ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে। গত ৮ মাসে সারা দেশে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ১৯৪৪টি। বিশেষজ্ঞ মহল এবং সাধারণ মানুষের একটাই প্রশ্ন, কেন এমনটা হচ্ছে? অপরাধ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সমাজ এক ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে অস্থিরতা বিরাজ করছে। পশ্চিমা সংস্কৃতি ও বিশ্বায়ণের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবাধ তথ্য প্রবাহের দরুন ইন্টারনেট, ফেসবুক, টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে যৌন উত্তেজনাপূর্ণ ছবি দেখে অনেকে লালসা চরিতার্থের পথ খুঁজে ফেরে। ইভটিজিংও এর দরুন হচ্ছে। অথচ দেশে এ সংক্রান্ত আইন যে নেই তা বলা যাবে না। এমনকি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের তুলনায় আমাদের দেশে আইন কঠোর। নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত আইন ২০০০ সংশোধিত ২০০৩ এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তবে সে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। ৯(২) ধারায় আছে, ধর্ষণ বা পরবর্তী অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড বা জাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে। একই সাথে জরিমানার কথাও বলা হয়েছে। সর্বনিম্ন জরিমানা এক লাখ টাকা। ৯(৩) ধারায় বলা আছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং উক্ত ধর্ষণের ফলে কোন নারী বা শিশু মারা যায় তবে প্রত্যেকের জাবজ্জীবন কারাদন্ড বা মৃত্যুদন্ড এবং কমপক্ষে এক লাখ টাকা জরিমানা হবে। বেশ কিছু রায় ইতোমধ্যে আইন অনুযায়ী কার্যকর হয়েছে। তা সত্তে¡ও দুর্বৃত্তরা এ ধরনের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে।
পত্র পত্রিকার মাধ্যমে যেসব নৃশংসতার খবর আসছে তা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। আট মাসের শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ২২ মাসের শিশু কন্যাকে ধর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। ৫ বছর বয়সী শিশুর যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে ধর্ষণ করেছে ৫০ বছরের ঊর্ধ্বের এক ব্যক্তি। গত রোজায় ছোট্ট একটা মেয়েকে ইফতারের দাওয়াত দিয়ে পৌঢ় দু’ব্যক্তি ধর্ষণ করে। পত্রিকা মারফত জানা গেছে, ৬ মাস ধরে আটকে রেখে ভাতিজিকে ধর্ষণ করেছে চাচা। এসব খবর যখন শুনি তখন হতবাক হতে হয়। ভাবি, কোথায় বাস করছি আমরা। এর মূলে কি শিক্ষার অভাব, না অন্য কিছু? আমরা নিরাপত্তা দিতে পারছি না আমাদের নারীদের, শিশুদের। সা¤প্রতিক বগুড়ার ধর্ষণ ঘটনা বলে দেয় নারীদের নিরাপত্তা দিতে আমরা কতটা ব্যর্থ। আর এসবের মূলে ক্ষমতা যে একটা বড় ফ্যাক্টর, ধর্ষণ পরবর্তী মা-মেয়ের মাথা মুড়িয়ে দেওয়াই তার প্রমাণ। এই নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যখন বিদ্যমান তখনই তিন বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে এক নরপশু। কোন ভয়ই তাদের ভীত করছে না।
জানা গেছে, প্রায় ২৯ হাজার ধর্ষণ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার মামলার রায় হয়েছে। বাকী মামলাগুলোর নিস্পত্তি হচ্ছে না। এই নিস্পত্তি না হওয়ার মূলে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেমন ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু সঠিক বিচার পাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় পুলিশী সহায়তা না পাওয়ায় ভিকটিমের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক তাড়া করছে। এতে আসামিরা সাহস পেয়ে আরও উৎসাহী হয়ে উঠছে। কত ঘটনা যে বিচারহীনতা ও নিরাপত্তার অভাবে ধামাচাপা পড়ে যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজে বর্তমানে এ ধরনের ঘটনা বিস্তারে সবারই অভিমত, দেশ এই মুহুর্তে একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে ঠিকই, সে অস্থিরতা না হয় যুবকদের মধ্যে বেশি মাত্রায় সংক্রামিত, তা বলে পঞ্চাশোর্ধ্ব পৌঢ়ের মধ্যে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করছে? এক্ষেত্রে মানসিকতাটাই বড়। এসব লোক বিকৃত রুচির শিকার। এদের এবং বাকীদের স্বল্প-দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদী ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম ঢেলে সাজাতে হবে। যদি এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটানো যায় তবে এ ধরনের অপরাধ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং অপরাধীরা যথাযথ শাস্তি না পাওয়ায় অন্যরাও অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে যেতে উৎসাহ বোধ করছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধুতাকেও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজ স্বার্থ রক্ষায় অপরাধীদের পক্ষ অবলম্বন করে বিচার প্রার্থীদেরকে হয়রানি করে থাকে। এর পাশাপাশি নির্যাতিত পরিবার ও সামগ্রিক মানুষের সচেতনতারও অভাব রয়েছে। এসব কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এছাড়া ত্রæটিপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণেও অনেক সময় ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দোষী প্রমাণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ কেসে চিকিৎসকরা শুধু ধর্ষিতার মেডিকেল টেস্ট করান। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে মেডিকেল টেস্ট রিপোর্ট পালটানোও হয়। এক্ষেত্রে অভিযুক্তের ডিএনএ টেস্ট করার ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। একমাত্র ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধীকে সনাক্ত করা যায়। ক্ষেত্র বিশেষে অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়ে বছরের পর বছর ঘুরে ন্যায় বিচার পাচ্ছে না, আবার অনেকে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর হয়রানির শিকার হচ্ছে। ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য অনেকে নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দিয়ে হয়রানিরও চেষ্টা করে থাকেন। এক্ষেত্রে পুলিশ তদন্ত করলেও অনেক সময় প্রকৃত রহস্য উৎঘাটন সম্ভব হয়ে ওঠে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ১৯৪৪টি। এর মধ্যে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৫২টি। এছাড়া ২০১৬ সালে প্রতিমাসে গড়ে সারা দেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩৪০টি। ২০১৭ সালের প্রথম আট মাসে মামলা হয়েছে ১৯৪৪টি। এ হিসেবে ধর্ষণের মামলার সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত বছর এ মাস পর্যন্ত ৩৪৬টি মামলা হয়। এবং ঐ বছরই মোট মামলা হয় ৬০১টি। ২০১৫ সালে ৫২১টি, ২০১৪ সালে ১৯৯টি, ২০১৩ সালে ১৭০টি এবং ২০১২ সালে ৮৬টি। এ পরিসংখ্যান থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, সা¤প্রতিক কালে দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। শুধু ধর্ষণ নয় সামান্য কারণে নারীদের অকথ্য নির্যাতন করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বগুড়ায় ছাত্রী ধর্ষণ এবং ঐ ছাত্রী ও তার মাকে ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনাকে সরকারের জন্য বিষফোঁড়া বলে উল্লেখ করেছেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়েজিত নারীর প্রতি সহিংসতা, আমাদের করণীয় শীর্ষক মত বিনিময়ের সভায় একথা বলেন তিনি। নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি উদ্বেগজনকভাবে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় ইউএনডিপির হিউম্যান রাইস কর্মসূচির সহায়তায় এই মত বিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। বর্তমানে দেশের নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। ক্ষমতায়নের দিক থেকে নারীরা অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজে সর্বক্ষেত্রে তাদের সফল পদচারণা। কিন্তু তা স্বত্তে¡ও তারা পুরুষদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে। এ অবস্থা উদ্বেগজনক। কড়া হাতে এর প্রতিকার করা দরকার। বেগম রোকেয়া সেকালে নারী রক্ষা সমিতির যে প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, একবিংশ শতাব্দির বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের দিনে এসেও এখন আমাদের আবার নারী রক্ষা সমিতির কথা ভাবতে হচ্ছে। এটা যে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য কতটা অপমানজনক তা সহজেই অনুমেয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।