সড়ক দুর্ঘটনায় জিডিপির ক্ষতি ১ দশমিক ৬ শতাংশ
অর্থনৈতিক রিপোর্টার : সড়ক দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১ দশমিক ৬ শতাংশ বলে জানিয়েছে ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল
শা ন্তা ফা র জা না
সামনের রাস্তায় তাকিয়ে থাকে মিশি। অপলক। মুখে বার বার পানি এসে যাচ্ছে। সে ঢোক গিলে আর মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের কোন দিকে নজর নেই। তিনি রান্নায় ব্যস্ত। সাজু, পলাশ, বান্টিরা হৈ হৈ করছে রাস্তায়। হাতে পলিথিন। যে যেভাবে পারছে কুড়াচ্ছে। মুঠো মুঠো ভরছে পলিথিনে। বিরিয়ানি। ভ্যানগাড়িতে করে চারটা ড্রাম রশিতে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ দোয়েল চত্বরের ওই মোড়টাতে এসে ঘটলো বিপত্তি। একদিক থেকে রিকশা আর অন্যদিক থেকে প্রাইভেট কার। জ্যাম ছাড়িয়ে হঠাৎ এমন দ্বিমুখী যানের আগমনে ব্রেক কষতে গিয়েই বিপত্তি ঘটে। ভ্যানওয়ালাও বয়সে খুব বড় ছিল না। ১৫/১৬ বছরের বয়সের কিশোর হবে। দ্রুত ব্রেক কষতে গিয়ে ভ্যানের চাকা গিয়ে পড়ে পাশের ভাঙা গর্তে। ব্যস পলকেই উল্টে যায় ভ্যান। উল্টে গিয়ে ড্রামগুলোর ঢাকনাও খুলে যায়। আর ভেতরের বিরিয়ানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার হয়ে যায়। খাবারের চমৎকার সুঘ্রাণে মউ মউ করছে চত্বরের বাতাস। কোন অনুষ্ঠানের অর্ডার বোধ হয়। মিশি তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি নড়েনা মেয়েটার। সাজুরা সেই বিরিয়ানিই কুড়াচ্ছে। মাংস বিরিয়ানির স্তূপ থেকে মিশিকেও ডাকে কিন্তু সে যায় না। মাকে অনেক ভয় পায়, সম্মান করে। মা বলেন, কষ্ট করে যেটা পাওয়া যায় সেইটাই খাইতে হয়। যা আছে কপালে। মিশি বসে থাকে। মা কড়াইটা নামিয়ে ভাত বসিয়েছেন। কড়াইতে আলুভাজি। মা কোনদিন আলুর খোসা ফেলেন না। খোসাসহ ধুয়ে কেটে রান্না করেন। ১২ তলার বিল্ডিং এ কাজে গেলে সেইখানে থেকে কখনো খাবার আনেন। মাঝে মাঝে আলুর তরকারি, পোলাও কিংবা বেগুন ভর্তা না হলে ঢেঁড়শের তরকারি। সেই আলুতে খোসা থাকে না। খোসা ছাড়া আলু খেতে বেশি মজা।
মিশিরা দুই ভাই বোন। ভাইটা ছোট। মাত্র কয়েক মাস। আদর করে সৌরভ ডাকে ওকে। মায়ের কাছে বসে থাকে সৌরভ। মিশির মা কাছের ফ্ল্যাট বাড়িতে কাজ করে। সবাই বলে ফ্ল্যাট বাড়ির ‘ম্যাডাম’ ফ্ল্যাট বাড়ির ‘স্যার’। কিন্তু এই ফ্ল্যাট বাড়িটা আসলে দেখতে কেমন জানে না মিশি। মাকে কত বলে কিন্তু মা কখনোই সাথে নেয় না। মিশিরা দোয়েল চত্বরের পূর্ব দিকের রাস্তার বাসিন্দা। একটু বড় একটা মোটা পলিথিন রশি দিয়ে দেয়ালের শিকে বেঁধে নিয়ে নিচে দুইদিকে টুকরো ইটের সাথে বেঁধে দিয়েছে। বাতাসে উড়ে না। আর নিচে মায়ের পুরানো শাড়ি বিছিয়ে ঘুমায় ওরা। কোন রকমে পার করে রাতটা। মিশির বাবা ওদের সাথে থাকে না। মাঝে মাঝে আসে। বাবার একটা রিকশা আছে। যখনই আসে ওকে রিকশায় চড়িয়ে ঘুরাতে নিয়ে যান। টুকিটাকি কিনে দেয়। বাবা আসলেই মা মুখটা মলিন করে রাখে। তেমন কোন কথা বলে না। মাঝে মাঝে বাবা খুব হাসেন। নিজের হাতে ভাত-তরকারি বেড়ে খান। আর মাঝে মধ্যে অনেক রাগারাগি করে চলে যান। ৮/৯ বছরের মিশি বোঝে না জীবনের অত ঝড় ঝঞ্ঝাট। সে মালা বিক্রি করে। শিউলী, বকুল, বেলী ফুলের। খুব ভোরে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে সে আর মিতাবু কুড়িয়ে আনে ফুলগুলো। নিয়ে আসে কোচ ভরে। মিতাবু পাশের সামিরানায় থাকে। বয়সে একটু বড় হবে। ফুলগুলো বিছিয়ে ওরা মালা গাঁথে। সেই গাঁথা মালা ভাগাভাগি করে বেরিয়ে পরে রাস্তায়। কাছাকাছিই থাকে ওরা। শাপলা-চত্বর, সোহ্রাওয়ার্দী, টিএসসি, রমনাপার্ক, ঘুরে ঘুরে মালা বেঁচে। কত রকমের মানুষ যে আছে দুনিয়ায়। ভাবে মিশি। কেউ ধমকে উঠে। কেউ কেউ মিষ্টি হেসে বলে লাগবে না। কেউবা আবার জবাবই দেয় না। ফুল কেনে এমন মানুষ খুব কম। মা তার ছোট বেলার কথা গল্পে করেন তখন নাকি মানুষের হাতে হাতে ফুল থাকতো। মানুষ খুব হাসি-খুশি থাকতো। টিএসসি’র ওই জায়গাটাতেই বেশি ভালো লাগে মিশির। বড় বড় আপুরা ব্যাগ কাঁধে বই হাতে হেঁটে যায়। মা বলেছেন, এইটা অনেক বড় কলেজ। মানুষে ভার্সিটি বলে। মিশির খুব পড়তে ইচ্ছা করে। স্কুলে যেতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে দুপুরে দুই বেনুনী গেথে স্কুলের ড্রেস পরে মেয়েরা ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যায়। আচ্ছা এমন স্কুল যদি হতো যে সন্ধ্যায় স্কুলের ঘণ্টা বাজবে, ফ্রি কিংবা খুব অল্প বেতনে ওদের মতো গরীবেরা লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। ছোট্ট মিশি ভাবে। ওর চোখের সামনে স্বপ্নের মতো ভাসতে থাকে। সান্ধ্যাকালীন স্কুলটা।
আপু একটা মালা ন্যান। টিএসসি’র চত্বরে বসে একটা মেয়ে আলুর চপ আর চা খাচ্ছিলো। হাতে খাতা বই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মিশির ডাক শুনে বই থেকে চোখ উঠায়। কত করে? ৫ ট্যাকা। মিষ্টি হেসে মেয়েটা ৫ টাকা বাড়িয়ে ধরে। আপা কোনটা নিবেন? বকুল না বেলী? দাও একটা দিলেই হবে? ন্যান, আজকে সক্কালে বানাইছি। এখন্নো সুবাস পাইবেন। বলে খুশি হয়ে বেলী ফুলের সবচেয়ে ভালো মালাটা এগিয়ে দেয় মিশি। মেয়েটা আবারো মিষ্টি হাসে। থ্যাংকু। তারপর একটা আলুর চপ গুজে দেয় মিশির হাতে। মিশি কী বলবে বুঝতে পারে না। তাড়াতাড়ি ঐখান থেকে সরে যায়। কত মানুষ দেখে প্রতিদিন। কিন্তু উনার মত মানুষ দেখে না তেমন। খুব কোমল আনন্দে মিশির চোখে পানি চলে আসে। যতœ করে আলুর চপটা পায়জামার কোমড়ের ফিতায় গুজে রাখে। ছোট ভাইয়ের সাথে ভাগ করে খাবে। আরেকটু এদিক সেদিক ঘুরে বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়। আজকে মিতাবু আসেনি। একা একা এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে খেয়ালই করতে পারেনি। তাড়াতাড়ি হাটতে থাকে। মা হয়তো চিন্তা করছেন।
কে রে? মিশি নি? পরিচিত কণ্ঠে থমকে দাঁড়ায় সে। রিকশা ধীরে এসে পাশে দাঁড় করায় মানুষটা। মিশির বাবা। চিরপরিচিত টুকরো হাসি নিয়ে কাছে এসে দাঁড়ায়। মিশি কই যাও? আব্বা, দেরি হইয়া গ্যাছে। একা নাকি? হ আইজকে মিতাবু আসে নাই। অ...আইচ্ছা ল আমি তোরে পৌঁইছাইয়া দিমু। বাবার কথায় লাফ দিয়ে রিকশায় চড়ে বসে সে। বাবাকে পেয়েছে। পৃথিবীতে আর কোন কিছুর ভয় পায় না সে। সাথে না থাকলেও বাবাকে অনেক ভালোবাসে সে। বাবা মজার মজার গল্প বলে। আইসক্রিম খাওয়ায়। মুড়ি চানাচুর খাওয়ায়। রিকশায় চড়িয়ে ঘোড়ায়। আরাম করে সিটে বসে মিশি। ও ছোট, ওর পা গুলোও ছোট। তাই রিকশার হুডটা শক্ত করে ধরে রাখতে হয়। তবে বাবা চালান খুব আস্তে। গল্প বলেন, মজা করেন। জোরে হাসেন-হা-হা-হা। মিশি। তোমার মায় জানে যে তুমি আজকা দেরি কইরা ফেলছো। না আব্বা। হুম। আইচ্ছা চলো তোমারে একটু ঘুরাই তারপর মার কাছে লইয়া যামুনে। মিশি তো মহাখুশি। বাবা অপরিচিত রাস্তায় রিকশা চালান। হালকা সুরে গান ধরেন। বাবার সাথে সাথে মেয়েও গুনগুন করে। পার্কের মত জায়গাটা। বেশ সুনশান। বাবার রিকশা থামায়। সামনে দাঁড়ানো একটা লোকের সাথে কথা বলতে থাকে। মিশির সকল মনোযোগ হাতের আইসক্রিমটাতে। অনেক মজার। আব্বা এত মজার আইসক্রিম কিনে দিয়েছে। চকলেট চকলেট স্বাদ। মিশি... বাবার ডাকে রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নামে সে। শোনো তুমি এই আংকেলটার সাথে একটু থাকো। আমি একটু আসতেছি। দশ মিনিট। কেমন? আইচ্ছা। বাধ্যগত মেয়ের মত আংকেলটার সাথে হাঁটতে থাকে মিশি। বাবা টুং টাং বেল বাজিয়ে চলে গেছেন। কোন বিশেষ কাজে বোধ হয়। মিশি ওসব ভাবে না। হাতের আইসক্রিমটা মজা করে খেতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা পার্কে ঢুকে পড়ে। অন্ধকার চারদিকে। ল্যামপোস্টের দিকে আলোয় আবছায়া কেবল। আংকেলটা একটা বেঞ্চিতে বসে। মিশিকে কোলে তুলে নেয়। অতটুকু পথ আংকেল অনেক সুন্দর করে কথা বলছিলেন। এখনও বলছেন। তাকে কোলে বসিয়ে তিনি বলেন, মিশি ভালো মেয়ে। দেখতে সুন্দর। হঠাৎ সে অনুভব করে আংকেলের হাতটা খুব ধীর গতিতে তার জমার নিচে চলে গেছে। হাতটাকে হঠাৎ কিলবিলে সাপের মত মনে হয় ওর। হাতটা ছোট্ট মিশির খুব খারাপ লেগে উঠে। সে হঠাৎ করেই লাফ দিয়ে কোল থেকে নেমে যায়। আর দৌড়াতে শুরু করে। পেছনে ফিরে তাকায় না একবারের জন্যেও। ওকে মার কাছে পৌঁছাতে হবে। মা নিশ্চয়ই ওর দেরি দেখে কাঁদছেন। মিশির সাথে সাথে দৌড়ে পালিয়ে ওর ছায়াটুকু। মাটিতে পড়ে থাকে চকলেট আইসক্রিমটা। গলে গিয়ে কেবল কাঠিটাই পড়ে আছে . . .।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।