Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

রহস্যে ঘেরা মেয়র রুকন অপহরণ সন্দেহের তালিকায় সাবেক পিএস

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পরকীয়া প্রেম, দ্বিতীয় বিয়ে, রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব, বড় ভাইয়ের প্রেমিকাকে জোর করে বিয়ে, ঘটনাটি অপহরণ নাটক কি না তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা
জামালপুরের সরিষাবাড়ীর মেয়র ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুকনুজ্জামান রুকন অপহরণের ঘটনাটি এখনো রহস্য ঘেরা। উদ্ধারের পাঁচ দিন পরও পুলিশ এ ঘটনার কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি। পুলিশের ধারণাÑ পারিবারিক দ্ব›দ্ব-বিভেদ, মেয়রের দ্বিতীয় বিয়ে, প্রথম স্ত্রীর পরকীয়া প্রেম, সাবেক পিএসের সাথে বিরোধ, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে দ্ব›দ্বসহ বিভিন্ন বিষয় সামনে রেখে অপহরণের ঘটনার তদন্ত চলছে। এ ছাড়া মেয়র নিজেও এ ধরনের নাটক সাজাতে পারেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। এর আগেও ২০১২ সালে তিনি একবার অপহরণের নাটক করেছিলেন। এসব বিষয় সামনে রেখেই চলছে এ ঘটনার তদন্ত।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, অপহরণের ঘটনার সাথে মেয়র রুকনুজ্জামানের সাবেক পিএস মাহমুদুল হাসান দুঃখ জড়িত থাকতে পারে। কারণ, মেয়রের প্রথম স্ত্রী কামরুন্নাহার হ্যাপীর সাথে দুঃখ’র অবৈধ সম্পর্ক ছিল। কয়েক মাস আগে সরিষাবাড়ীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেত্রীর বাসায় হ্যাপীর সাথে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়েন সাবেক পিএস মাহমুদুল হাসান দুঃখ। এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় শুরু হলে স্থানীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে ঘটনাটি মীমাংসা করা হয় এবং মেয়র রুকনুজ্জামান তার পিএস দুঃখকে বরখাস্ত করেন। এর পর থেকেই মেয়রের সাথে দুঃখ’র দ্ব›দ্ব চরম আকার ধারণ করে। এ ঘটনার পরও হ্যাপীর সাথে দুঃখ’র যোগাযোগ ছিল। একসময় মেয়র হ্যাপীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আত্মীয়স্বজন তার দুই সন্তানের কথা বিবেচনা করে তালাক দেয়া থেকে মেয়রকে বিরত রাখেন বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র গতকাল নিশ্চিত করেছে।
তারা বলছেন, প্রথম স্ত্রী কামরুন্নাহার হ্যাপীর পরকীয়া প্রেমের জের ধরে অপহরণের ঘটনা ঘটতে পারে। স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহŸায়ক শিখা ম্যাডামের বাসায় ছয়-সাত মাস আগে মেয়রের প্রথম স্ত্রী হ্যাপী ও সাবেক পিএস মাহমুদুল হাসান দুঃখকে স্থানীয় লোকজন আপত্তিকর অবস্থা ধরে ফেলে। এ ঘটনায় মেয়র হ্যাপীকে তালক দিতে চেয়েছিলেন এবং পিএসকে বরখাস্ত করেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কামরুন্নাহার হ্যাপী বলেন, ‘আমার কার সাথে সম্পর্ক ছিল বা আছে তা বলার জন্য ওর পরিবারের লোকজন একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার বাবা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন। রুকনের পরিবারের চেয়ে আমার পরিবার অনেক ঊর্ধ্বে। ওর বড় ভাই টুকন খুব খারাপ লোক। তিনি বলেন, মাত্র ১৬ বছর বয়সে আমাকে জোর করে রুকন বিয়ে করে। তার পরিবারের সাথে আমার পরিবারে কোনো মিল নেই। আমার বাবা রুকনের কাছে আমাকে বিয়ে দেননি।’
তিনি বলেন, আমার কোনো পরকীয়া প্রেম নেই, এগুলো মৌসুমী এবং মেয়রের বড় ভাই টুকন মানুষের কাছে ছড়াচ্ছে। হ্যাপী বলেন, ‘আমি একজন শিক্ষক, একজন শিক্ষক কি এ ধরনের কাজ করতে পারে?’ হ্যাপী আরো বলেন, ‘আমি হাসপাতাল থেকে চলে গেছি। এখন সরিষাবাড়ীতে আছি। আমি আমার সন্তানদের নিয়ে থাকতে চাই। সে তার ছোট স্ত্রী মৌসুমীকে নিয়েই থাক।’ তিনি বলেন, ‘আমি এখন ভাবছি তার কাছে তালাক চাইব।’
পুলিশ বলছে, মেয়র সুস্থ হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর জানা যাবে কে বা কারা অপহরণ করেছে। অন্যদিকে মেয়র রুকন উদ্ধারের প্রথম দিনই ডিবি পুলিশকে বলেছেন, তিনি অপহরণকারীদের চিনতে পারেননি। তাকে অপহরণের পর চেতনানাশক কিছু জোর করে খাওয়ানো হয়। তারপর চোখ বেঁধে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, পারিবারিক দ্ব›দ্ব¦-বিভেদ নাকি অন্য কোনো কারণে তাকে অপহরণ করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গতকাল জামালপুরের সরিষাবাড়ীর মেয়রের এলাকার দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে দেখার জন্য হাসপাতালে এসে ভিড় করেন। এসময় নেতাকর্মীরা দ্রæত অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবি জানান।
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আলী হোসেন বলেন, ঘটনাটি তদন্তাধীন। এ ছাড়া মেয়র রুকনুজ্জামান এখনো অসুস্থ। তিনি আমাদের কিছুই জানাতে পারেননি। সুস্থ হলে তার সাথে কথা বলার পর আমরা জানতে পারব মূলত কি ঘটেছিল।
পুলিশ জানায়, উদ্ধার হওয়া জামালপুরের সরিষাবাড়ীর মেয়র রুকনুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। কারা ও কোন উদ্দেশ্যে তাকে অপহরণ করেছিল, সে বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের সংগৃহীত তথ্যের সাথে মেয়রের বক্তব্য যাচাই করার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ মো: নাজমুল আলম বলেন, মেয়র রুকনুজ্জামান সুস্থ হলে সবকিছু জানাবেন এবং আমরাও তার বক্তব্য শুনব।
সাইফুল ইসলাম আরো বলেন, ‘কারা ও কী কারণে আমার ভাইকে অপহরণ করেছিল, তা আমার এলাকার সব মানুষই জানে। কিন্তু আমি বলতে পারছি না। আমরা এই অপহরণের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করব নাকি গোপন রাখব, তা আমার ভাই সুস্থ হওয়ার পর জানাব।
মৌলভীবাজার থেকে উদ্ধার হওয়ার পর এ অপহরণের ঘটনার তদন্তে নিয়োজিত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, মেয়র রুকনুজ্জামান অপহরণের পরের দিন পরিবারের সবাইকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালে আধাঘণ্টার ব্যবধানে অপহৃত মেয়রের খোঁজ পাওয়া যায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। গোয়েন্দা পুলিশের কাছে বিষয়টি সন্দেহজনক হওয়ায় তার বিস্তারিত তথ্য উদঘাটন করা হয়। এতে মেয়রের মোবাইল ফোন থেকে একজন অপরিচিত নারীর সঙ্গে অস্বাভাবিক যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। এমনকি তার সঙ্গে বেশকিছু গোপন অবস্থানের ডকুমেন্টসও আছে পুলিশের কাছে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ সেপ্টেম্বর জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র রুকনুজ্জামান রাজধানী ঢাকার উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয়েছিলেন। পরে ২৭ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালীঘাট ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়।
২৫ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টার দিকে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৬০ নম্বর বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন মেয়র রুকন। ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে মৌলভীবাজার থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। ওইদিন রাতে তাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে নেয়া হয়। পরদিন সকালে অসুস্থ অবস্থায় তাকে নেয়া হয় ঢামেক হাসপাতালে। উন্নত চিকিৎসার জন্য ওইদিনই বিকেলে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এখন তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন আছেন।
সূত্র জানায়, মেয়রকে ঢামেক হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়ার সময় ঘটনার সূত্রপাত। কার কাছে ছাড়পত্র দেয়া হবেÑ এ নিয়ে দুই স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। পরে প্রথম স্ত্রীর জিম্মায় মেয়রকে হস্তান্তর করে ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেখান থেকে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার কেবিনে নেয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার স্বজনদের কাছে জানতে চান রোগীর সঙ্গে কে থাকবেন? এ সময় প্রথম স্ত্রী কামরুন্নাহার হ্যাপী বলেন, ‘আমি থাকব।’ তখন দ্বিতীয় স্ত্রী উম্মে হাবিবা মৌসুমী বলেন, ‘আমার স্বামীর সঙ্গে হাসপাতালে আমি থাকব। অন্য কারো থাকার দরকার নেই।’ এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকটি শুরু হয়। একপর্যায়ে অসুস্থ মেয়রের সামনেই তারা হাতাহাতি শুরু করেন। পরে ওই ডাক্তার মেয়রের কাছে জানতে চান, তার সঙ্গে হাসপাতালে কে থাকলে তিনি স্বস্তিবোধ করবেন? তখন ডাক্তারকে হ্যাপীর নাম বলেন মেয়র। এরপর বাইরে এসে ডাক্তার স্বজনদের জিজ্ঞাসা করেন, আপনাদের মধ্যে হ্যাপী কে? হ্যাপীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ডাক্তার তাকে জানান, রোগী আপনাকে তার সঙ্গে থাকতে বলেছেন। আপনার সঙ্গে আর কে থাকবে তা ঠিক করুন? এরপর থেকে প্রথম স্ত্রী হ্যাপী, তার সঙ্গে তার ছেলে স্বপ্নীল (১৪) এবং মেয়ে স্মরণী (৭) হাসপাতালে রয়েছেন। মেয়রের বড় ভাই সাইফুল ইসলামও হাসপাতালে আসা-যাওয়া করছেন।
সূত্র আরো জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই মেয়রের পরিবারে বিরোধ চলছিল। মেয়র রুকনের বড় ভাই টুকনের সঙ্গে হ্যাপীর (বর্তমানে মেয়রের স্ত্রী) প্রেম ছিল। অন্যদিকে রুকনও হ্যাপীকে ভালো বাসতেন। অভিযোগ রয়েছে, মেয়র রুকন অনেকটা জোর করে হ্যাপীকে বিয়ে করেন। এ নিয়ে রুকন ও টুকনের মধ্যে চরম বিরোধ দেখা দিয়েছিল। এরপর থেকে পাঁচ বছর এক ভাই আরেক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতেন না। তাদের মুখ দেখাদেখি অনেকটা বন্ধ ছিল। পরে রুকন ঢাকায় এসে ব্যবসায় সফলতার মুখ দেখলে দুই ভাইয়ের মধ্যে সমঝোতা হয়।
রুকনের স্ত্রী হ্যাপীর একজন আত্মীয় জানান, মেয়রের বড় ভাই ছয় মাস আগে এক কোটি টাকার কাবিনে মৌসুমীকে বিয়ে দিয়েছেন। এর পেছনে টুকন এবং তার স্ত্রী কলকাঠি নেড়েছেন।
অন্যদিকে দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই মেয়রের পরিবারে কলহ বাড়তে থাকে। এ কলহের জের ধরেই মেয়র অপহরণ হয়ে থাকতে পারে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, মেয়রের পরিবারের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এদিকে মাহমুদুল হাসান দুঃখ বলেছেন, আমার সাথে প্রায় এক বছর ধরে মেয়র ও তার পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি বলেন, মেয়রের স্ত্রীর সাথে আমার কোনো অবৈধ সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, শিখা ম্যাডামের বাসা তার চেলের জন্মদিনের দাওয়াত খেতে গিয়েছিল। তখন হ্যাপী আপা ছিলেন না। আমি চলে আসার পর ওই বাসায় হ্যাপী আপা গিয়েছিলেন। তিনি আরো জানান, আমাকে চাকরি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু চাকরি স্থায়ী না করায় আমি চলে আসি।
মেয়রের দ্বিতীয় স্ত্রী উম্মে হাবিবা মৌসুমী বলেছেন, মেয়রকে জিজ্ঞাসা করেন সব জানতে পারবেন। কে বা কারা তাকে অপহরণ করেছে এ তথ্য তো মেয়র ছাড়া আমরা বলতে পারব না। তিনি বলেন, হাসপাতালে হ্যাপীর সাথে মেয়রের বড় ভাইয়ের অনেক কথা কাটাকাটি হয়। এ কারণে মেয়র হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন। এ সময় মেয়রের চাচাত ভাই ও গানম্যানসহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল একাধিকবার মেয়রের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মেয়র


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ