চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মহামানবদেরও শিক্ষক এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ও মহান আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। তাঁর পর আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না এ কারণেই যে মানব জাতির সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ও সৌভাগ্যের জন্য যা যা দরকার তার সব নির্দেশনাই তিনি দিয়ে গেছেন এবং তাঁর নির্দেশনাগুলোর যুগোপযোগী ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন পবিত্র ইমামগণ। বিশ্বনবী (সা.) -এর রেখে যাওয়া প্রকৃত শিক্ষাগুলোর সংরক্ষণ এবং তাঁর দিক-নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের মধ্যেই রয়েছে মানব জাতির প্রকৃত মুক্তি। আজ মানব জাতির নানা ধর্ম বা মতের অনুসারী এবং মুসলমানদের মধ্যে যত অনৈক্য, বিভেদ ও নানা ধরনের সমস্যা বা সংকট-এই সব কিছুর মূলেই রয়েছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রকৃত আদর্শ থেকে দূরে থাকা। এমনকি অনেকেই আজো বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রেখে-যাওয়া প্রকৃত শিক্ষা ও দিক-নির্দেশনাগুলো সম্পর্কে অবহিত নন।
প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব ঘটেছিল মানব জাতির এক চরম দুঃসময়ে যখন বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছিল হানাহানি, জাতিগত সংঘাত, কুসংস্কার, অনাচার এবং জুলুম ও বৈষম্যের দৌরাত্ম। নারী জাতির ছিল না কোনো সম্মান। শির্ক ও কুফরির অন্ধকারে গোটা পৃথিবী হয়ে পড়েছিল আচ্ছন্ন। কিন্তু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর শুভ জন্মের ৪০ বছর পর নবুওতি মিশন তথা ইসলামের বৈপ্লবিক নানা বাণী নিয়ে অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং সব ধরনের উন্নত নৈতিক গুণ-বিবর্জিত মূর্তি পূজারী বর্বর আরব জাতির মধ্যে এমন পরিবর্তন সৃষ্টি করেন যে তারা মানব জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নৈতিকতাসহ নানা ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা উপহার দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু মুসলমানরা নানা দুর্বলতার কারণে এবং বিশেষ করে ইসলামের শিক্ষাকে জীবনের সবক্ষেত্রে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রসহ নানা ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। গোটা মুসলিম জাহানের বেশির ভাগ অঞ্চলই শিকার হয় পশ্চিমা উপনিবেশবাদের। ফলে ইসলাম আজও বিশ্বের ওপর তার প্রত্যাশিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। কিন্তু মুসলমানরা যদি আজো ইসলাম ও কুরআনের আসল শিক্ষার পথে ফিরে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালায় তাহলে তারা সব অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা থেকে মুক্ত হয়ে আবারো সব দিকে কর্তৃত্বশালী হতে পারবে এবং গোটা মানবতাই পাবে প্রত্যাশিত সার্বিক মুক্তি ও অপার কল্যাণ।
পবিত্র কুরআনে মুসলমানদের বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। কিন্তু তা সত্তে¡ও এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে মুসলমানরা এক আল্লাহ, এক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), অভিন্ন কুরআন ও ইসলামের মূল নীতিগুলো মেনে নেয়া সত্তে¡ও সাম্রাজ্যবাদীদের নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরস্পরের মধ্যে সীসা ঢালা প্রাচীরের মত ঐক্য গড়ে তুলতে পারছে না। সালাফি ও ওয়াহাবিরা ইসলামের খাঁটি মতাদর্শ বাস্তবায়নের নামে হত্যা করছে সাধারণ এবং নিরপরাধ মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুদেরকে। তারা ইহুদিবাদী ইসরাইলসহ ইসলামের প্রধান শত্রুদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের এবং বিশেষ করে ইসলামী ইরান ও হিজবুল্লাহর মত বিপ্লবী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ও ইহুদিবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করছে। এমনকি তারা নিহত মুসলিম সেনার বুক চিরে কলিজা খেতেও লজ্জা পায় না। সাম্রাজ্যবাদীরাও তাদের সহায়তা করছে যাতে অমুসলিম বিশ্বের মানুষ প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি এইসব বর্বর ও হিংস্র প্রকৃতির লোকদেরই ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে ইসলাম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ থাকে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন অন্যদের মতামতের ব্যাপারে সহনশীল। তিনি ছিলেন যুক্তি, মত-বিনিময় বা সংলাপের আদর্শ। মদীনায় যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাতে অমুসলিমদেরও পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার দেয়া হয়েছিল। নানা গোত্র ও ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে শান্তি-চুক্তির মাধ্যমে তিনি তাদের আপন করে নিয়েছিলেন। ফলে মুসলমানরা তখন অপর মুসলমানকে মনে কত করত ধর্মের ভাই আর অমুসলমানদের মনে করত আদমের সন্তান হিসেবে জ্ঞাতি ভাই। আসলে একটি প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু বা অমুসলমানরা যতটা নিরাপদ ও সর্বোচ্চ অধিকার পান অন্য কোনো রাষ্ট্রেই অমুসলিম বা সংখ্যালঘুরা এতটা নিরাপদ নন এবং এত বেশি মর্যাদা ও অধিকারও পান না। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন সেখানে ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা জাতিগত পার্থক্যের কারণে কারো অধিকার বেশি বা কম ছিল না। বরং খোদাভীরুতাকেই ধরা হত শ্রেষ্ঠত্বের বা মর্যাদার মানদন্ড একজন নিঃস্ব কালো বর্ণের ক্রীতদাসও পেত অন্য যে কোনো মুসলমানের মত স্বাভাবিক মর্যাদা এবং খোদাভীরুতার মত যোগ্যতার বলে সে সেনাপতি বা মুয়াজ্জিন হওয়ার মত উচ্চ পদেরও অধিকারী হত। আর এগুলোই হল সব ধরনের ঐক্যের মহাসূত্র যার বাস্তবায়ন আজো মুসলিম সমাজের জন্য অপরিহার্য ও একান্তই জরুরি বিষয়।
পবিত্র কুরআন বলেছে, মুসলমানরা পরস্পরের ভাই। ইসলাম দু-জন মুসলমানের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে দেয়া এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব জোরদারকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সহনশীলতা, উদারতা ও ক্ষমাশীলতার মাধ্যমে বহু গোত্র এবং বিবাদমান মুসলমানদের মধ্যে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ফেতনাবাজদের কঠোর হাতে দমন করার শিক্ষাও দিয়ে গেছেন। বিবাদমান দুই মুসলিম গ্রুপের মধ্যে যে ন্যায়বিচারপূর্ণ শান্তির আহŸানে সাড়া দেবে না, তাকে ফেতনাবাজ হিসেবে ধরে নিতে হবে। যদি উভয় পক্ষই ফেতনা জিইয়ে রাখতে চায় তাহলে উভয় পক্ষকেই বর্জন করতে হবে এবং তাদের কাউকেই সমর্থন করা যাবে না। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এই আদর্শ অনুসারেই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) বলেছেন, যারা শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে দ্বন্ধ বাধাতে চায় তারা শিয়াও নয় সুন্নিও নয়, বরং তারা সাম্রাজ্যবাদের দালাল। তিনি শিয়া ও সুন্নি মাজহাব সমর্থনের নামে এই উভয় মাজহাবের ফেতনাবাজদের বয়কট করার উপদেশ দিয়ে গেছেন। পবিত্র কুরআন বলেছে, মুহাম্মাদের প্রকৃত সঙ্গী বা অনুসারীরা পরস্পরের প্রতি দয়ার্দ্র এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর। ই মাম খোমেনী (র.) বলেছেন, বিশ্বের মুসলমানরা যদি এক হয়ে এক বালতি করে পানি ঢালেন তাহলে ইসরাইল ভেসে নিশ্চিহ্ন হবে। অথচ দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো মুসলিম নামধারী সরকার ইসরাইলের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়ে ইরানসহ ইসলামী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদীনা সনদ লঙ্ঘনের দায়ে এবং ঐক্যের চুক্তি লঙ্ঘন করে মুশরিকদের সঙ্গে গোপন আঁতাতের আওতায় মুসলমানদের ক্ষতি করার বা তাদেরকে নির্মূল করার ষড়যন্ত্র করার কারণে মদীনার বিশ্বাসঘাতক ইহুদিদের শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে যারা ছিল মুনাফিক বা বর্ণচোরা তাদের সঙ্গে বাহ্যিক স¤প্রীতির সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়েছিল মহানবী (সা.)-কে। অবশ্য এই মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হওয়ার পর তিনি তাদের কঠোর শাস্তি দিতেন। তিনি মুনাফিকদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃদ জেরার মসজিদ নামের মসজিদ পর্যন্ত ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তাই বর্তমান যুগের মুসলিম নামধারী মুনাফিকদের ব্যাপারেও আমাদের একই ধরনের নীতি বজায় রাখতে হবে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরতের পর মদীনার আনসার ও মক্কা থেকে আসা মুহাজিরদেরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। তিনি প্রত্যেক মুহাজির ও আনসারকে একে-অপরের জন্য ভাই বেছে নিতে বলেন এবং প্রতি একজন আনসার একজন মুহাজিরের সঙ্গে তাদের ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধনের জন্য শপথ নেন। অবশ্য প্রিয় হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের জন্য ভাই হিসেবে বেছে নেন হযরত আলী (আ.)-কে। ইসলামী ঐক্যের এক বড় শিক্ষা রয়েছে এই ঘটনায়। একবার মদীনার মসজিদে নববীতে এক মজলিসে কুরাইশ বংশের একদল গণ্যমান্য মুসলমান নিজ নিজ বংশ ও গোত্রীয় আভিজাত্য নিয়ে বড়াই করছিল। সেই আসরে যখন হযরত সালমান ফার্সির কথা বলার পালা এল তখন বিশ্বনবী (সা.)-এর প্রচারিত ইসলামের খাঁটি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত এই সাহাবি সবিনয়ে বলেন: আমার নাম সালমান। আমি আল্লাহর একজন দাসের পুত্র। আমি ছিলাম বিভ্রান্ত। মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে আমাকে সুপথ দেখিয়েছেন। আমি ছিলাম দরিদ্র, আল্লাহ মুহাম্মাদ (সা.)-এর উসিলায় আমাকে অভাবমুক্ত করেছেন। আমি ছিলাম একজন দাস, মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে মুক্ত করেছেন। আর এটাই হল আমার মূল শেকড় ও বংশের পরিচয়। এ ঘটনার পর সেখানে আসেন বিশ্বনবী (সা.)। তিনি সালমান (রা.) -এর কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনে বললেন: হে কুরাইশ! রক্তের আভিজাত্যটা আবার কি? বংশ মানে কি? কারো গর্ব করার মত বংশীয় বা ব্যক্তিত্বের দিকটি হল তার ধর্ম। কারো পৌরুষত্ব বা আভিজাত্য হল তার উন্নত স্বভাব-চরিত্র ও সৎ কাজের আধিক্য।
এভাবে বিশ্বনবী (সা.) মিটিয়ে দিয়েছিলেন জাতিগত গরিমা বা বংশীয় ভেদাভেদের সীমারেখা। আজো কেবল ইসলামের ধর্মীয় বন্ধনই পৃথিবীর দুই প্রান্তে অবস্থিত বা দূরতম অঞ্চলে অবস্থিত মুসলমানের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির একমাত্র কার্যকর বন্ধন। একমাত্র ভ্রাতৃত্বের চেতনার কারণেই নানা অঞ্চলের এবং নানা ভাষা ও জাতিগত পরিচিতির অধিকারী মুসলমানরা পরস্পরের সুখ ও দুঃখে প্রভাবিত হয়। আর ইসলামী আদর্শই যদি হয় মুসলমানদের ঐক্যের মূল সূত্র তাহলে তাদের কখনও হতাশ হওয়া উচিত হবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।