হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
উঁচুনিচু টিলার ফাঁক দিয়ে পূর্বাকাশে সূর্য যখন উঁকি দিচ্ছে তখন আমরা উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্পের প্রবেশ পথে এসে থামলাম। কাদা-পানিতে থকথকে রাস্তায় পা রাখা মুশকিল। তার উপর শত শত মানুষের অবিরাম চলাচল, সামনে অগ্রসর হওয়া সহজ নয়। আমরা রাজশাহী থেকে উখিয়ায় পৌঁছেছি সন্ধ্যায়। রাতেই স্থানীয় মিলিটারি ক্যাম্পের কমান্ডিং অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ করে রিলিফ সামগ্রী বিতরণের স্থান কাল সম্পর্কে পরামর্শ নেয়া হয়েছে। সেই মোতাবেক রাতেই আমাদের ত্রাণসমগ্রী ভর্তি বিশাল ট্রাকটি ক্যাম্পের মুখের কাছাকাছি জায়গায় রাখা হয়েছে। সকালে আমরা পৌঁছে ট্রাকটিকে আরো খানিকটা ভিতরে সুবিধাজনক স্থানে দাঁড় করালাম। ত্রিপল ঢাকা ট্রাক দেখে শত শত নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ মুহুর্তে ট্রাকের আশেপাশে জমায়েত হয়। কিন্তু কোন কোলাহল, হৈ চৈ নেই। সবাই প্রায় নির্বাক ও বিধ্বস্ত। চারদিকে ঘুরে ফিরে দেখছি, পরিস্থিতি বুঝবার চেষ্টা করছি। এখানে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের পাশ কাটিয়ে অগণন মানুষ কাদাপানি মাড়িয়ে পিঁপড়ার সারির মত কোথায় যেন যাচ্ছে। তাদের বিমর্ষ, মলিন মুখচ্ছবি দেখে কোন কিছু আন্দাজ করা যায় না।
আমাদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের কাজে সহায়তা করার জন্য আগে থেকেই স্থানীয় দু’জন যুবকের সাথে যোগাযোগ করা ছিল। তারা ফয়সল ও ইউসুফ। এরা দু’জনেই রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মুহিবুল্লাহ ছিদ্দিকির চেনাজানা এবং এ এলাকার প্রভাবশালী ভদ্রলোক। তারা আগে ভাগেই এসে হাজির হয়েছিলেন। কাজের কৌশল নিয়ে তাদের সাথে কথা হল। আগের রাতেই তারা যাদের ত্রাণ দেয়া হবে, ঘুরে ঘুরে তাদের হাতে স্লিপ ধরিয়ে দিয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় কথা বলে যারা স্লিপ পেয়েছে তাদের সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে বলেন তারা। কথামত কাজ হয়। সাত আটটি দীর্ঘ সারি মুহুর্তে তৈরি হলো। সূর্য তখন টিলার মাথা ছেড়ে উপরে উঠে গেছে। আমাদের টিমের অন্যতম সদস্য ড. ইফতিখার ট্রাকের ত্রিপল খুলে ফেলার অনুমতি চাইলেন। আমি ইশারায় সম্মতি দিলাম। ড. ইফতিখার ট্রাকের কাছে গিয়ে ভলান্টিয়ারদের ত্রিপল সরিয়ে ফেলার হুকুম দিলেন। এ দিকে সারিবদ্ধ লোকদের মধ্যে একটু চাঞ্চল্য দেখা গেল, সবাই নড়ে চড়ে দাঁড়ায়। শিশু ও নারীদের একটিই সারি এবং তা দীর্ঘতম। কারো কোলে বাচ্চা, কারও একটা কোলে, আরো দুটো সাথে মায়ের কাপড় ধরে দাঁড়িয়ে। অন্য সারিগুলোতে বালক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত নানান বয়সী মানুষ। এদের চোখে তখনো ক্লান্তি ও আতঙ্কের ছাপ। পরনের কাপড়ে কাঁদামাটি লেগে রয়েছে। চুল এলোমেলো। ফয়সালের কাছে জানলাম, এরা বিগত দুই-তিন দিন ধরে এখানে এসেছে, সকলেই পথচলার ধকলে কমবেশি ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। আমি এসেই শুনেছি এই রিফিউজিদের মধ্যে অনেক গুণীমানি, আলেম-উলেমা, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্ট লোকজন রয়েছেন। আমি মনে মনে এদের খুঁজতে থাকি, সারিগুলোতে নজর বুলাই। ইতোমধ্যে ট্রাক থেকে ত্রাণের প্যাকেট এনে আমার কাছে জমা করা শুরু হয়েছে। বিতরণের কাজ এখনি শুরু করতে হবে। লাইনে দাঁড়ানো লোকজনও উসখুশ করছে। এই মুহুর্তে আমি উচ্চস্বরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানতে চাইলাম, যে এখানে কোন শিক্ষক, আলেম বা সমাজের মুরুব্বী কেউ আছেন কিনা। থাকলে সামনে এসে দাঁড়াতে অনুরোধ করলাম। বিভিন্ন লাইন থেকে একে একে ৫/৬ জন জয়ীফ লোক আমার সামনে এলেন। তারা সবাই বৃদ্ধ, পলিত কেশ, মুখে পাকা দাড়ি, চোখের কোণে কালি, বয়সের ভারে অনেকখানি কাবু হয়ে পড়েছেন। সবার মাথায় টুপি। যাকে সব থেকে প্রবীণ মনে হলো তার পরিচয় জানতে চাইলাম কাছে ডেকে। জানলাম তিনি ওপারের একটি মাদরাসার প্রিন্সিপাল। মাদরাসাটি কয়েকদিন আগে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পুড়িয়ে দেয়। ছাত্র ও ওস্তাদরা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। প্রিন্সিপালকে আপাদমস্তক আরেক নজর দেখে নিলাম। পরনে সাধারণ লুঙ্গি, গায়ে ঘামে ভেজা ময়লা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপিটি ততোধিক ময়লা। আর যে আলেমগণ পাশে দাঁড়িয়ে; জানলাম তাদের একজন জুমআর খতিব, একজন মুয়াজ্জিন, বাকী দু’তিনজনও হক্কানী আলেম। এরা সবাই বিগত ২/৩ দিনের মধ্যে এসেছেন। এখনো অনেকে থাকার ঠিকানা খুঁজে নিতে পারেননি। অনেকটাই ভাসমান। ত্রাণ সামগ্রীও তেমন কিছু পাননি। খুব যে কষ্টে আছেন বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আসার পথে কক্সবাজারের দোকান থেকে সুন্দর একটা জায়নামাজ কিনেছি। ইচ্ছা ছিল কোন একজন বিশিষ্ট আলেম, খতিব বা মুয়াজ্জিনকে এটা উপহার দেব। তার পরই রিলিফ বণ্টন শুরু করবো। উপস্থিত অন্যান্যের মধ্যে মাদরাসার প্রিন্সিপাল সাহেবকে অত্যন্ত পরহেজগার ও সম্মানীয় আলেম বলে প্রতীয়মান হলো। তাই তাকে উপযুক্ত মনে করে তার হাতে তাজিমের সাথে জায়নামাজটি তুলে দিয়ে বিতরণের কাজের বিসমিল্লাহ করলাম। মুখ দেখে মনে হলো জায়নামাজটি তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে এবং তিনি খুশি হয়েছেন। সমবেত সকলের উদ্দেশ্যে সামান্য কয়েক বাক্য আশার বাণী শুনিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলার সাথে ত্রাণ সামগ্রী নেয়ার অনুরোধ করলাম। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ড. ইফতিখার। একটা ত্রাণ সামগ্রী ভর্তি ব্যাগ প্রিন্সিপাল সাহেবের হাতে ইফতিখার, আমি ও অন্য একজন মিলে তুলে দিলাম। ড. ইফতিখারের নির্দেশে দ্রুত ব্যাগ নামাতে থাকে ভলান্টিয়াররা। আর অন্য দু’জন স্লিপ দেখে দেখে ব্যাগ দিতে থাকে। ব্যাগের মধ্যে চাল ডাল চিনি সুজি মুড়ি চিড়া মগ, গ্লাস লাইটার সাবান মোমবাতি প্লাস্টিকের পট এবং মহিলা ও শিশুদের জন্য ২/৩ প্রস্ত করে কাপড় (পুরাতন) ইত্যাদি। ত্রাণের ব্যাগ হাতে দিতে দিতে দু’একজনের সাথে আমি দু’একটা কথা বলি। হাল হকিকত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। ওদের জবাবে যা শুনলাম তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও বেদনাদায়ক। অধিকাংশই গভীর দুঃখ-বেদনার আঘাতে মুহ্যমান। কথা বলার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছেন। আমি মূলত বিপদগ্রস্ত ভাই বোনদের কিছু ত্রাণ দিয়ে সাহায্য করতে হৃদয়ের টানে এসেছি, কিন্তু এই সুবাদে সমাজবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে গণহত্যা ও গণ-দেশান্তরের নানাদিকও বুঝতে চাইলাম।
সাজানো ঘরবাড়ি ফেলে নিকটজনকে হারিয়ে তাদের বাকরুদ্ধ অবস্থা। মনে হয় বুকে অনেক কথা, বহু কষ্ট জমে আছে; কিন্তু ওরা এতোটাই মর্মাহত, ট্রমাটাইজড যে কমই কথা বলতে পারছে। বিশেষভাবে মহিলা, যাদের সাথে ২/৩ এমনকি চারটি শিশু সন্তান আছে- কিন্তু কোন পুরুষ সঙ্গী নেই স্বামী/পিতা হয় নিহত নয়তো নিখোঁজ- তারা খুবই ব্যাথাতুর এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যেমন প্রিন্সিপাল সাহেবের এখন থাকার কথা ছিল অফিস কক্ষে বা শ্রেণি কক্ষে, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! তাকে ময়লা কাপড় পরে দাঁড়াতে হয়েছে সাধারণ লোকদের রিলিফের সারিতে। শুনলাম দুশমনরা বহু আলেমকে, কোরানে হাফেজকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তার মতো আরো অনেকেই আছেন যারা বিশিষ্ট মানুষ, সমাজে গণ্যমান্য লোক, বড় ব্যবসা-বাণিজ্য, টাকা-পয়সা প্রচুর ছিল। কিন্তু তারাও অনেকের মত দৌড়ের মধ্যে, আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। সেই ঘোর মনে হয় এখনও কাটেনি। কেউ স্বামীকে নিহত হতে দেখেছেন, কারও সন্তান চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছটফট করতে করতে নিঃস্তব্ধ হয়ে গেছে। কেউ স্ত্রী/কন্যার সম্ভ্রমহানী প্রত্যক্ষ করেছেন। এরকম বহু বহুজন রক্তাক্ত প্রিয়জনের লাশ পিছনে রেখে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘর ছেড়েছেন। পাহাড়ে-বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন। মোটকথা, এখানে আগত সব মানুষই যে হতবিহ্বল, নাস্তানাবুদ অবস্থায় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আস্তে আস্তে আমাদের সামনে সারিবদ্ধ মানুষের সংখ্যা কমে আসে। এক সময় সারি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তখনো আশেপাশে বহু ব্যাকুল চোখ, আমাদের ঘিরে রেখেছে নির্বাক, নিশ্চুপ। আমাদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ বিনা ঝঞ্ঝাটে শেষ হলো। কিন্তু দেখলাম- বহু ক্ষুধার্ত শোকাতুর ক্ষুধার্ত ও কষ্টক্লিষ্ট চেহারার নারী শিশু ও পুরুষেরাÑ যাদের বেশিরভাগই বয়ঃবৃদ্ধ- আমার মুখের পানে তাকিয়ে আছেন। তারা কোন স্লিপ পাননি, তাই কপালে জোটেনি কোন রিলিফ সামগ্রী। তাদের হয়ত কোন খাবার নেই, অথবা রান্নার উপকরণ নেই। উপবাসে কাটছে দিন। তাঁরা অসহায় দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়েই আছেন। আমরা ওদের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, কেননা তাদের বিহ্বল দৃষ্টি দেখে আমরাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ যেন একটা অব্যাখ্যেয় বেদনাবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সুন্দরভাবে রিলিফ বিতরণে আনন্দটুকু মুহুর্তে উবে গেল। হতাশ ও প্রত্যাশী মানুষের তুলনায় আমাদের সামগ্রী ও প্রয়াস কতটা যে সামান্য ও অকিঞ্চিতকর তা অনুভব করলাম। ওদের সকলের বেদনাবিধুর মুখের উপর দিয়ে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে। অনেকেই তখনো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু কোন কথা বলছে না। খেয়াল করলাম ট্রাকের অদূরেই মাটিতে পলিথিন শিট বিছিয়ে ২০/২৫ জন মহিলা, গৃহবধূ, চুপচাপ বসে আমাদের রিলিফ বিতরণ দেখছেন। তাদের সকলের পরনে কালো বোরকা, মুখে নেকাব- কেবল চোখ দু’টো খোলা। কারও কোলে, এপাশে ওপাশে শিশু সন্তান। তাদের মুখের অভিব্যক্তি বোঝা গেল না, তবে চোখের চাহুনিতে যে ব্যাকুলতা ফুটে উঠেছে, তাতেই মনে হলো হয়ত একটা কিছু বলতে চায়, পেতে চায় কিন্তু মুখ খুলছে না। এইসব নারী শিশুদের পাশে দেখি ৯/১০ বছর সুশ্রী চেহারা একটি বালক মলিন মুখে, উদাসচোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার চেহারায় কিছুটা মঙ্গোলিয় আভাস, চোখ মুখ চুল ময়লা উসকু-খুশকু, হাটুতে হাতের এখানে ওখানে শুকনো কাদা লেগে রয়েছে। বোধকরি আমার দিকে তাকিয়ে মনে করছে, এই পাকা চুল গোঁফওয়ালা লোকটাই সব জিনিষপত্রের মালিক-মোখতার। কিন্তু আমার কাছে কিছু চাইবার সাহস তার নেই। ওর সম্পর্কে আমার মনে কৌতূহল জাগে। ইশারায় কাছে ডাকলাম। জানতে চাইলাম, কী খেয়েছো, এখানে কবে এসেছো, সঙ্গে কে আছে, কোথায় থাকছো কী নাম ইত্যাদি। বুঝলাম দিন দু’য়েক আগে এখানে পৌঁছেছে। যুৎসই কোন থাকার জায়গা পায়নি। তার মা মারা গেছে। সঙ্গে কিশোরী এক বোন রয়েছে, আর আছে প্রৌঢ় বাবা, তিনি খুবই অসুস্থ। তেমন খাদ্যখানা জোটেনি কাল থেকে। বাবাকে দেখাশুনার জন্য বড় বোনকে অদূরে কোন এক জায়গায় রেখে সে খাদ্যের সন্ধানে, কিছু পাওয়ার আশায় এসেছে। কিন্তু সে কোন স্লিপ পায়নি, ত্রাণও পায়নি। ওর নাম কাশিম। পিতার নাম আব্দুর রহমান। ওর পিতার নাম শোনামাত্র এক বিস্ময়কর অপত্যবোধ আমার মধ্যে মুহুর্তে জেগে উঠলো। আমার নামে এ বালকটির বাবার নাম। আমার পুত্রের মুখ মনে পড়ে গেল। পাশাপাশি দু’টি মুখচ্ছবি। মনে হল আমার পুত্র আল্লাহর মর্জিই বেশ আরামে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটায়। রোজ কত রকম খাবার খায় কিছু অপচয়ও করে আর এই ছেলেটি এক মুঠো খাদ্যের জন্য, অসুস্থ পিতা ও বড় বোনের খাবারের জন্য আমারই সামনে দাঁড়িয়েÑ অসহায়, হতাশ দৃষ্টিতে। আমার বুকের ভেতরটা বেদনায়, এক অদ্ভুত যন্ত্রণায় হু হু করে উঠে। কাশিমের মায়া ভরা মুখটা আমার দু’চোখ অনিরুদ্ধ অশ্রুতে ভিজিয়ে দিলো। আমি পাশে দাঁড়ানো ড. ইফতিখারকে বললাম, দেয়ার মত আর কতটা ব্যাগ রয়েছে। তিনি অনুচ্চস্বরে জানালেন এখনো গুটি কয়েক ব্যাগ স্টক হিসেবে ট্রাকে রয়েছে। ড. ইফতিখার আমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় অর্থপূর্ণ চোখে তাকান। স্লিপের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন, ফয়সালের হাতে এখনো কয়েকটি স্লিপ আছে। ফয়সালকে ডেকে দু’তিনটা স্লিপ নিলাম। একটা স্লিপ কাশিমের হাতে দিলাম। চোখের পলকে ওর চোখে মুখে একটা খুশির ঝিলিক লক্ষ করলাম। স্লিপ নয় যেন আসমানের চাঁদ হাতে পেয়েছে। আর ড. ইফতিখারের ইশারা পেয়ে একটা ব্যাগ নিয়ে হাজির হয় ভলান্টিয়ার। কাশিমের হাতে তুলে দিলাম ব্যাগটা। কৃতজ্ঞতায় আনন্দে ওর মুখচ্ছবি ক্ষণিকের জন্য বদলে গেল। ওর নিজের ওজনের সমান হবে ব্যাগটার ওজন। বহু কষ্টে তা মাথার উপর নিয়ে অবিলম্বে সে প্রস্থান করে। আমার মনের মধ্যে একটা ভিন্ন রকমের পরিতৃপ্তিবোধ কয়েক মুহুর্তের জন্য ঢেউ খেলে যায়। অদূরে দাঁড়িয়ে ড. ইফতিখার বিষয়টা সম্ভবত: লক্ষ করছিলেন। তিনি কাছে এসে কানে কানে বললেন, ভলান্টিয়ারদের জন্য আলাদা করে রাখা ব্যাগ ছাড়াও আরো কয়েকটা ব্যাগ আমাদের হাতে আছে। তাছাড়া অ-প্যাকেটকৃত কিছু সামগ্রী বস্তায় বস্তায় রয়েছে। আপনি ইচ্ছা করলে...। এই কথার মাঝে দু’জন কিশোরী, বয়স ১১/১২ বছর মত হবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সামনে এসে দাঁড়ায়। ওরা সম্ভবত: কাশিমের বিষয়টা লক্ষ করেছে। তাই আমার উপর ভরসা করে কাছে আসবার সাহস করেছে। ওরা মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখ তুলে দু’একবার তাকায়। ওদের মুখে ভাষা নেই, শুকনো ঠোঁট, কিন্তু চোখের ভাষা যেন তাদের অসীম দুঃখ-দুর্দশার এক মহাকাব্য মেলে ধরতে চাইছে। ওদের একজনের গায়ে যে পোষাক তা ময়লা আধভেজা, হাটু অবধি লম্বা। তার নিচে কাদা মাটিমাখা। ওদের একজনের না আঁচড়ানো এলোমেলো ময়লা চুলে আস্তে হাত রেখে নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কী? একটা নাম বলল, কিন্তু এখন আর মনে পড়ছে না। তার মুখের ভাষা দুর্বোধ্য- তবে ক্ষুধার্ত- কিছু সাহায্য চায়। তার মা-বাবা কোথায় জিজ্ঞাস করলাম। চোখ ছল ছল করে মেয়েটি জবাব দেয়, বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে জঙ্গল থেকে নেমে আসা হাতির দল তাদের তাড়া করে এবং তার পিতাকে হাতি পিষে মেরে ফেলেছে। শুনে হতভম্ব হলাম। জানলাম, ওর মা ও ছোট ভাইবোনেরা আশেপাশেই রয়েছে। কিন্তু কেউ তাদের দিকে তাকায়নি, কিছু জোটেনি কপালে। তার হাতে একটা স্লিপ দিয়ে আমি ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সেন্টু ও জার্জিসকে ইঙ্গিত করলাম। একটা ব্যাগ বালিকাটির হাতে তুলে দিলাম। খুশিতে আপ্লুত মেয়েটি জনতার ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। তার সাথের অন্য বালিকাটি তখনো অধঃবদনে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর গায়ের জামাটা বেশ দামি মনে হলো। হাতে কারুকাজ করা, চেহারাও উজ্জ্বল কিন্তু বিধ্বস্ত। কোন স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান হবে তা মুখ দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু কঠিন নিয়তি তাকে আজকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। দ্রুত মেয়েটির হাতে একটা স্লিপ দিলাম। লম্বা পায়ে ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল সে, একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে জনারণ্যে মিলিয়ে গেল।
মাথার উপর তখন রোদ বাড়ন্ত, খোলা ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে জার্জিস ও আরো দু’জন। ওদের চোখ মুখ ঘামে ভিজে গেছে। কপালে চিপের পাশে ফোটা ফোটা ঘামে রোদ পড়ে চিকচিক করছে। শত শত প্যাকেট নামিয়ে দিতে গিয়ে ওরা দারুণ পরিশ্রম করেছে। কিন্তু কোন ক্লান্তি বা বিরক্তি তাদের চোখে মুখে দেখলাম না; বরং এইসব কাজ করতে পেরে এক ধরনের পরিতৃপ্তির ছাপ চেহারায়। এক ধরনের প্রসন্নতা ঘাম ময়লা ছাপিয়ে মুখম-ল উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। তখন মনে হলে- ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ কথাটা কতটা ঠিক। ওরা মানুষের জন্য, বিপন্ন মানবতার পক্ষে হাসিমুখে কাজ করছে, কোন কষ্ট অনুভব করছে না। অথচ ওরা সমাজের তেমন কেউকেটা নয়, কোন রাজনৈতিক দলের জানবাজ কর্মীও নয়, সুনামের জন্য লালায়িত নয়, কোন প্রকার লাভের প্রত্যাশী নয়- ওরা সমাজের সাধারণ যুবক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রামের অল্পশিক্ষিত, তবে বড় হৃদয়ের মানুষ। বিপন্ন, বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানদের কথা শুনে তারা খুব ব্যথিত হয়েছে, সমবেদনায় মন বিগলিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের মধ্যে গভীর মমত্ববোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়েছে। তাই ঘরে স্থির থাকতে পারেনি। বেরিয়ে এসেছে সাহায্য সামগ্রী সংগ্রহের জন্য, হাত লাগিয়েছে সংগৃহীত সামগ্রী গোছানোর কাজে। দিন নেই রাত নেই- ভ্যাপসা গরমকে উপেক্ষা করে কাজ করেছে। মহানবী (স.)-এর সাহাবীদের পরবর্তী যুগের বিখ্যাত তাবেঈ ‘আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.)’-এর নামে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় মসজিদের নিচতলা দোতলায় স্তূপীকৃত চাল ডালের বস্তা, চিনির বস্তা, নানান সামগ্রী গোছানোর কাজ করছে। জমা হওয়া শত শত বস্তা কাপড় যাচাই বাছাই করা গাঁইট বাঁধার কাজ করেছে একাগ্র চিত্তে। ওদের সাথে কাজ করেছে সেন্টু, মিজান, মিঠু, ডন, তিতাস, তৌহিদ, রেজাউল করিম সাহেব ও আরও ৭/৮ জন কোরানে হাফেজ শিক্ষাক্রমে লিপ্ত কিশোর। মসজিদের ইমাম হাফেজ মওলানা রমজান আলী ও মুয়াজ্জিন হাফেজ হারুন সারাক্ষণ তদারকি করেছেন। তারও উপর দেখাশুনা করছেন স্বয়ং প্রফেসর মওলানা শামসুল আলম সাহেব। এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও খতিব তিনি। আর এই যুবকেরা ৮/৯ দিন ধরে কাজ করেই ক্ষান্ত দেননি- বলতে গেলে খেয়ে না খেয়ে মালপত্রের সাথে চলে এসেছে কুতুপালংএ। প্রায় ৯০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এই কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ যে কী বিষয় তা কেবল যারা যাতায়াত করেন তারাই জানেন। আমাদের সাথে রনি আসতে পারেনি। ওর একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল। সে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স ডিগ্রি করেছে ৬/৭ বছর আগে। কিন্তু এখনো কোন চাকরি জোটাতে পারেনি। খুব মনঃকষ্টে ভোগে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য একটা কিছু দরকার শুনে সে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করে। আর সবার আগে নিজের ভালো প্যান্ট-শার্ট জমা দিয়ে আমাদের ত্রাণ সংগ্রহের শুভ সূচনা করে। পরের ২/৩ দিনের মধ্যে নিয়ে আসে ১৪/১৫ বস্তা কাপড় ও কিছু নগদ টাকা। রনি এই টিমের সাথে আসতে চেয়েছিল, পারেনি বলে কষ্ট পেয়েছে। এরকম অতি অল্প সময়ে প্রায় দশ হাজার নগদ টাকা ও কয়েক বস্তা কাপড় সংগ্রহ করে আমার দু’জন ছাত্র-ছাত্রী রুমকি (বীরগঞ্জ) ও আলতাফ (নওগাঁ) তাঁদেরও আসার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠেনি। আমরা পথে থেকে বহুবার রনির ফোন কল পেয়েছি। কোথায় আছি, কেমন আছি জানতে চেয়েছে। তেমনি করে অনেকবার আমাদের খবরাখবর নিয়েছেন প্রফেসর মাহফুজ আখন্দ। রোহিঙ্গাদের ইতিহাস-সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ তিনি। আর্থাইটিসের ব্যাথার কারণে রিলিফটিমের সঙ্গে আসতে পারেননি। অথচ তাঁর কাছেই আমি প্রথম উচ্চারণ করেছিলাম যে, রোহিঙ্গাদের জন্য একটা কিছু করা যায় কিনা। আর সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহের সাথে সাড়া দিয়ে ছিলেন।
এদিকে সেই সাত সকাল থেকে অবিশ্রান্ত কাজ করছেন ড. ইফতিখার, কড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে খেয়াল রাখছেন সব দিকে। যেন ক্ষুধা পিপাসা ভুলে গেছেন। চোখে মুখে বিরক্তি, ক্লান্তির লেশ মাত্র নেই। নজর রাখছেন সবার প্রতি। কোনো ব্যাগ কাদায় পড়ে গেল কিনা, শৃঙ্খলাভঙ্গ হলো কিনা, একজনের প্রাপ্য অন্য কেউ নিয়ে যাচ্ছে কিনা- একজন কমান্ডোর মত সব দিকে নজরদারি করছেন। এটা তার স্বভাবসিদ্ধ আচরণ, নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের সদিচ্ছা তাঁর মজ্জাগত। সব ক্লান্তি, বিরাগ, ক্ষুধাকে ভুলে তিনদিন ধরে কাজ করছেন একই তালে। মনে হয় তার এনার্জি অনিঃশেষ। আর আমার আশেপাশে প্রায় সারাক্ষণ থাকছে তৌহিদ। যেন আমার বিশ্বস্ত নিরাপত্তা রক্ষী। খেয়াল তার সবদিকে। কাউকে ব্যাগ কাঁধে উঠাতে সাহায্য করে। পিছন থেকে সামনে যেন কেউ এসে না পড়ে তা ঠেকায়, আবার মুহুর্তে আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর ধরণা আমি বয়সের কারণে যে কোন মুহুর্তে টলে পড়ে যেতে পারি- বা অন্য কোন সমস্যা হতে পারে। কেননা সে জানতো আমার শরীর ভালো নেই। রাজশাহী থেকে যাত্রার ২/৩ দিন আগে থেকেই আমার ব্লাড প্রেসার একটু বেশি নেমে যায়, -১১০/৬২ এমএম। শুভানুধ্যায়ীদের কেউ কেউ আমাকে সরাসরি নিষেধ করেন- দূর যাত্রায় যাবেন না। প্রফেসর মওলানা শামসুল আলম সাহেবও নিরুৎসাহিত করেছেন। বলেছেন, এই বয়সে রিস্ক না নেয়াই ভালো। সব কিছু অর্গানাইজ করেছেন, এখন ছেলেপিলেরা যাক পৌঁছে দিতে। তৌহিদও ছিল নিষেধকারীদের দলে। আমাকে নানাভাবে মানা করে। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের অন্যতম সিনিয়র চিকিৎসক ডা. শামীম চৌধুরী সাহেবও প্রেসার দেখে খুব একটা উৎসাহিত করলেন না। কিন্তু আমাকে সিদ্ধান্তে অটল দেখে তৌহিদ স্থির করে যে, সে আমাদের সাথে যাবে। বলে, স্যারকে এভাবে ছাড়া যায় না, তার দেখভাল করার জন্য হলেও আমি যাব। তৌহিদ সমাজবিজ্ঞান অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। পাবনার নিভৃত গ্রামে বাড়ি। স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। অনেক রিলিফ সামগ্রী- জামা কাপড়চোপড়- সংগ্রহ করে দিয়েছে। আমার প্রতি তার গভীর অনুরাগ ও দায়িত্ববোধ দেখে অবাক হয়েছি। অথচ বেশি চিনতাম না। রিলিফ সামগ্রী বণ্টনের সময় অনেক লোকের ভিড়ের চাপে আমার সমস্যা হচ্ছে কিনা- সেজন্য কাছে কাছে থেকে আমাকে আগলে রাখছিল। খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই, বিরাম বিশ্রামের অবকাশ কম তবু এরা সকলে হাসি মুখে- ‘জীবন জীবনের জন্য’ এই প্রতীতি নিয়ে কাজ করে যায়।
(চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।