Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় ঐক্য ছাড়া উন্নয়ন বা আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার জন্মের শুরু থেকেই বিশ্ব গণমাধ্যমে যুদ্ধ, দারিদ্র্য, ক্ষরা-বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। তবে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মত বিশ্বমোড়লদের রাজনৈতিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করেই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অবস্থান এবং সে সময়কার বাস্তবতা থেকে বিশ্ব এখন একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে গেছে। বিগত সাড়ে চারদশকে ভারতকে আর কখনোই বাংলাদেশের জনগনের পাশে দাড়াতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমস্যায় ভারতের প্রভাব কখনো এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের পক্ষে যায়নি। বরং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগনের অধিকারের বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য করে ফারাক্কাসহ যৌথ নদীগুলোতে একের পর এক বাঁধ নির্মান করে বাংলাদেশের জন্য খরা-বন্যার উপদ্রব তৈরী করেছে ভারত। ফারাক্কা, তিস্তার পানি বন্টন, ওয়ান-ইলেভেনের রাজনৈতিক সংকট, ৫ জানুয়ারীর ভোটারবিহিন নির্বাচন থেকে সাম্প্রতিক বন্যা এবং চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যা ও শরনার্থী সংকটে ভারতের যে ভ’মিকা উঠে আসে তাকে কোন বন্ধুত্বের ছাঁচে ফেলা যায়না। রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের ভ‚মিকা এখন জাতিসংঘসহ আন্তজার্তিকভাবেও সমালোচিত হচ্ছে। পুরনো পরাশক্তিগুলো রাজনৈতিক অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছে। পক্ষান্তরে পরাশক্তিগুলোর নানা টানপোড়েন কাজে লাগিয়ে অন্য বড় রাষ্ট্রগুলো পরাশক্তির আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে নতুন বিশ্বশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সচেষ্ট রয়েছে। বড় দেশগুলোর এই রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় নতুন খেলোয়ার চীন ও ভারত। আর ভারত চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, বার্মার মত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ডেমোগ্রাফিক সংকটকে দাবার গুটির মত ব্যবহার করতে চায় এসব প্রতিদ্বন্দি আঞ্চলিক পরাশক্তি। এ খেলায় ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো সময়মত নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হলে বিপদের মুহূর্তে তাকে বন্ধুহীন হয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হতে হয়। রোহিঙ্গা শরনার্থী সংকটসহ আঞ্চলিক বিরোধে বাংলাদেশ এখন এমন বাস্তবতার মুখোমুখি দাড়িয়েছে। দেশে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য এবং সুদূরপ্রসারি ও দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক-অনৈতিক অবস্থান ছাড়া এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন আসু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা।
আমাদের জন্য আপাতত কোথাও কোন সুসংবাদ নেই। অনিশ্চয়তা, অব্যবস্থা, স্থবিরতা থেকে হতাশা ও অসন্তোষের মাত্রা যেন বেড়েই চলেছে। সব সংকটের সূতিকাগার যে আমাদের জাতীয় রাজনীতির গর্ভে আমাদের শাসকশ্রেনী যেন তা বুঝেও না বুঝার ভান করছে। তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পরস্পরকে ঘায়েল করতে গিয়ে, দুর্বল করতে গিয়ে যে দেশকে দুর্বল করে ফেলছে সে বিষয়ে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। সস্তা শ্রমশক্তির উপর ভর করে আমাদের রফতানীমুখী তৈরী পোশাক শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে একটি শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের উন্নয়ন প্রকল্পে জনশক্তি রফতানীকারক দেশ হিসেবেও বাংলাদেশের কর্মসংস্থান এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এসব অর্থনৈতিক অর্জনকে পুঁজি করে ক্রমবর্ধমান জাতীয় বাজেটের আকৃতি নিয়ে আমাদের সরকার গৌরববোধ করতেই পারে। জনগনের রাজস্ব থেকে লক্ষকোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট খরচের প্রভাব দেশের অবকাঠামোখাতে পড়বে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন দেখা যাচ্ছে নানা ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশী এগিয়ে যাচ্ছে এবং আমরা আমাদের মৌলিক শক্তি ও সম্পদগুলোও রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছি, তখন দেশের কোন চেতনাই আমাদের নতুন পুরনো প্রজন্মকে একটি অবশ্যম্ভাবি হতাশা ধেকে বাঁচাতে পারছেনা। আমরা যখন দেখি ভারতের প্রবল হুমকির মুখেও পাকিস্তান সাহসী প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাতের ঘোষনা দেয়। আমরা যখন দেখি শ্রীলঙ্কান শাসকরা হঠাৎ সাহসী পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সমৃদ্ধির নতুন সোপানে যাত্রা করে। আমরা যখন দেখি হিমালয় ও ভারতবেষ্টিত দরিদ্র দেশ নেপাল হঠাৎ করেই ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যখন দেখি অর্ধশত বছর ধরে কার্যত: বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন বার্মা বিশ্বসম্প্রদায়ের সব আহ্বান ও দাবী অগ্রাহ্য করে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে রাখাইন থেকে বিতাড়িত করতে গণহত্যার পথ গ্রহন করার পরও তাদের কিছুই হয়না। মিয়ানমারের এই রাখাইন নীতি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষনার সামিল। একদিকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, অন্যদিকে মিয়ানমারের সামরিক হেলিকপ্টারগুলো বার বার বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করার পরও বাংলাদেশ তেমন কোন প্রতিবাদ করতেও যেন কুষ্ঠিত হচ্ছে। এরপরও আমরা তথাকথিত উন্নয়নের মিথলজি শুনতে পাচ্ছি। দেশে আইনের শাসন নেই, রাজনৈতিক সহাবস্থানের পরিবেশ নেই, বহুপাক্ষিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের কোন নিশ্চয়তা বা প্রক্রিয়া না থাকায় মানুষ যখন হতাশ হয়ে পড়ছে। কোন কোন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিধিরা যখন এসব নিয়ে প্রতিবাদি ভূমিকা নিতে চাচ্ছে তখনি সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়ন ব্যহত করার হুজুগে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের উন্নয়নের পথে এমন বাস্তবতা শুধু বড় ধরনের প্রতিবন্ধকই নয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যও বড় ধরনের হুমকি। এমন বাস্তবতায় মিয়ানমারের মত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এক দেশও বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করার সাহস দেখাচ্ছে।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এমন শ্লোগান আমরা বেশ কয়েক বছর ধরেই শুনছি। পাশাপাশি আমরা এ’ও দেখছি বাংলাদেশের রাজধানী শহরটি বিশ্বের অন্যতম দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য শহরের শীর্ষ তালিকায় স্থান পাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতে শহরের ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা থেকে অভিজাত আবাসিক এলাকার রাস্তা পর্যন্ত হাঁটু সমান ময়লাপানিতে ডুবে যাচ্ছে। মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা পার হতে ২ ঘন্টা সময় লেগে যাচ্ছে। তৈরী পোশাক আমদানীকারকরাও ঢাকায় আসতে চাইছেনা। তারা বিকল্প উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে অথবা আমাদের রফতানীকারকরা ক্রেতাদের কাছে ধর্না দিয়ে, ক্রেতাদের অন্যায্য দাবী ও আবদার মেনে, মূল্য কমিয়ে পণ্য রফতানী তথা কারখানা সচল রাখার চেষ্টা করছে। এসব প্রতিকূল বাস্তবতায় টিকতে না পেরে ইতিমধ্যে শত শত গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ লোকসানের পতিত হওয়ার পাশাপাশি লাখ লাখ কর্মসংস্থানের পথও রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে কমপ্লায়েন্স ও অবকাঠামোগভাবে যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটেছে। তৈরী পোশাক খাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ার পাশাপাশি বৈদেশিক কর্মসংস্থানে দীর্ঘমেয়াদী সংকট বা বন্ধ্যাত্ব দেখা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্থগিত হওয়া, মালয়েশিয়া বা সউদি আরবের মত দেশে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা জটিলতার মত ইস্যুগুলোর সাথে দেশি-বিদেশি রাজনীতি কাজ করছে আছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছে। গত কয়েক বছরে দেশে যে সব সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে একদিকে একটি আন্তর্জাতিক রাজনীতি সক্রিয় ছিল, অন্যদিকে আমাদের সরকার এসব সন্ত্রাসী হামলাকে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের মোড়কের পাশাপাশি সরকার বিরোধি রাজনৈতিক জোটের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পিছপা হয়নি। এসব ঘটনা মিডিয়ায় অতিপ্রচারের ফলে যে আতঙ্ক ও সতর্কতা জারি হয়েছে তা’তে দেশের রফতানী বিনিয়োগ, বৈদেশিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশ্চিমা বেশ কয়েকটি দেশ ঢাকার উপর তাদের কার্গো নিষেধাজ্ঞা ও ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা এখনো অব্যাহত রেখেছে। মূলত: বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের উপর পরোক্ষভাবে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকড়ি আরোপ করতে শুরু করে। শুধুমাত্র ভারতকে নিজেদের আস্থায় রাখতে গিয়ে পশ্চিমাদের কড়াকড়ি ও হুঁশিয়ারিকে কোন পাত্তাই দেয়নি সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত ভারত বা চীনের সাথেও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। রোহিঙ্গা সংকটের মধ্য দিয়ে এ বিষয়টি বিশ্বের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। অনেক দেশ শুধুমাত্র মানবিক কারণে রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষনা দিলেও ভারত ও মিয়ানমারের মত নিকটতম প্রতিবেশিরা ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের নরঘাতক সরকারের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেছে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক স্ট্রাটেজির সাথেও সঙ্গতি রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। একটি সংকটময় মুহুর্তে বাংলাদেশের এ অবস্থানকে বন্ধুহীনতার দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্রুত বদলে যাচ্ছে। সিরিয়া যুদ্ধের পরিবর্তিত বাস্তবতায় পশ্চিমা পরাশক্তির মানচিত্র বদলের গেমপ্লান এখন ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। কুর্দিশ রেফারেন্ডামের মধ্য দিয়ে আপাতত: ইরাককে দ্বি-খন্ডিত ছক বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। যদিও ইরাক সরকার, তুরস্ক, ইরানসহ ফ্রান্সের সাথে সুর মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই রেফারেন্ডামের বিপক্ষে কথা বলেছে। শক্তিশালী প্রতিবেশী ও পরাশক্তিসমুহের বিরোধিতা সত্বেও মার্কিনীদের চিরস্থায়ী কৌশলগত ও শর্তহীন মিত্র ইসরাইলের প্রকাশ্য সমর্থন নিয়ে কুর্দি নেতা মাসুদ বারজানি সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে কুর্দি রেফারেন্ডাম ও স্বাধীনতার পথে অবিচল রয়েছেন। সিরিয়া ও ইরাককে অনেকগুলো ভাগে ভাগ করার রাজনৈতিক গেমপ্লান ছিল পশ্চিমাদের। সিরিয়া যুদ্ধে বাশার আল আসাদ সরকারকে হটিয়ে লিবিয়ার মত একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরী করে সেখানকার বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপ ও কুর্দি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো নিয়ে অনেকগুলো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বানিয়ে পাপেট সরকার বসিয়ে সিরিয়া ও ইরাককে দুর্বল করাই ছিল এই গেমপ্লানের লক্ষ্য। রাশিয়া ও চীনের হস্তক্ষেপে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য তৈরী হওয়ার কারণে বিশ্বরাজনীতির মনোযোগ এখন দক্ষিন এশিয়ার ভূ রাজনৈতিক কৌশলগত অঞ্চলগুলোর দিকেই নিবদ্ধ হওয়ার কথা। আঞ্চলিকতার কারণে এখানে আগে থেকেই চীন ও রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ থাকায় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা ইস্যু অত্যন্ত স্পর্শকার হয়ে পড়েছে। তবে সম্ভবত: রোহিঙ্গা ইস্যুতেই পশ্চিমাদের মানবিক অবস্থানের বিপরীতে চীন-রাশিয়ার ভূমিকা অমানবিক, একটি জাতিগত নির্মূল অভিযানের পক্ষে যাচ্ছে। আগামী দশকশেষে চীন যখন বিশ্বের একনম্বর অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি হয়ে উঠতে যাচ্ছে, তখন ¯্রফে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে একটি গণহত্যার পক্ষে চীনের অবস্থান বিশ্বের সামনে একটি ভিন্ন বার্তা বহন করছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধবাদি নীতির বিপরীতে চীনের যে ইমেজ এতদিন বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে গড়ে উঠেছিল রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিং ইস্যুতে চীনের ভূমিকা সে ইমেজকে অনেকটা ম্লান করে দিচ্ছে। তবে প্রাথমিক রাউন্ডে চীন মিয়ানমারের পক্ষে সাফাই গাইলেও এ অবস্থান সহসাই বদলে গিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে গ্রহনযোগ্য মধ্যস্থতাকারির ভ‚মিকায় আসতে পারে চীন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে গত কয়েকদিনে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিশেষত: মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির দপ্তরের মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এবং ৫লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রাথমিক প্রস্তাবকে একটি অপ্রত্যাশিত অগ্রগতি হিসেবে গণ্য করা যায়।
আঞ্চলিক ও আন্তজার্তি রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নিজেদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে প্রথমেই আভ্যন্তরীণ সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নের পথে অন্তরায় ও অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা একদিকে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের বানিজ্য সুবিধা স্থগিত করছে এবং তাদের নাগরিকদের ভ্রমন সতর্কতাসহ কার্গো নিষেধাজ্ঞার মত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে চীনও বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়ার পরও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানবিক অবস্থানকে অগ্রাহ্য করছে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরকারের গণতান্ত্রিক লিগ্যাসির সংকট, দলীয় স্বার্থে জাতিকে দ্বিধা বিভক্ত করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার যে কৌশল ক্ষমতাসীনরা গ্রহন করেছে তা দেশকে কার্যত দুর্বল ও বন্ধুহীন করে তুলেছে। এ সময় নানাভাবে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। শেয়ার বাজার কারসাজি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট এবং কোড হ্যাক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল তছরুপের মত ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোচিত হওয়ায় বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটি বিরূপ ধারনা তৈরী হয়েছে। বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি রাজনৈতিক সমঝোতাসহ সকল বড় দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্য ছাড়াও একাত্তুরের মানবতাবিরোধি অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াসহ নানা ইস্যুতে জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের সব দাবী উপেক্ষা করার ফল এখন ভোগ করছে বাংলাদেশ। এ অবস্থার উত্তরণে যে ধরনের রাজনৈতিক ও ক‚টনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন তা’ এখনো অনুপস্থিত। সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। বিগত নির্বাচনের ত্রুটি বিচ্যুতি ও গ্লানী মুছে দিয়ে আগামীতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের অনিশ্চয়তা দূর করার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। আমরা যখন সরকারের পক্ষ থেকে দেশের উন্নয়ন ও এগিয়ে যাওয়ার শ্লোগান শুনছি তখন আমরা দেখছি আধা ঘন্টার বৃষ্টিতে ঢাকার রাজপথ হঁাঁটুপানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। তীব্র যানজটে দশ মিনিটের রাস্তা পার হতে ২ ঘন্টা সময় লাগছে ইত্যাদি। বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী যুদ্ধবিদ্ধস্ত শহরগুলোর সাথে শীর্ষ স্থান লাভ করছে। সম্প্রতি ঢাকার পুলিশ বিভাগ কয়েকটি রাস্তায় উল্টোপথে গাড়ী চালানো রোধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছিল। দুদিনের অভিযানশেষে দেখা গেল আটককৃত গাড়ির মালিকদের শতকরা আশিভাগই সরকারের প্রভাবশালী মহল। মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ অফিসার, সচিব-আমলা এবং আদালতের বিচারক পর্যন্ত আইন অমান্য করে গাড়ি চালাতে অভ্যস্থ। এসব বিষয়ে পরিবর্তনের উদ্যোগ না নিয়ে আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে কিছু সংখ্যক ফ্লাইওভার নির্মান করেই উন্নয়নের বুলি আওড়ে চলেছি। এ সপ্তাহে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে, যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিপজেট এর সমীক্ষায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরকে এশিয়ার শীর্ষ হতাশার শহর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশ্বের ১৫০টি শহরের মধ্যে ঢাকা ১৪৪তম স্থান লাভ করেছে। ট্রাফিক জ্যাম, বায়ুদূষণ, নাগরিকদের আর্থিক অবস্থা, মানসিক স্বাস্থ্য, বেকারত্ব, প্রাকৃতিক পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলো সামনে রেখে এই তালিকায় প্রস্তুত করা হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরগুলোর বাইরে সুজলা সুফলা শ্যামল বাংলাদেশের রাজধানী শহরের এই তকমা জাতির জন্য লজ্জাজনক। নদী দূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, শহরদূষণ, রাজনীতি দূষণ, সর্বব্যাপী সামাজিক অবক্ষয় ও নিরাপত্তাহীনতার দেশে ইটপাথরের উন্নয়নের দাবী অর্থহীন। সরকার এবং সব রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসেই কেবল টেকসই উন্নয়ন ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে টিকে থাকার বাস্তবসম্মত উদ্যোগ সম্ভব হতে পারে। কোন জাতিগোষ্ঠি বা রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতার জোরে মাইনাস করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাষ্ট্র


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ