Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিতাড়ন অভিযানের মূল রহস্য কোথায়?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৬ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অতি সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। বাংলাদেশে তাঁর সংক্ষিপ্ত অবস্থানকালে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফেরৎ নিতে হবে মিয়ানমারকে। তাঁর এই বক্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা বিতাড়ন শুরু হওয়ার পর পর ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মিয়ানমারে শুভেচ্ছা সফরে যান। বর্তমান মিয়ানমার সরকারের স্টেট কাউন্সিলর এককালের গণতন্ত্রের লড়াকু সৈনিক হিসাবে নোবেল পুরস্কার-বিজয়ী অং সান সুচীর সঙ্গে সে সময় তাঁর যে অন্তরঙ্গ ছবি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তাতে মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা বিতাড়ন-নীতির প্রতি তাঁর সরকারের একাত্মতা প্রকাশেরই ইঙ্গিত পান সংবাদপত্র-পাঠকরা। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, রোহিঙ্গা-প্রশ্নে ভারতের কোন্ নীতি সঠিক-সুষমা স্বরাজের সাম্প্রতিক বক্তব্য, না, ২৫ আগস্ট নতুন করে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন অভিযান শুরু হওয়ার পর পর ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মিয়ানমারে যে শুভেচ্ছা সফরে যান সেই সফরের মাধ্যমে প্রতিভাত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নীতির প্রতি একাত্মতা প্রকাশের ঘটনা?
অবশ্য ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে নতুন করে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা বিতাড়নের-নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, তার কঠোর বাস্তবতায় এক পর্যায়ে মিয়ানমার সরকার তার রোহিঙ্গা-নীতির আংশিক সংশোধনে বাধ্য হয়। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের দেখতে আসেন তুরস্কের ফাস্ট লেডী মিসেস এরদোগানও জর্ডানের রাণী রানিয়া। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নীতির প্রতিবাদ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহ। কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণে বাধ সেজেছে চীন ও রাশিয়া। এর মধ্যে আবার মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের জাতীয় স্বার্থভিত্তিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে চীন মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে কোন কঠোর পদক্ষেপের গ্রহণের বিরোধিতা করে প্রমাণ করেছে সেই বহুল আলোচিত প্রবাদ বাক্য : কোন স্বাধীন দেশের কোন স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রæ থাকতে পারে না।
আগেই বলেছি, মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা বিতাড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠায় মিয়ানমার সরকার তার রোহিঙ্গা নীতিতে কিছুটা নমনীয় হয়েছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচী আভাস দিয়েছেন, শীঘ্রই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম শুরু হবে। কিন্তুু এ ব্যাপারেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধান আসবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিস্থিতির রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল। কারণ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে এক ধরনের তথাকথিত আদর্শ গ্রামে, তাদের শত শত বছরের আদি-ভিটাতে নয়।
পত্রিকা-পাঠকরা সকলেই জানেন, মিয়ানমারের সেনা-সদস্যদের হুমকির মুখে রোহিঙ্গারা প্রাণের ভয়ে তাদের শত শত বছরের আদি ভিটা-মাটি ছেড়ে মিয়ানমার ত্যাগ করে চলে আসতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেনা-সদস্যরা রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত বিভিন্ন পল্লীতে যেয়ে হুমকি দিত তাদের বিনা বিলম্বে মিয়ানমার ছেড়ে যেতে হবে, নইলে তাদের হত্যা করা হবে এবং তাদের বাড়ী ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হবে। কিন্তুু তারা ঘরবাড়ী ছেড়ে আসার পরও সেনা সদস্যরা তাদের ঘর বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তাদের ঘরবাড়ীতে থাকা সম্পদ লুট করে নেয়ার কাজ অব্যাহত রাখে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ধান বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা পাওয়া যাবে।
শুধু তাই নয়, এরপরও সেনারা তাদের নিষ্ঠুর গণহত্যা কার্যক্রম চালিয়ে যায়। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেছে বেছে তারা রোহিঙ্গা পুরুষদের হত্যা করে, নারীদের গণধর্ষণের শিকারে পরিণত করে এবং শিশুদের নৃশংসভাবে হত্যা করে পাশবিক উল্লাসে মত্ত হয়। বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাই যে অধিক, তাতে প্রমাণিত হয় রোহিঙ্গা পুরুষদের বিরুদ্ধেই এই সব মানবদেহী পশুদের আক্রোশ ছিল অধিক। পুরুষদের মধ্যেও আবার রোহিঙ্গা শিক্ষিত ও আলেমদের বিরুদ্ধে তাদের বর্বর আক্রোশের কারণ, এরাই রোহিঙ্গাদের বিপদের দিনে তাদের সতর্ক করে মুক্তির পথনির্দেশ করতে পারতেন। এসব ঘটনা থেকে বুঝা যায়, একটি জনগোষ্ঠীকে দুনিয়ার বুক থেকে সম্পূর্ণ উৎখাত করে দেয়ার পাশাপাশি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পূর্ণ মুছে ফেলাও ছিল রোহিঙ্গা বিরোধীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
রোহিঙ্গা বিরোধী এই অভিযানে বাহ্যিকভাবে মিয়ানমার সেনা-বাহিনীর ভূমিকা প্রধান ছিল মনে করা হলেও এই অভিযান সফল হতেই পারতো না এসব অভিযানে উগ্র বৌদ্ধ ধর্মনেতাদের ইন্ধন ছাড়া। এক শ্রেণীর বৌদ্ধ উগ্র ভিক্ষুদের এই নৃশংস ভূমিকা প্রমাণ করেছে তারা অহিংসা ও সর্ব জীবে শান্তির আদর্শে বিশ্বাসী বৌদ্ধধর্মের প্রচারক মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীননাদর্শ ও জীবন ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানেন না বা জানলেও মানেন না।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বৌদ্ধ ধর্মের জন্মভূমি মিয়ানমার বা আজকের কোন বৌদ্ধ-প্রধান দেশ নয়। বৌদ্ধ ধর্মের আদি জন্মভূমি ভারত। সে দেশেই সর্ব জীবে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শে বিশ্বাসী বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তন করেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। বিখ্যাত বৌদ্ধ গবেষক বিশ্বেশ্বর চৌধুরী তাঁর “টেকনাফ থেকে খাইবার” গ্রন্থে বলেছেন, ভারতবর্ষের যত্রতত্র প্রতœতাত্বিক কার্যক্রমে মাটি খুঁড়লেই যে বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়া যায়, তাতে প্রমাণিত হয়, একদা বৌদ্ধ ধর্মই ভারতবর্ষের জনগণের প্রধান ধর্ম হয়ে উঠেছিল। কিন্তুু পরবর্তীতে এক কট্টর হিন্দু শাসকের শাসনামলে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধদের উৎখাতের লক্ষ্যে যে অভিযান পরিচালিত হয়, তাতে ধর্মীয় আবহ সৃষ্টির লক্ষ্যে এক শ্রেণীর হিন্দু ধর্ম নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে প্রচার করা হয়, কোন বৌদ্ধকে দেখা মাত্র যে তাকে হত্যা করবে, সে পরকালে স্থায়ীভাবে স্বর্গলাভে ধন্য হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোন বৌদ্ধকে দেখা সত্তে¡ও তাকে হত্যা করবে না, সে মৃত্যুর পর অনন্তকাল নরক যন্ত্রণা ভোগে বাধ্য হবে।
ধর্মীয় আবহ যুক্ত এই বিধান কার্যকর করার লক্ষ্যে ভারতবর্ষের সর্বত্র তখন যে নৃশংস বৌদ্ধ নিধন অভিযান শুরু হয়, তার কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে বৌদ্ধরা উত্তরে তিব্বত-চীন, পূর্বে মিয়ানমার (বার্মা), থাইল্যান্ড, জাপান এবং দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা (সিংহল) প্রভৃতি দেশে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। এ কারণে ঐসব দেশ কালক্রমে বৌদ্ধ প্রধান দেশে পরিণত হয়। যারা কোনক্রমেই দেশত্যাগ করতে সক্ষম হন না, তারা দেশে থেকেই দলিত বা হিন্দু সমাজের নি¤œ বর্ণের অনুসারী হয়ে কোন মতে টিকে থাকেন। ইতোমধ্যে সমুদ্র পথে উপমহাদেশের এ অঞ্চলের সঙ্গে সাম্যভ্রাতৃত্বের ধর্ম ইসলামের যোগাযোগ ঘটলে সাবেক বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারীদের অনেকেই এই দুই ধর্মের সাদৃশ্য বিবেচনায় ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে আজ যারা মুসলমান হিসাবে পরিচিত, এ কারণে তাদের অনেকেরই পূর্ব পুরুষ ছিলেন বৌদ্ধ।
বৌদ্ধধর্মের এই ইতিহাস জানা থাকলে মিয়ানমারের তথাকথিত বৌদ্ধ শাসক ও উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুরা উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল (রাখাইন) থেকে রোহিঙ্গা নির্মূলে উন্মুক্ত হয়ে উঠতেন না। আসলে আরাকানের সঙ্গে ইসলামের যোগাযোগ শুরু হয় আরব থেকে সমুদ্র পথে আসা সওদাগরদের মাধ্যমে মিয়ানমারে বর্মীদের আগমনের শত শত বছর আগে থেকে।
মিয়ানমারে যেভাবে বৌদ্ধদের আগমন হয় সে ঐতিহাসিক পটভূমি ইতোমধ্যেই আমরা আলোচনা করেছি। সে আলোচনায় মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মের আগমন যে বৌদ্ধধর্মের আদি জন্মভূমি ভারত থেকেই ঘটেছিল, সে সত্য ফাঁস হয়ে যাবার ভয়েই সম্ভবত গত ২৫ আগস্ট নতুন করে মিয়ানমারে শুরু করা রোহিঙ্গা-খেদাও অভিযান শুরু হওয়ার সাথে সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সে দেশে শুভেচ্ছা সফরে যান এবং সে অভিযানের সঙ্গে তাঁর রহস্যজনক একাত্মতা প্রকাশ করেন।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট সকলের মনে রাখা উচিৎ, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। সাময়িকভাবে কেউ ইতিহাসের সত্য চাপা দিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে ইতিহাস তাঁর আপন অদম্য শক্তিতে উদভাসিত হয়ে উঠে বহুল প্রচলিত কল্পিত ধ্যান-ধারণাকে পাল্টে দেয়। ইতিহাসের এই নিজস্ব অদম্য শক্তির আলোকেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বৌদ্ধ ধর্মের আদি জন্মভূমি ভারত থেকে কীভাবে কোন্ পটভূমিতে বৌদ্ধধর্মালম্বীরা উত্তরে তিব্বত, চীন, পূর্বে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, জাপান এবং দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি আজকের বৌদ্ধ প্রধান দেশে বৌদ্ধধর্মালম্বীরা প্রাণ বাঁচতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং বৌদ্ধ ধর্মের আদি জন্ম ভূমি ভারতে আজ কেন কোন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খুঁজে পাওয়া যায় না, তাঁর রহস্য উদঘাটিত হবে।



 

Show all comments
  • Stupid Buster ২৭ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:৪০ পিএম says : 2
    Before appearing of Buddhizom, there were only Hindu in this territory-- Based on your theory, ancestors of all Muslim, Buddhist etc were Hindu--
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ