Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণতন্ত্রের বেহাল অবস্থা থেকে মুক্তি চাই

খালেদা জিয়ার আগমন : তৃণমূল নেতাকর্মী সমর্থকদের প্রত্যাশা

হোসাইন আহমদ হেলাল : | প্রকাশের সময় : ১৯ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিন মাস লন্ডনে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও তিনি চিকিৎসা শেষে দেশে এসেছেন। এতে ঢাকাসহ সারাদেশের নেতাকর্মী সমর্থকরা ব্যাপক উজ্জীবিত। গতকাল মঙ্গলবার হযরত শাহজালাল (র:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত লাখো কর্মী ও সমর্থকদের মাঝে এটি লক্ষ করা গেছে। বেগম খালেদা জিয়াকে বরণ করার জন্য ঢাকা শহর, আশপাশের জেলাসমূহের নেতাকর্মীদের সমবেত হওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ল²ীপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, বগুড়া, জামালপুর, ফেনীসহ বেশ কয়েকটি জেলার কর্মী ও সমর্থকরা নিজেদের উদ্যোগে বিমানবন্দর এলাকায় সকাল থেকে উপস্থিত থেকে দেশনেত্রীকে এক নজর দেখার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন। নেতাকর্মীদের সামাল দিতে নিয়োজিত ছিল পুলিশ, র‌্যাবসহ বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফিরছেন। তাকে ব্যাপক শোডাউনের মধ্য দিয়ে বরণের প্রস্তুতিকালে গত কয়েক দিন ঢাকা মহানগরসহ সারাদেশে অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হলেও থামানো যায়নি বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত জনতার ঢল। আপোষহীন দেশনেত্রীকে ফিরে পেয়ে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। রাস্তার দু’পাশে হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার শেষ হয়ে যায়। কর্মী-সমর্থকরা কেউ কেউ নিজেরাই হোটেল কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা দিয়ে পুনরায় রান্নার আয়োজন করিয়েছে। যার পকেটে বেশি টাকা ছিল তিনি তা বিলিয়ে দিয়েছেন। ভাই কোথা থেকে এসেছেন, খেলে খেতে পারেন এভাবে একে অপরকে আমন্ত্রণ করে উৎসবকে আরো বাড়িয়ে তুলেছেন।
মুন্সীগঞ্জ থেকে এসেছেন ৮২ বছরের নাজিরউল্লাহ। তিনি ফজরের নামাজ পড়ে ঢাকার বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকাল সাড়ে ১০টায় পৌঁছান বিমানবন্দরে। তিনি জানেন না ক’টায় আসবেন খালেদা জিয়া। অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক কোনো নেতা নন, একজন সমর্থক। পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবর থেকে জেনেছেন খালেদা জিয়া আসবেন। জীবনে আর দেখা হবে কি না তাই এ বয়সে কষ্ট সহ্য করে এসেছেন বিমানবন্দরে। কেমন আছেন- জিজ্ঞেস করতেই উত্তর, ‘ভালো নেই, দুঃশাসনে হাবুডুবু খাচ্ছি’। তিনি বলেন, ‘সময় এখন পুলিশ আর আওয়ামী লীগের। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যেমনিভাবে দেশকে ভালোবেসেছেন, তেমনিভাবে মানুষকে ভালবেসেছেন এই বৃদ্ধ নাজিরউল্লাহ। উচ্চস্বরে বলেন, ‘পত্রিকা এবং টেলিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতাদের সাজানো মিথ্যা বক্তব্য শুনলে মনে হয় দেশকে সোমালিয়ার মতো বর্বর একটি দেশে পরিণত করবে’। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছে, একদিন মরতে হবে। সামান্য ক্ষমতার জন্য বৃদ্ধ মন্ত্রীরা মিথ্যাকে জাতির কাছে তুলে ধরছে, মানুষ বুঝে না?’ ল²ীপুরের কমলনগর থেকে এসেছেন মিথ্যা একটি মামলায় পলাতক আসামি সাবেক চেয়ারম্যান এ বি এম আশরাফ উদ্দিন। বনানী চেয়ারম্যান বাড়ির একটি রেস্টুরেন্টের সামনে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথে আলাপকালে তিনি জানান, ‘আমি একজন জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান ছিলাম। আমি যাতে চেয়ারম্যান প্রার্থী না হতে পারি আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করেছে। আমি এখন ফেরারি হয়ে অর্থকষ্টে জীবন কাটাচ্ছি’। এক প্রশ্নের জবাবে আশরাফ জানান, ‘আওয়ামী লীগ বলেছে বিএনপি আন্দোলন জানে না। আন্দোলন ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় নামছে না। পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসী থামিয়ে দেন। তারপর বুঝতে পারবেন বিএনপি কত জনপ্রিয় দল। রাস্তায় রাস্তায় জনস্রোত থামানো যাবে না’। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের হাতে গণতন্ত্রের বেহাল অবস্থা। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বেহাল গণতন্ত্র থেকে মুক্তি চাই। তিনি যেন এমন কর্মসূচি দেন’।
মানিকগঞ্জ থেকে এসেছেন রিকশাচালক আব্দুল আলী। আলাপকালে তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন চাই। জীবন দিয়ে হলেও ভোটকেন্দ্র পাহারা দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করব। ৫০ ভাগ সুষ্ঠু হলেও বিএনপিকে ঠেকাতে পারবে না। দেশনেত্রীর কাছে তিনি আগামীতে আওয়ামী লীগকে খালি মাঠে গোল করতে না দেয়ার দাবি জানান। ল²ীপুরের হাজিরপাড়া থেকে এসেছেন মো: আব্দুল্লাহ। তিনি জানান, তাদের এলাকার জনপ্রিয় ফারুক চেয়ারম্যানকে গুম করে হত্যা করা হয়েছে। তারা এলাকায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তিনি কঠোর কর্মসূচি চান নেত্রীর কাছে।
গতকাল দুপুরে অসংখ্য নেতাকর্মী নিয়ে বিমানবন্দরে যাবার আগে ঢাকা মহানগর (উত্তর) বিএনপির সহ-সভাপতি এবং সাবেক ৪৫ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার আতিকুল ইসলাম মতিন বলেন, সরকারদলীয় অনেক সিনিয়র নেতাসহ অনেকেই দেশনেত্রীকে নিয়ে সমালোচনা করেছেন। অনেকে বলেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর দেশে আসবেন না। দেশের টানে তিনি ফিরে এসেছেন। এতে করে বিএনপির সকল স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। তাদের মধ্যে উদ্দীপনার শেষ নেই। এটা ধরে রাখতে পারলে আগামী নির্বাচন আমাদের পক্ষে আসবে। আমরা চাই দেশনেত্রী এবার সুদূরপ্রসারী কর্মসূচি দেবেন। তিনি আরও বলেন, আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার যা ভালো মনে করে তাই করবে। কিন্তু আইনগত ব্যবস্থার নামে নেত্রীকে গ্রেফতারের হুমকি দিয়ে ভুল করবে সরকার।
আদাবর থানা বিএনপি সভাপতি আবুল হাশেম বলেন, দেশনেত্রীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আইনগতভাবে মোকাবেলা করতেই তিনি দেশে ফিরেছেন। এদেশের মানুষের প্রতি রয়েছে তার অফুরন্ত ভালোবাসা। তিনি দেশে ফেরায় সকল স্তরের নেতাকর্মী উজ্জীবিত। সকলেই তার পরবর্তী কর্মসূচি ও দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন।
মোহাম্মদপুর থানা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আইয়ুব আলী খান বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানের নির্দেশে আমরা সকল নেতাকর্মী আজ সুসংগঠিত। সহায়ক সরকারের দাবি আমরা রাজপথে থেকেই আদায় করে ছাড়ব। আমাদের নেত্রী সুস্থভাবে দেশে ফিরে আসায় আমরা আনন্দিত এবং উজ্জীবিত। তার যে কোনো ধরনের কর্মসূচি আমরা সফল করবই।
মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। একটি ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে ১৯৮১ সালের ৩০ মে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে শাহাদতবরণ করেন। এরপর নেতৃত্বের হাল ধরেন তার সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া। এরপর এরশাদের নয় বছর শাসনামলে বেগম খালেদা জিয়ার আপোষহীন নেতৃত্ব বিএনপিকে একসূত্রে সংগঠিত করতে সাহায্য করেছে। ১/১১’র সময় বিএনপিতে সংস্কারপন্থী গ্রæপ সৃষ্টি করা হলেও পৃথক বিএনপি করার চেষ্টা সফল হয়নি। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার মামলা-হামলা, গুম-খুনসহ নানা নির্যাতন এবং ষড়যন্ত্র করেও বিএনপিকে সাময়িক সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করতে পারলেও ব্যাপক জনসমর্থন থেকে সরাতে পারেনি, দলকে বিভক্ত করতে পারেনি। বরং বিএনপি নেত্রীর আপোষহীন নেতৃত্ব দলকে ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে ক্ষমতায় এনেছে। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়া গ্রেফতারকে ভয় পান না। এর আগে তিনি চারবার গ্রেফতার হয়েছেন। ১/১১’র সময়ে তার দুই পুত্র তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকে গ্রেফতার করে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরাফাত রহমান বিদেশে মারা গেছেন। এরপর খালেদা জিয়াকে নানাভাবে নির্যাতন এবং নিজ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বর্তমানে নানা ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে এ পরিবারকে নিয়ে। এসব সঙ্কট সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন মা ও ছেলে দু’জনেই। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি দুদকের মামলা। বাকিগুলো হত্যা, নাশকতা, পুলিশের কাজে বাধা দেয়া, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ। তার ছেলে বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও ১৩০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে। ১৭ মামলায় দেয়া হয়েছে অভিযোগপত্র। এছাড়া বিএনপির মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় জেলা ও উপজেলা নেতা এবং হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে। বিএনপি এসব মামলা প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করে যাচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে দেশে ফেরায় যেমনিভাবে দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করবে, তেমনি নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দলকে শক্তিশালী করবে। আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশনেত্রীর দেয়া কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন করে বেহাল গণতন্ত্রকে আওয়ামী লীগের হাত থেকে মুক্ত করবে বলে নেতাকর্মীরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দুবাই বিমানবন্দরে বেগম খালেদা জিয়াকে আমিরাত বিএনপি নেতাদের অভ্যর্থনা
ছালাহউদ্দিন আরব আমিরাত থেকে জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে লন্ডনে চিকিৎসা শেষে বুধবার দেশে ফেরার সময় দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেন। স্থানীয় সময় সকাল ৮.৪৫ মিনিটে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ জাকির হোসেনের নেতৃত্বে নেতৃবৃন্দ বেগম খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় বেগম খালেদা জিয়া আরব আমিরাত বিএনপি ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের শুভেচ্ছা জানান এবং আরব আমিরাত বিএনপির নেতাদের সাথে কুশল বিনিময় শেষে সকলের কাছে তার জন্য দোয়া চেয়েছেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আরব আমিরাত বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল ইসলাম রিটু, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শাহেদ আহমেদ রাসেল, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, জাতীয়তাবাদী বন্ধু দলের সভাপতি নীল রতন দাস ও সহ-সভাপতি বদরুল আলম বাদল প্রমুখ। অড়াই ঘণ্টা যাত্রাবিরতির পর বেগম খালেদা জিয়া দেশের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। এ সময় স্থানীয় বিএনপির উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়াকে বিদায় জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণতন্ত্র

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ