Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার

ইনকিলাব ডেস্ক: | প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১২ এএম, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

নিপীড়িত নির্যাতিত বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান পরিচালনা করে কঠিন চাপে পড়েছে মিয়ানমার। চলতি শতাব্দীর নৃশংসতম গণহত্যা ও নিধনকান্ড পরিচালনার কারণে বৌদ্ধদের ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ বাণীর খোলসের আড়ালে থাকা মুখ উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। তাদের প্রকৃত রূপ যতই প্রকাশিত হচ্ছে ততই তাদের ঘনিষ্ট বন্ধুরা একে একে মিয়ানমারের পাশ থেকে সরে যেতে শুরু করেছে। চরম নিধন চলাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফর করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নেপিদ’র পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে আসলেও গত শনিবার নয়াদিল্লি থেকে বিবৃতি দিয়ে নৃশংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সউদী আরবসহ বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসঙ্ঘ, ইউএনএইচসিআর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউরোপীয় কমিশন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ্, অক্সফামসহ বিভিন্ন সংস্থা নিন্দা, উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়াও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তাদের সাথে সুর মিলিয়েছেন নোবেলজয়ী বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা দালাইলামা, দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই, বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূসহ বিশ্বের আরো অনেক ব্যক্তিত্ব।
জাতিসঙ্ঘের প্রেরিত কফি আনান কমিশনের পরিকল্পনা প্রকাশের প্রাক্কালে মিয়ানমার সরকার আরাকানে ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের লক্ষ্যে সেনা অভিযান শুরুর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তাদের ক্লিনজিং অপারেশনের খবর পেয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি তথা আরসা নামের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে সমন্বিত হামলা চালায়। এতে অন্তত ১০৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়ে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান জোরদার করে সরকার। এরপর থেকেই মিলতে থাকে রোহিঙ্গা নিধনের আলামত। পাহাড় বেয়ে ভেসে আসতে শুরু করে বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ। পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া এসে মিশছে মৌসুমী বাতাসে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে শূন্যে ছুড়ছেন সেনারা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হচ্ছে তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মানুষকে। আহত শরণার্থী হয়ে তারা ছুটছে বাংলাদেশ সীমান্তে। সেখানেও যাতে জীবনে না বেঁচে যেতে পারে তার জন্য পোঁতা হয় মাইন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরে মিয়ানমারের নিধনকান্ডের শিকার রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বিভিন্ন রকম উল্লেখ করলেও হাজার হাজার মানুষ যে নৃশংসতার শিকার হয়েছেন তা বোঝা যায় সেখান থেকে জীবন বাঁচিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে। অনেকেই এক/দুইজন সদস্য বেঁচে আসতে পারলেও বাকিদের তাদের সামনেই গুলি করে, চাকু মেরে বা পুড়িয়ে হত্যার দাবি করছেন। নৌকা দিয়ে পার হতে গিয়ে প্রায় ২০টি নৌকা ডুবির ঘটনায় কত জনের প্রাণহানি ঘটেছে তা নিশ্চিত করে না জানা গেলেও শতাধিক নিরীহ নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে শাহপরীর দ্বীপের একটি পয়েন্ট থেকেই। বেঁচে আসা রোহিঙ্গারা তাদের পিতা, মাতা, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান বা অন্য আত্মীয়দের নিহত হবার কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যমের সামনে। এসব কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ ধ্বজাধারী বৌদ্ধ ধর্মীবলম্বী মিয়ানমারের প্রশাসনের মন গলাতে পারেনি। বরং তারা আরো সোৎসাহে তাদের ‘ক্লিনজিং অভিযান’ অব্যাহত রেখেছে।
এক সময় অং সান সু চি ছিলেন গণতন্ত্রের প্রতীক। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, শিক্ষিত, সুন্দরী, আর তিনি কথাও বলতেন চমৎকার। ১৯৯০এর দশকে তার দেয়া সাক্ষাৎকারগুলোয় বার বার বলতেন অহিংসার কথা। তখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের রোয়ান্ডা আর বলকান অঞ্চলের সহিংসতার বিরুদ্ধে সু চির কথাগুলো ছিল খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আসলে খুবই কম জানতো। সেখানকার জাতিগত বৈরিতার জটিল ইতিহাস - যা দারিদ্র্যের কারণে গভীরতর হয়েছে এবং দশকের পর দশক ধরে সামরিক শাসকরা যার সুযোগ নিয়েছে - সে সম্পর্কেও পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম খুব কমই জানতো। সু চি যে জেদ নিয়ে সামরিক জান্তার শক্তিকে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই জেদ এখন তার বিরুদ্ধে বিদেশের সমালোচনার সময়ও একই রকম কঠোর হয়ে উঠেছে। একসময় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনে যারা তার পুরোনো বন্ধু ছিলেন, তারা এবং তার প্রতি সহমর্মী কিছু রাজনীতিবিদও এখন তার কড়া সমালোচক হয়ে উঠেছেন।
অং সান সু চি-র সাথে যারা সময় কাটিয়েছেন - তারাই জানেন যে তিনি একবার কোন একটা রাস্তা নিলে তার মত পরিবর্তন করানো খুবই কঠিন। গত বছর এ অভিজ্ঞতাই হয়েছিল জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি বিজয় নাম্বিয়ারের। তিনি মিজ সু চিকে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে যাবার আহ্বান জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তার ঘনিষ্ঠ একজন বলেছেন, ‘নাম্বিয়ার তাকে কিছু করতে বললে তিনি তা কখনোই করবেন না’।
তিনি এটাও কখনো স্বীকার করবেন না যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা জাতিগত শুদ্ধি অভিযান বা ‘এথনিক ক্লিনজিং’-এর শিকার হচ্ছে, বা হাজার হাজার লোকের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, বা তাদের ওপর হত্যা ও যৌন সহিংসতা চালানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অং সান সু চির সমালোচনার মুখে পড়া এবারই প্রথম নয়। পাঁচ বছর আগে একই রকম আক্রমণে ১ লাখ রোহিঙ্গা বাড়িঘর হারায়। তখনও অং সান সু চি ওই এলাকা সফর করেননি বা নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বলেননি। রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গা গ্রামগুলো থেকে ওঠা ধোঁয়ার কুন্ডলি বুঝিয়ে দেয় - বার্মার সামরিক বাহিনী এখনও মনে করে যে তারা আগের মতই বর্বর পন্থা অবাধে চালিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের অন্যরা যাই বলুক না কেন। শুধু রোহিঙ্গা নয়, কারেন বা শানদের বিরুদ্ধেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর অং সান সু চি-র কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সামরিক বাহিনীও সু চিকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু তিনি যে সামরিক বাহিনীর প্রমাণিত নির্যাতনেরও কোন নিন্দা করছেন না সেটাতে বার্মার জেনারেলরা রাজনৈতিক সুরক্ষা পেয়ে যাচ্ছে।
তা ছাড়া সু চি যে শুধু চুপ করেই আছেন তা-ও নয়। এ ছাড়াও আরো কিছু করছেন তিনি। তার কূটনীতিকরা এখন রাশিয়া এবং জাতিসংঘের সাথে কাজ করে চলেছেন, যাতে নিরাপত্তা পরিষদের মতো স্তরে মিয়ানমার সরকারের নিন্দা হতে না পারে। সু চি নিজেও রাখাইন প্রদেশের এই সহিংসতাকে চিত্রিত করেছেন ‘সন্ত্রাসবাদ জনিত সমস্যা’ হিসেবে। তিনি মনে করেন, তার যে নিন্দা হচ্ছে - তার কোন ভিত্তি নেই এবং এ নিন্দার মুখেও তিনি যে তার জেদ ত্যাগ করেননি - এটাও এই সমীকরণের অংশ। কিন্তু আরো একটা প্রশ্ন উঠছে যা খুবই অস্বস্তিকর।
প্রশ্নটা হলো এই, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সার্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি যে অঙ্গীকার দেখিয়ে এসেছেন - সেটা কি তাহলে পক্ষপাতদুষ্ট? বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে থাকা বিপন্ন রোহিঙ্গা মুসলিমরা কি তাহলে তার সেই অঙ্গীকারের আওতায় পড়ে না, বা কখনোই পড়বে না?
অং সান সু চি হয়তো এখনো এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন, তিনি সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ দিতে পারেন এই বর্বর অভিযান বন্ধ করার জন্য। কিন্তু এ মুহূর্তে এরকম কিছু ঘটবে - এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
ফ্রান্সে অবস্থিত আইরিশ আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্রের ওয়েব সাইটে এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘দুঃখজনকভাবে অং সান সু চি ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি বরং পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। মিয়ানমার সরকার মুসলিমদের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা বন্ধে আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই নেয়নি’।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুর্দশায় নোবেল জয়ী ও দেশটির নেত্রী অং সান সু চির ভূমিকার তীব্র নিন্দা শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। রোহিঙ্গা নিপীড়নে সু চির নীরবতায় লাখ লাখ রোহিঙ্গার করুণ আর্তনাদ নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্ব বিবেককে; নাড়াতে পারেনি শান্তির দূত সু চিকে। দুই সপ্তাহ দেশটির রাখাইনে নতুন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ বলছে, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরুর পর এখন পর্যন্ত তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা ও ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি চলতি সপ্তাহে দাবি করেন, প্রচুর ভুল তথ্যে উত্তেজনা উসকে দেয়া হচ্ছে। বার্তাসংস্থা এএনআইকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সু চি বলেন, আমাদের নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে হবে। যারা আমাদের দেশে রয়েছেন তাদের প্রত্যেকের নিরাপত্তা দিতে হবে। ৫ সেপ্টেম্বর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের সঙ্গে টেলিফোন আলোচনায় একথা বলেন সু চি। জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিয়ানমারে কয়েক শতাব্দি ধরে বসবাস করে আসছেন। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে দশকের পর দশক ধরে নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছেন তারা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম রয়েছে। শতাধিক জাতিগোষ্ঠীর মিয়ানমারের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি। বিশ্বের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক ও নেতার সমালোচনার তীরে বিদ্ধ মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। তার নীরব ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন অনেকেই। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে আসা সু চি ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী হন। রাখাইন সঙ্কট শুরুর পর নতুন করে সমালোচনা ও তিরস্কারের মুখে পড়েছেন তিনি।
দালাই লামা : মিয়ানমারের রাখাইন পরিস্থিতিতে শোক জানিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর দমনপীড়ন বন্ধে দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সুচির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামা। বুদ্ধের শিক্ষা উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়াতে বৌদ্ধদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ইকোনমিকস টাইমস জানিয়েছে, শনিবার সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে সোচ্চার হন চতুর্দশ দালাই লামা। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেতা অং সান সু চিকে জানাতে চাই, যারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হয়রানি করছে, তাদের এসব আগ্রাসী কর্মকান্ড করার আগে মহামতি বুদ্ধের কথা একবার মনে করা উচিত।’ বুদ্ধের অহিংস পথ অনুসরণ করে সহিংস কর্মকান্ড বন্ধ করতে রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণকারীদের আহ্বান জানান তিনি। এর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অনুভব করি, এমন জায়গায় থাকলে গৌতম বুদ্ধ ওই অসহায় মুসলমানদের সাহায্য করতেন।’
প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী দালাই লামা ১৯৫৯ থেকে ভারতে নির্বাসিত রয়েছেন। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সমালোচনা করায় তাকে নির্বাসিত করা হয়।
শনিবার জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে কক্সবাজার ও টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। শরণার্থীর সংখ্যা দ্রæত বেড়ে যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রেগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। তাদের আশ্রয়ের জন্য নতুন বসতি স্থাপনের কাজ চললেও নূন্যতম মানবিক সেবা অপ্রতুল।
মালালা ইউসুফজাই : মিয়ানমারের বাড়তে থাকা সহিংসতার ঘটনায় অং সান সু চির নীরবতার সমালোচনা করেছেন শান্তিতে পাকিস্তানের নোবেলজয়ী ও শিক্ষা অধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাই। গত ৩ সেপ্টেম্বরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে দেয়া এক টুইট বার্তায় মালালা বলেন, ‘আমি সব সময় খবর দেখি, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের কষ্টে আমার হৃদয় ভেঙে যায়’।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে মালালা ইউসুফজাই মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে নিন্দা জানানোর আহ্বান জানান। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের ‘মর্মান্তিক ও লজ্জাজনক’ দৃষ্টিভঙ্গির নিন্দা জানিয়ে মালালা বলেন, আমি এখনো অপেক্ষা করছি; আমার সহকর্মী শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চি রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে একই ধরনের নিন্দা জানাবেন।
পাকিস্তানের এই নোবেল জয়ী বলেন, রাখাইনে সহিংসতার ঘটনায় সু চির নিন্দার জন্য বিশ্ব এবং রোহিঙ্গা মুসলিমরা অপেক্ষা করছে।
রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বিশ্ব স¤প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান তালেবানের হামলায় বেঁচে যাওয়া ২০ বছর বয়সী মালালা। সহিংসতা এবং ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের খাবার সরবরাহ, আশ্রয় ও শিক্ষার সুযোগ দিতে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে অনুসরণ করতে পাকিস্তানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু : দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ অবসানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৪ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু রোহিঙ্গা সঙ্কট দূর করতে সু চির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রাখাইনের ভয়াবহ নৃশংসতার ঘটনায় ৭ সেপ্টেম্বর এক খোলা চিঠিতে ৮৫ বছর বয়সী টুটু রোহিঙ্গা সঙ্কটে স্নেহভাজন ছোট বোন সু চিকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, তোমার লোকজনকে আবারও সঠিক পথে ফিরে আসার পরামর্শ দাও। তিনি লেখেন, ‘যদি মিয়ানমারের সর্বোচ্চ অফিসে যাওয়ার রাজনৈতিক বিনিময় হয় তোমার নীরবতা, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এর মূল্য অনেক চড়া।’
‘যে দেশ শান্তিপূর্ণ নয়, সার্বভৌমত্বের মর্যাদা ও মূল্যবোধকে স্বীকার এবং রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়; সেই দেশ স্বাধীন দেশ হতে পারে না। যে দেশের নেতৃত্ব এমন এক ন্যায়পরায়ণতার প্রতীকের হাতে, সেই দেশের এমন ঘটনা আমাদের জন্য পীড়াদায়ক।
অ্যান্টনিও গুতেরাস : চলমান সঙ্কট নিরসনে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বানজানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুটেরাস। রাখাইনে ক্রমাগত মানবিক বিপর্যয়ের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। একই সঙ্গে মানবিক এ সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে বিরল এক চিঠি লিখেছেন তিনি। তবে অং সান সু চির সরাসরি সমালোচনা না করলেও মিয়ানমারের নেতৃত্বের নিন্দা জানিয়েছেন গুটেরাস। ‘আমি মিয়ানমারের, বেসামরিক, সামরিকসহ সব কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, এই সহিংসতার অবসান করুন। আমার মতে, এমন একটি পরিস্থিতির তৈরি হচ্ছে যা এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
রজব তাইয়েব এরদোগান : তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেছেন, মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে তিনি বিশ্ব নেতাদের চাপ দেবেন। চলতি মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তুরস্ক রোহিঙ্গা সঙ্কট তুলে ধরবে। এরদোগান বলেছেন, আগামী ১২ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশ নিয়ে তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করবেন। ৪ সেপ্টেম্বর তিনি বলেন, আপনি মিয়ানমার এবং মুসলিমদের পরিস্থিতি দেখছেন...আপনি দেখেছেন কীভাবে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে...মিয়ানমারের গণহত্যায় মানবতা এখনো নীরব।
পিটার পোফ্যাম : সু চির জীবনী ও কর্ম নিয়ে লেখা দুটি বইয়ের লেখক পিটার পোফ্যাম। রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনায় সু চিকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। পিটার বলেছেন, সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানানোর পরিবর্তে তিনি এখন সেনাবাহিনীর পোষ্য, প্রধান। সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লেইং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের জন্য দায়ী।
বোরিস জনসন : ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরিস জনসন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা নিপীড়নের মাধ্যমে বার্মা তার খ্যাতি ভূলুণ্ঠিত করছে বলে দাবি করেছেন তিনি। ২ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে বোরিস জনসন বলেন, সু চি তার অসাধারণ গুণাবলি ব্যবহারের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধান করবেন বলে প্রত্যাশা করছে ব্রিটেন।
এদিকে বিভিন্ন দেশে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্কসহ আরো অনেক দেশ। মালদ্বীপ মিয়ানমারের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছে। মিয়ানমারের জাতীয় ফুটবল দলের প্রধান কোচের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন ইরানী রেজা কুর্দি। ব্রিটেনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দান বন্ধে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরিস জনসনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ১৫৭ জন সদস্য। দেশটির বিরোধী দলীয় নেতা করবিনও মিয়ানমারে গণহত্যা তথা ক্লিনজিং অপারেশন বন্ধ করে সেদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি মানবিক আচরণের আবেদন জানিয়েছেন।

তিউনিসিয়ায় বিক্ষোভ
আরব বসন্তের সূতিকাগার তিউনিসিয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত শুক্রবার পৃথক দু’টি স্থানে এ বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। প্রথম বিক্ষোভটির আয়োজন করে তায়ার আল-মাহাব্বা (তিউনিসিয়া’স কারেন্ট অব লাভ মুভমেন্ট। তারা ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে মিয়ানমারে গণহত্যা অবিলম্বে বন্ধ এবং বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর প্রতি সহিংসতা বন্ধে হস্তক্ষেপের দাবি জানান। মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার নিন্দা জানিয়ে লিফলেটও বিতরণ করে।
দেশটির জাতীয় থিয়েটারের সামনে অপর বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। আয়োজক তিউনিসিয়ার ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান নিষ্ঠুর আচরণ বন্ধের দাবি জানায়।
লন্ডনে বিক্ষোভ
আরাকানের মুসলিমের সাথে সংহতি প্রকাশের লক্ষ্যে হাজারেরও বেশি মানুষ গত শুক্রবার লন্ডনের ইসলামিক সেন্টারের সামনে বিক্ষোভ করে। মুসলিম এসোসিয়েশন অব ব্রিটেন আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা মুসলিমস : সাইলেন্ট জেনোসাইড’ নামের বিক্ষোভে বক্তারা বলেন, দেশটির নেত্রী অং সান সু চির আচরণ অমার্জনীয়। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নৃশংসতার কারণে সে বিশ্বে গণধিকৃত এক চরিত্রে পরিণত হয়েছে।
ফার্মানার নামে একজন বক্তা বলেন, ‘অং সান সু চি গৃহবন্দি থাকাকালে আমি তার মুক্তির জন্য এক দশকের বেশি সময় প্রচারণা চালিয়েছি। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছি তার মুক্তির ব্যাপারে লবিং করতে। সারা বিশ্বে তার মুক্তির জন্য আমি ছিলাম প্রধান প্রচারক। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। তার আচরণে আমি অত্যন্ত মর্মাহত’।
ব্রিটেনের মুসলিম এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হারুন রশীদ খান বলেন, মিয়ানমারে যে নৃশংসতা চালানো হচ্ছে তা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় এমপিদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি মানবিক সহায়তা দেবার জন্য তুর্কি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন।
যুক্তরাজ্যে তুর্কি কমিউনিটির প্রেসিডেন্ট আইনজীবী হাকান কামুজ আরাকান মুসলিমদের মানবিক সহায়তার কথা স্মরণ করে বলেন, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বলকান যুদ্ধের সময় এই মুসলিমরা তুর্কি সম্রাটের হাতে ২২০ পাউন্ড দান করেছিলেন। তুর্কি সাম্রাজ্যে প্রাপ্ত একটি প্রমাণপত্র অনুযায়ী সে সময় তুর্কি বিধবা ও এতীমদের জন্য আরাকানের মুসলিমরা ২২০ পাউন্ড সাহায্য সংগ্রহ করে রেঙ্গুনের তুর্কি দূতাবাসে জমা দেন। কামুজ বলেন, সেই কথা স্মরণ করে তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য প্রতীকি ২২০ পাউন্ড দান করবেন। তিনি উপস্থিত জনতাকে রোহিঙ্গাদের জন্য গঠিত তহবিলে উদার হস্তে দানের আহŸান জানান।

এদিকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশসহ গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে মিছিল, স্মরকলিপি পেশ ও বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই এ বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানবতাবাদীরা।



 

Show all comments
  • Fazlul Haque ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:১২ পিএম says : 0
    সুচির এই গন হত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে ফাসি চাই।
    Total Reply(0) Reply
  • Nezam Uddin Al Mahmud ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:২২ পিএম says : 0
    হে আল্লাহ জালিমের কবল থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষা কর
    Total Reply(0) Reply
  • Abdul Kadir ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:২৭ পিএম says : 0
    রোহিংগাদের করুন অবস্থা দেখে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি৷
    Total Reply(0) Reply
  • Muhammad Shafiuddin ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৩৩ পিএম says : 0
    মুসলমানরা আসো ঐক্যবদ্ধ হই | আমাদের অনৈক্যই আমাদের দুর্দশা বাড়াচ্ছে | যদি নবীর সুপারিশ পেতে চাও, তবে সব দলাদলি রেখে হাতে হাত ধরো শক্ত করে | এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই, সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই বসবাস করুক |
    Total Reply(0) Reply
  • Abrar Zarif ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৪০ পিএম says : 0
    মিয়ানমারে গণহত্যা থামাতে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাহলে কি আমরা ধরে নেব রোহিঙ্গাদের নিয়ে পরাশক্তিগুলো পরস্পর কোনো বানিজ্যিক স্বার্থের খেলা খেলছে ?
    Total Reply(0) Reply
  • মনির ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৪৬ পিএম says : 0
    আর কত চুপ থাকবে বিশ্ববাসী তোমরা সবাই এক হও।
    Total Reply(0) Reply
  • আবু রায়হান ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৪৮ পিএম says : 0
    এখন আর চাপ দিয়ে কোন কাজ হবে না। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Jamal Hossain ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৩:০১ পিএম says : 0
    ওরা যদি মানুষ হত, তা হলেই ওদের কাছে মানবতা আসা করা যেত। ওরা হায়েনার চেয়ে নিকৃষ্ট। ওরা ভয় পায়না, এটা ওদের হিংসার বহিঃপ্রকাশ।
    Total Reply(0) Reply
  • Tanvir Ahmed Julhas ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৩:০৫ পিএম says : 0
    বর্তমান সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বর জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে মায়ানমার
    Total Reply(0) Reply
  • Abhijit Das ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৩:০৬ পিএম says : 0
    I m sure Buddhism is a religion of peace. .those are doing this they are not real Buddhist
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ