রূপ নেয়। বিষয়গুলো জামিলের পরিবারের সদস্যরা জানলেও তারা চেয়েছিলেন, সময়ের ব্যবধানে সব ঠিক হয়ে যাবে। বড় আশা হয়ে দেখা দিয়েছিল, নুসরাতের জন্ম। এর কয়েক বছর পর জন্ম নেয় আলফি। এতে করে জামিলের পরিবার আরও আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু, সেই আশায় তাদের সর্বনাশ ডেকে আনে।
নিহত জামিলের বড় ভাই ইমরুল জানান, দুই সন্তান জন্মের পরও বেশ কয়েকবার পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া করে আরজিনা বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। পরে পারিবারিকভাবেই তাকে বুঝিয়ে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু, তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সুন্দর চেহারাকে কাজে লাগিয়ে একাধিক ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে আরজিনা।
ইমরুল জানান, এসব নিয়ে জামিলের সঙ্গে স্ত্রী আরজিনার দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিষয়টি ভাইদের সঙ্গে শেয়ার করলেও লোকলজ্জার ভয়ে কখনও প্রকাশ্যে আনতে চাইনি। মূলত দুটি সন্তানের মুখ পানে চেয়ে জামিল কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।
বড় ভাই ইমরুল আরও জানান, ১৫/২০ দিন আগেও ঝগড়া করে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা-পয়সা নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিল আরজিনা। কারণ, সাব-লেট শাহীনের সঙ্গে স্ত্রী আরজিনার পরকীয়া জেনে গিয়েছিল জামিল। এ নিয়ে ঝগড়ার এক পর্যায়ে সে বাসা ছেড়ে সাভারে বাবার বাসায় চলে যায়। তিনি জানান, এতকিছুর পরও ছেলে-মেয়ের কথা চিন্তা করে জামিল ফের আরজিনাকে বাবার বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু, এবার যে আরজিনা ঘাতক হিসেবে দেখা দেবে তা তারা কল্পনাও করতে পারছেন না।
নিহত জামিলের ছোট ভাই শামীম শেখ জানান, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবী প্রেমিককে নিয়ে ভাই ও সন্তানকে এভাবে হত্যা করবে, আমরা কেউ ভাবতেও পারছি না।
তিনি জানান, পরকীয়ার জেরেই ভাইকে হত্যা করা হয়েছে, এখন আমরা অনেকটাই নিশ্চিত। আর নুসরাত হয়তো বাবাকে হত্যা দেখে ফেলেছিল, এজন্য তাকেও শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা হয়েছে।
পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তারাও পারিবারিক কলহ এবং পরকীয়ার বিষয়টি মাথায় রেখেই তদন্তকাজ করে যাচ্ছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী জানিয়েছেন, বাড্ডা থানার বাবা-মেয়ে হত্যা মামলায় তদন্তের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। নিহতের স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিকেও গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলছে।
নিহতের এক স্বজন জানিয়েছেন, রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় বাবা ও মেয়ে খুনের ঘটনায় দায়ের মামলার আসামি শাহীনকে বৃহস্পতিবার রাতে খুলনায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে নিয়ে পুলিশ রাতেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে আরজিনা পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, ডাকাতরা তার স্বামী ও মেয়েকে খুন করেছে। এমনকি তাকে ধর্ষণও করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বুধবার বাড্ডার ময়নারটেকের বাসায় জামিল শেখ (৪১) ও তার মেয়ে নুসরাতকে (৯) নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জোড়া খুন

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ