Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অতিবৃষ্টিতে সতেজ চা বাগান

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

উৎপাদন ও দাম দুইই বেড়েছে : সোয়া দুই হাজার কোটি টাকার বাজার : উত্তর জনপদ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আবাদ আরো বৃদ্ধির সম্ভাবনা
আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত আল্লাহতায়ালার অপার এক রহমত ও বিস্ময়। খরাপীড়িত আফ্রিকার দেশগুলোর মানুষ তার মর্ম বেশিই উপলব্ধি করে। আর এ বছরের অতিবৃষ্টি সবচেয়ে বেশি উপকার বয়ে এনেছে দেশের ঐতিহ্যবাহী অর্থকরী চা শিল্পখাতের জন্য। অতি বর্ষণে সতেজ ও সজীব হয়ে উঠেছে চা বাগানগুলো। চায়ের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। এমনকি লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। বাজারে বেড়েছে চায়ের দামও। এতে করে খুশী চা বাগান ও শিল্পোদ্যোক্তারা। আগের চেয়ে ‘ভাল’ মজুরি পেয়ে খুশী হাজারো চা শ্রমিক। এবার দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে বর্ষা মৌসুম। বর্ষারোহী বা নিয়ামক মৌসুমি বায়ুমালা সক্রিয় থাকায় এখন মাধ্য-আশ্বিনে এসেও মাঝারি এমনকি ভারী বৃষ্টিও ঝরছে। চায়ের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রধানত দরকার টানা ভারী বর্ষণ। দীর্ঘতর এবং অতিবৃষ্টির ফলেই চলতি ২০১৭ পঞ্জিকা সালে গত আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে দেশে ৪ কোটি ৩২ লাখ ২৯ হাজার কোজি চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। আর এ বছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করা হয়েছে ৭ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার কেজি। ধারাবাহিক প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাতের ফলে গতবছর ২০১৬ সালে চা উৎপাদনের পরিমাণ ৮ কোটি ৫০ লাখ ৫ হাজার কেজি। অথচ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ কোটি ৪৫ হাজার কেজি। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ কোটি ৫ হাজার কেজি বেশি। এর আগের বছর ২০১৫ সালেও লক্ষ্যমাত্রা ৬ কোটি ৪০ হাজার কেজির বিপরীতে চা পাতা উৎপাদিত হয় ৬ কোটি ৭৩ লাখ ৭৮ হাজার কেজি।
এদিকে দেশে চায়ের উৎপাদন বছর বছর বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদিত চা পাতা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত দেশের প্রাচীন ও একমাত্র আন্তর্জাতিক চা নিলাম বাজারে বিক্রি হয়েছে মোট ৭ কোটি ৭২ লাখ ৭৭ হাজার ২শ’ কেজি। আর প্রকারভেদে গড়মূল্য হচ্ছে ১৯১ টাকা। পূর্ববর্তী (২০১৫-১৬) অর্থবছরে বিক্রি হয় ৬ কোটি ২৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩শ’ কেজি। গড়মূল্য ছিল ১৮৭ টাকা। চায়ের দাম বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ হলো চা পানের ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধির সমানতালে উৎপাদন যথেষ্ট পারিমাণে বাড়ছে না। বর্তমানে দেশে চায়ের সোয়া দুই হাজার কোটি টাকার বিশাল এক বাজার রয়েছে। তবে উন্নতজাতের চা চারা রোপন করে উৎপাদন বৃদ্ধি, চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিন্যাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণে একদিকে চায়ের উৎপাদন ব্যাপকহারে বাড়ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের গত প্রায় ৭০ বছরের মধ্যে যেসব দেশ স্থায়ী বা নিয়মিত ক্রেতা (আমদানিকারক) ছিল সেগুলো প্রায় হারিয়ে গেছে। বর্তমানে চা রফতানি হচ্ছে শতকরা এক ভাগেরও নিচে। তাও ‘রফতানির’ কোটায় মূলত কিনছে স্থানীয় প্যাকেটিয়ার কোম্পানিগুলো। রফতানি বাজার হারানোর পাশাপাশি ভারত থেকে চোরাপথে দেদারসে আসছে অত্যন্ত নি¤œমানের চা পাতা।
চা শিল্পখাতের সংশ্লিষ্টরা জানান, চায়ের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে পর্যাপ্ত ও টানা বৃষ্টিপাত। এরজন্য অতিবৃষ্টি-প্রবণ অঞ্চলগুলোতেই চা বাগানগুলো সৃজন করা হয়। ভারতের আসাম, দার্জিলিং এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিগত তিন বছর ধরে আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষার ঋতুচক্র ছাড়াও প্রাক-বর্ষায় এবং বর্ষাত্তোর সময়েও বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যা চায়ের আবাদ ও উৎপাদনের জন্য বেশ সহায়ক হয়েছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে দেশজুড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত আগস্ট মাসে স্বাভাবিক হার ও পরিমাণের বিপরীতে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি বর্ষণ হয়েছে। এরআগে এপ্রিল, জুন ও জুলাই মাসেও স্বাভাবিকের তুলনায় দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশিই ছিল। এমনকি ৩০ বছরের বর্ষণের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। তবে শুধু গত মে মাসে বৃষ্টিপাত কিছুটা কম ছিল। ধারাবাহিক বর্ষণে দেশের ১৬২টি চা বাগান হয়েছে বৃষ্টিসিক্ত। চা গাছ থেকে ঘন ঘন সতেজ পাতা মিলছে। উৎপাদন বৃদ্ধির এই ধারা চলতি বছরজুড়ে অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিটিএ) সূত্র জানায়, গত ১৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত মওসুমের ২০তম চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক চা নিলাম বাজারে প্রতিকেজি চা গড়ে ২১৬ টাকায় বিক্রি হয়। যা আগের চেয়ে ছিল চাঙ্গা। এরমধ্যে মধুপুর বাগান থেকে সরবরাহ করা ৪ হাজার ৯৫০ কেজি চা পাতা খুব ভাল মানের হওয়ায় বিক্রি হয়েছে কেজি সর্বোচ্চ ৩০২ টাকা দরে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী অর্থকরী চা শিল্পখাতে রীতিমেতা বিপ্লব সৃষ্টি করে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ এবং সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। এতে করে বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থানের পরিধিও। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রয়োজন চা-প্রধান দেশসমূহের অনুসরণে উন্নতজাতের চা আবাদ অর্থাৎ ‘রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদ’Ñ এ তিনটি ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা নিশ্চিত করতে হবে এমনটি জানান চা শিল্পখাতের বিশেষজ্ঞরা। কারণ আন্তর্জাতিক চা বাজারে এই তিন বৈশিষ্ট্যই সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। সেই সাথে দেশের উত্তর জনপদ (বিশেষত পঞ্চগড় জেলা) এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে চায়ের আবাদ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। চট্টগ্রামে কিছু কিছু পুরোনো চা বাগান সংস্কার করে ইতোমধ্যে ঢেলে সাজানো হয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসাইয়ের পাহাড়-টিলাভূমিতেও চা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা ফুটে উঠেছে। এরফলে চা শিল্প অতীত গৌরবের ধারায় ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
তবে হারানো রফতানি বাজার ফিরে পেতে হলে আবাদ ও উৎপাদনের পানিমাণ, উৎকর্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। উন্নততর ক্লোন জাতের চায়ের নতুন চারাগাছ লাগানো হলে ভবিষ্যতে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। সেই সাথে যান্ত্রিক প্রযুক্তির যুগোপযোগী আধুনিকায়ন অপরিহার্য। বাংলাদেশে উৎপাদিত চা পাতা দুই দশক পূর্ব পর্যন্ত ২০টি দেশে রফতানি করা হতো। অন্যতম প্রধান ক্রেতাদেশ ছিল আফগানিস্তান, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সিআইএসভূক্ত দেশগুলো, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ, মিসর, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড। তারা দীর্ঘদিন ধরেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং ভারতসহ বিকল্প চা উৎপাদক দেশগুলোর দিকে ঝুঁকেছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাগান

৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ