Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সংলাপে অর্জিত আস্থা ধরে রাখার পরামর্শ নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের

শেষ হলো ইসি সংলাপ-- ভোট সুষ্ঠু করতে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা নয়

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে গতকাল মঙ্গলবার শেষ হলো একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত ইসি সংলাপ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে দেড় মাসব্যাপী চলা ধারাবাহিক সংলাপে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল ও নারী নেত্রীদের কাছ থেকে আসা প্রস্তাবগুলো নিয়েই বিশেষজ্ঞদের মত নেয়া হয় শেষ দিনের সংলাপে। বিশেষজ্ঞরা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কমিশনের জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করলেও এরইমধ্যে দলগুলোর আস্থা অর্জনে সক্ষম ইসির জন্য এটি অসম্ভব নয় বলেই মত দেন পরামর্শ সভায়। তবে এক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় কিছুটা ভিন্নতা আনার পরামর্শ দেন তারা। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা না করে ইসির নিজস্ব লোকদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দেন। সেইসঙ্গে ভোটের আগ পর্যন্ত দলগুলোর নিকট থেকে অর্জিত আস্থা ধরে রাখার পরামর্শও দেন কেউ কেউ।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত ইসি সংলাপে অংশ নিয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এসব পরামর্শ দেন। সিইসি কেএম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে সংলাপে অপর চার কমিশনার ও ইসি সচিব উপস্থিত ছিলেন। সংলাপে সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ৭ জন কমিশনারসহ ১৬ জন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অংশ নেন।
সাবেক সিইসি আব্দুর রউফ তার প্রস্তাবে স্থায়ী ভোট কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রতি ৫শ’ ভোটের জন্য একটি করে ভোট কেন্দ্র স্থাপনের পরামর্শ দেন। এসব ভোটকেন্দ্র ভোটারদের মাধ্যমে পরিচালনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ভোটাররা ভোট দেবেন, যারা নির্বাচিত হবেন তারা ক্ষমতায় যাবেন। জনগণ হচ্ছে ভোটের মালিক, তারাই ভোট চালাবে। ভোটের দিন এসপিও থাকবে না, ডিসিও থাকবে না। তৃণমূল পর্যায়ে যদি ভোটাররা ভোট পরিচালনা করেন, তারাই যদি আইন-শৃঙ্খলার ভার নেন তাহলে কোনও সমস্যা থাকবে না। এসময় সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে আর নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই সিইসি।
এদিকে বর্তমান পরিস্থিতি ও পরিবেশ মেনে নিয়েই সবাইকে নির্বাচনে আসতে হবে বলে মনে করেন আরকে সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদা। তিনি বলেন, এবার যদি কেউ (কোনও দল) নির্বাচনে না আসে তাহলে মুশকিল আছে। এবার সব পার্টিকেই নির্বাচনে আসতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কমিশনের চ্যালেঞ্জ উলে­খ করে সাবেক এই সিইসি বলেন, নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জ হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। নির্বাচন কমিশনের এখন থেকে এক বছরের মধ্যে এমন কিছু করা যাবে না তাতে আস্থা বিনষ্ট হয়। কমিশনের প্রতি আস্থা তো হয়েই গেছে, এটাকে ধারণ করতে হবে। দরকার হলে আরও পরিবর্ধন করতে হবে।
এটিএম শামসুল হুদা বলেন, প্রতিবারই নির্বাচন এলেই আমরা কিছু কিছু এটা করি, ওটা করি। ছোট ছোট পদক্ষেপে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে না। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে কার্যকরী করতে দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তা করতে হবে। এজন্য কমিশনের নিজেকেই অনেক শক্তিশালী করতে হবে। এরইমধ্যে কিছু কাজ আমাদের মধ্যে হয়ে গেছে। অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। এখন মানবসম্পদ বাড়াতে হবে। ভবিষ্যতে নির্বাচন করতে হলে নিজস্ব কর্মকর্তাদের থেকে বাছাই করে রিটানিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। আমরা এটা সীমিত আকারে শুরু করেছিলাম, এটাকে আরও ব্যাপক করতে হবে।
আইন ও বিধিবিধানের পরিবর্তন ও সংশোধন সম্পর্কে তিনি বলেন, আইন যেগুলো আছে এগুলোকে অভিজ্ঞতার আলোকে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত এবং তাদের এখতিয়ারের বাইরেরগুলো বাছাই করে করণীয় ঠিক করতে হবে। সীমানা পরিবর্তন প্রসঙ্গে শামসুল হুদা বলেন, সীমানা পুননির্ধারণের জন্য গ্রাম্য এলাকার অনেক আসন কমে যাচ্ছে আর ঢাকায় বাড়ছে। বাস্তবতা হলো এখানে কাউকেই দোষারোপ করা যাবে না। কারণ, বাংলাদেশসহ বিশ্ব এখন শহরমুখী। এজন্য এই সমস্যার সমাধান করতে হলে সব দলের সঙ্গে কথা বলে সংবিধান পরিবর্তন করে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের একার বিষয় নয়। এখানে অনেক প্লেয়ার আছে। এখানে রাজনৈতিক দলেরও বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। গত নির্বাচনে বয়কটের কারণে অনেক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য এবার রাজনৈতিক দলের সজাগ থাকতে হবে। সবাই যেন নির্বাচন করেন। সেই মনোবৃত্তি সবার মধ্যে থাকতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনে রাজনৈতিক দলের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থার মধ্যে এটা করতে হবে। বিচারবিভাগ এখন সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট এখন কেবল জুডিশিয়াল সার্ভিসের লোকজন হন। এখানে সেনাবাহিনীকে ওই ক্ষমতা দেবেন কী করে। বিদ্যমান আইনে যেভাবে আছে তার বাইরে গিয়ে সেনা মোতায়েন করা যাবে না।
সাবেক কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, দলগুলোর মধ্যে যে গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে তা মিটিয়ে সবাইকে নির্বাচনে আনতে একটি উদ্যোগ কমিশন নিতে পারে। কারণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা তাদের দায়িত্ব। এই নির্বাচন করতে সবাইকে নিয়ে কথা বলতে পারে। তবে এই উদ্যোগ যে সফল হবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই। এটা ফেল করলে কমিশনকে দায় দেয়া যাবে না। তিনি বলেন, নির্বাচনে যারা দায়িত্ব যারা পালন করবেন তাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে। তারা নিরপেক্ষ না থাকলে যতই উদ্যোগ নেওয়া হোক তা কাজে লাগবে না। এজন্য যাদের নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হবে তাদের আগে থেকে সিলেক্ট করে মোটিভেট করতে হবে। প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
সাবেক কমিশনার শাহ নেওয়াজ ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের দিয়ে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিদ্যমান আইন ও সংবিধান যেটি আছে সেটিই যথেষ্ট। এর বড় কোনও পরিবর্তন দরকার আছে বলে মনে হয় না। কমিশনের মূল লক্ষ্য থাকবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা। যেহেতু সংলাপে সব দল অংশ নিয়েছে, আশা করা যায় তারা নির্বাচনেও অংশ নেবেন। এজন্য নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু করার বিষয়ে কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে।
বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসাই ইসির বড় চ্যালেঞ্জ -সিইসি
আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে নিয়ে আসাই নির্বাচন কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সচিবদের সঙ্গে সংলাপকালে এ কথা বলেন সিইসি।
এদিনের সংলাপে সাবেক সিইসি বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ ও এটিএম শামসুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন, এম সাখাওয়াত হোসেন, মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, মো. শাহনেওয়াজ, সাবেক ইসি সচিব ড. এএফএম মহিউর রহমান, সাবেক আইজিপি মোহম্মদ হাদীস উদ্দীন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবদুল করিম, সাবেক সচিব এএসএম ইয়াহিয়া চৌধুরী, মনজুর হোসেন, হুমায়ুন কবীরসহ সাবেক স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, পুলিশ ও মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা অংশ নেন।
সংলাপের শুরুতেই বর্তমান সিইসি কেএম নুরুল হুদা বলেন, এখানে যারা উপস্থিত আছেন, তারা প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসেবে কাজ করেছেন, নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। গত তিন মাসে আমরা অনেক পরামর্শ, প্রস্তাব গ্রহণ করেছি। ভারী ভারী অনেক কথা শুনেছি। আজ আপনাদের পেয়ে বেশ হালকা অনুভব করছি। সংলাপে সাবেক সিইসি বিচারপতি আবদুর রউফ বলেন, বর্তমান ইসির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিরপেক্ষতার প্রমাণ করা। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ লোকদের ভোটের কাজে নিয়োজিত করা দরকার। সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। আরেক সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদা সংলাপে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে মানবসম্পদ উন্নয়নের পরামর্শ দেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন সংলাপকালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২২টি ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব দেন। নির্বাচন চলাকালে নির্বাচন কমিশনের অধীনে সেনাবাহিনী রাখার পক্ষে দেন এ সাবেক কমিশনার। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ভোটের আগে ও পরে মাঠে সেনা মোতায়েন রাখতে হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে রেখেই। যথা সম্ভব নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব দেন সাবেক কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ