Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুচির ভাষণে ‘মিথ্যাচারে’ অবাক পৃথিবী!

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অং সান সুচি। এক সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য এই নেত্রী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এখন ক্ষমতার মসনদে বসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘নাচের পুতুল’ হয়ে গেছেন। রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যাযজ্ঞ এখন আর তাঁর হৃদয় স্পর্শ করছে না। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যাননি বিশ্ব সম্প্রদায়ের তোপের মুখে পড়ার ভয়ে। জাতিসংঘের মহাসচিব, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, বিশ্বের বরেণ্য ব্যাক্তিত্ব এবং ২২ জন নোবেল বিজয়ী তার প্রতি রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের জন্য সুইস নোবেল কমিটির কাছে আবেদন করেছেন। তারপরও বিশ্ব সম্প্রদায় মুখিয়ে ছিলেন সুচি ১৯ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে কি ভাষণ দেন তা শোনার জন্য। কিন্তু তার মুখে ‘মিথ্যাচার’ শোনার পর বিশ্ব সম্প্রদায় অবাক! একি কথা শুনছেন সুচির মুখে!! হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশের বদলে উল্টো দাবি করছেন রোহিঙ্গারা ভালই আছেন? রাখাইনে রোহিঙ্গারা যদি ভাল থাকবেন তাহলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শিশু-নারী-বৃদ্ধ কেন দিনের পর দিন পায়ে হেটে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর স্যাটেলাইটে কেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা যুবক হত্যা, যুবতী ধর্ষণ এবং গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার দৃশ্য ধরা পড়বে? রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যাযজ্ঞ নিয়ে জাতিসংঘের অধিবেশন সরগরম। গোটা বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড়। অথচ নোবেল জয়ী সুচি হন্তারক বর্মী সেনাবাহিনীর শেখানো বুলি তোতা পাখির মতোই বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে টিভির সামনে আওড়ালেন! সুচির এই বদলে যাওয়ায় বিশ্ব সম্প্রদায় ধিক্কার জানাচ্ছেন।
এক সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী বর্তমানে মগদের নাচের পুতুল সুচি দাবী করেছেন রাখাইনে মুসলিম সংখ্যালঘুদের অনেক বেশি সদস্য এখনও নিরাপদে আছেন। বেশির ভাগ রোহিঙ্গা মুসলিম রাখাইন ছেড়ে যায় নি। রাখাইনের বেশির ভাগ গ্রামে এখনও সহিংসতার ছোঁয়া লাগে নি। সেনাবাহিনী ও মগরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়নি। বরং ওরা (রোহিঙ্গা) নিজেরাই নিজেদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।
পুতুল নেত্রী সুচির এই বক্তব্য শোনার জন্য অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় কিছু বিদেশী কূটনীতিককে। ভাণণে যেসব গ্রাম এখনও নিরাপদে আছে তা দেখতে ওইসব কূটনীতিকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু সুচির এ বক্তব্য প্রত্যখ্যান করেছেন বিশ্ব সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তারা সুচিকে মিথ্যুক অবিহিত করে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরার আহবান জানিয়েছেন। শুধু মানবাধিকার সংগঠন নয়; সুচির বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী নেতা আবদুল হাফিজ। তিনি বলেছেন, এক সময় তিনি সেনাবাহিনীর চেয়ে সুচির ওপর বেশি আস্থা রাখতেন। এখন তিনি সুচিকে ‘মিথ্যাবাদী’ আখ্যায়িত করছেন। বলছেন, আগেকার যেকোন সময়ের চেয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বেশি নির্যাতিত। রোহিঙ্গা শরণার্থী আবদুল হাফিজের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এপির খবরে আরো বলা হয় রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের গ্রাম আগুন দেয়ার অভিযোগ যখন করা হয় তা শুনে ক্ষুব্ধ হন আবদুল হাফিজ। তিনি বলেন, যদি তা-ই হয় তাহলে তাদের পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া গ্রামগুলো পরিদর্শনের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাংবাদিকদের অধিকতর সুযোগ বা অনুমতি দেয়া উচিত সুচির। যদি প্রমাণিত হয় যে রোহিঙ্গারা ভুল-মিথ্যা বলছে তাহলে বিশ্ব যদি আমাদের সবাইকে সমুদ্রে ফেলে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় আমরা তা মাথা পেতে নেবো।
রাখাইন সঙ্কট নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি প্রকৃত সত্য লুকিয়ে বিশ্ব স¤প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিলের (ইআরসি) প্রতিষ্ঠাতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ। তিনি বলেন, রাখাইনে সেনাবাহিনী যে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে, তা আড়াল করার প্রয়াস চালিয়েছেন সু চি। ভাষণে দিয়েছেন নানা ‘মিথ্যা তথ্য’। ইব্রাহিম মোহাম্মদ বলেন, আমরা যা ধারণা করেছিলাম, তাই ঘটেছে। প্রথমেই তিনি ছায়া দিয়েছেন সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীকে, যারা গণহত্যা ঘটাচ্ছে। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকার কোনো নিন্দা জানাননি; উপরন্তু দায়ী করেছেন নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের। সেনা অভিযান সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয়েছে বলে সু চির কথাও ঠিক নয়। চলতি সপ্তাহেও সেনা সদস্যরা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। সুচি আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী দলকে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। রাখাইনে মুসলিমদের মতো অন্য স¤প্রদায়ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে সু চি যে দাবী বলেছেন তার প্রতিবাদ জানিয়ে রোহিঙ্গা নেতা বলেন, এটা সত্য নয়। অন্য জনগোষ্ঠীগুলোকে সরকারি উদ্যোগে সরিয়ে নেওয়া হয়। সু চি তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বিসর্জন দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান আসলে করবেন না।
২৫ আগষ্ট মিয়ানমারে হত্যাযজ্ঞ শুরুর পর থেকে প্রায় ৪ লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সু চি বলেছেন, যারা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে তাদের মধ্যে যারা পুনর্বাসনের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন যে কোনো সময় তাদের সঠিক অবস্থান যাচাই করবে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর এটাই সুচির প্রথম জাতির উদ্দেশে ভাষণ। ভাষণে সু চি বলেন, আন্তর্জাতিক চাপে ভীত নয় মিয়ানমার। মিয়ানমার সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। শান্তি না আসা পর্যন্ত সেনা অভিযান চলবে। আমরা শান্তি এবং ঐক্য চাই। যুদ্ধ চাই না। এই সংকট তৈরি হওয়ার আগেই আমরা নিশ্চিত করেছিলাম যে, সবার জন্য সমৃদ্ধি নিশ্চিতের লক্ষ্যে রাখাইনে উন্নয়ন কর্মকান্ড শুরু হয়েছে। আমরা শান্তি এবং উন্নতি চাই। আমরা শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং দেশে আইন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছি। এতো মুসলিম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে কেন যাচ্ছে সেটা তদন্ত করব আমরা। আমরা তাদের জিজ্ঞেস করব যে তারা কেন এটা করছে। রাখাইনে অবস্থিত সব স¤প্রদায়ের দুঃখ-কষ্ট গভীরভাবে অনুভব করে মিয়ানমার। মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের কাছে সমস্যার সমাধান চাচ্ছে। এই সংকট সমাধানে ১৮ মাস খুবই অল্প সময়।
মিয়ানমারের রাজধানী নাইপিতাও থেকে টেলিভিশনের ভাষণে সু চি বলেন, আমরা সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেআইনি সহিংসতার নিন্দা জানাই। আমরা আমাদের দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং আইনের শাসন পুণরুদ্ধারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অধিকাংশ মুসলিমই রাখাইন থেকে পালায়নি এবং সেখানে সহিংসতাও শেষ হয়ে গেছে দাবি করলেও গত বুধবার মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জাও হাতে জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোর মধ্যে একশ ৭৬ টিতেই কোনো জনমানব নেই। তিনটি পৌরসভায় মোট ৪৭১ টি রোহিঙ্গা গ্রাম রয়েছে। তার মধ্যে একশ ৭৬ টি গ্রাম জনশূন্য। পার্শ্ববর্তী ৩৪ টি গ্রামে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জাও এবং সুচির বক্তব্য স্ববিরোধী নয় কি?
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে টেলিভিশনে ভাষণ দিচ্ছেন জানিয়ে সুচি বলেন, বলেন, তার সরকার এই পরিস্থিতিতে কি করছে তা আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে জানাতে চান তিনি। সব ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, রাখাইনে যে কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
এতো হত্যাকান্ড এতো রক্তের পরও সুচি তাঁর অবস্থান বদলাননি। এক সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী যিনি বছরে পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন তার মুখে এ ধরণের মিথ্যাচার শুনে বিশ্বের তাবৎ নেতারা হতবাক হয়ে গেছেন। তাদের প্রশ্ন ক্ষমতার মসনদ ধরে রাখতে এও কি সম্ভব!



 

Show all comments
  • Sayed Muhibbullah ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১১:৪১ এএম says : 0
    মায়ানমারের NLD এর বহুল সমালোচিত নেত্রী অং সান সু চি যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইতিমধ্যে অভিযুক্ত হয়েছেন । আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের বিচারে ওই পাষন্ড মহিলার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি ।
    Total Reply(0) Reply
  • Badal Chawdhury ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১১:৪৭ এএম says : 0
    সুচি একটা ...........
    Total Reply(0) Reply
  • Shaim Babul ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১১:৪৮ এএম says : 2
    অপরাধী কোন দিন সত্যি বলে?
    Total Reply(0) Reply
  • Rumi Habib ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১১:৪৮ এএম says : 0
    ওদের থেকে সত্য আশা করাটাও ভুল
    Total Reply(0) Reply
  • .Sabbir Ahammed ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১১:৫৯ এএম says : 0
    এদের কথা 'আল্লাহ ' - কুরআনে সুরা 'বাকারাতে' এভাবে বলেছেন- "এরা (অবিশ্বাসীরা) বলে- আমরাই প্রথিবীতে শান্তি স্হাপন কারি, (আল্লাহ বলেন)কিন্তু এরাই মূলত দুনিয়ায় অশান্তি সৃ্স্টিকারি ।
    Total Reply(0) Reply
  • Taslima Najneen ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৪৭ পিএম says : 0
    মুসলিম শরীরের রক্ত কি জমে গেল নাকি,কেন এখনো কোন প্রতিবাদের জড় উঠছেনা???
    Total Reply(0) Reply
  • সেলিম উদ্দিন ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৫৪ পিএম says : 0
    অং সান সু চি ভাষণে রোহিঙ্গা নিপীড়নকারী সেনাবাহিনীকে রক্ষায় চেষ্টা করেছেন
    Total Reply(0) Reply
  • Mahabub ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৩:০১ পিএম says : 0
    আল্লাহর কৌশলের কাছে সুচির ভন্ডামি পরাস্ত হবে ইনশা আল্লাহ
    Total Reply(0) Reply
  • মরুজজামান ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৩:৫৮ পিএম says : 0
    এরা ব'তমান পৃথিবির নিকৃষ্ট জাতি।
    Total Reply(0) Reply
  • ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৮:৫১ পিএম says : 0
    সুচিকে ধরে এনে জুতার মালা পরিয়ে শরণার্থী শিবিরের মধ্যখানে দাড় করিয়ে জুতা পিঠা করলে এবংওদের পা দিয়ে লাতি দিলে সত্য। বলবে
    Total Reply(0) Reply
  • hasan jamil ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৫:১৯ পিএম says : 0
    সু চির ফাঁসি চাই..
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সুচি

২৫ ডিসেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ