Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

পীর-মুরীদি : অপপ্রচার ও জবাব

| প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হাবিবুর রহমান মিছবাহ 

\ এক \
সাম্প্রতিককালে দেখা যায় একটি মহল পীর-মুরীদির ঘোর বিরোধীতা করে আসছে। বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে সর্বস্তরে। বাইয়াত, পীর কর্তৃক খিলাফাত, জিকির ইত্যাদি পন্থাকেও অস্বীকার করে। এমনকি পীর-মুরীদিকে কুফরী পন্থা বলতেও দ্বিধা করে না। মাঝে মাঝে এদের সাথে সমাধানের লক্ষ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হলেও তারা তা এড়িয়ে গিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে সঠিক বিধান মেনে দীনের সহীহ ত্বরীকার উপর চলা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পরেছে। ঐ মহলটির উদ্দেশ্য ইতোমধ্যেই জাতির মাঝে দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার। তাদের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে হক্কানী আলেম ও পীর বুজুর্গ হতে আলাদা করা। আর এ মিশন বাস্তাবায়নে তারা টিভি প্রচারসহ বিভিন্ন কৌশলও অবলম্বন করেছে। তাদের অপ-প্রচারে ইতোমধ্যে যুব-সমাজসহ সরল মুসলমানদের একটি অংশ আলেম ওলামা ও হক্কানী পীর মাশায়েখ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যারা এখনো তাদের ভ্রান্ত প্রচারে বিশ্বাসী না হয়ে আকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন রাসূল স., সাহাবায়ে কেরাম রাদি. ও আকাবীরে দীনের জীবন্ত আদর্শকে, তারাও ঐ মহলটির খোঁড়া যুক্তির ব্যাড়াজালে দোদুল্যমান অবস্থায় কাতরাচ্ছে। আমি আপনাদের মাঝে এরকম কিছু অপ-প্রচারের জবাব কোরআন হাদিস ও যুক্তির আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ। 
পীরের প্রয়োজনীয়তা কি?
যাহেরী আমল তথা দেহের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত আমল ও তার মাসআলা-মাসাঈল শিক্ষা করার জন্য শিক্ষকের প্রয়োজন হয়, এটিই নিয়ম। উস্তাদ ছাড়া এসব কাজ সঠিকভাবে আদায় হয় না। কিন্তু বাতেনী আমলের ফরয, ওয়াজিব, হারাম, মাকরূহ- যেগুলো তাসাউফ ও ত্বরীকতের মধ্যে বর্ণনা করা হয়, সেগুলোর ইল্ম হাসিল করা এবং সে অনুপাতে আমল করার জন্য উস্তাদের প্রয়োজন তার চেয়েও অধিক। এ সমস্ত বিষয়ের উস্তাদকে পরিভাষায় শাইখ, মুরশীদ বা পীর বলা হয়। আধ্যাত্মিক ব্যধি ও মন্দ চরিত্রসমূহ বোঝা এবং সেগুলোর চিকিৎসা ও সংশোধন করা সাধারণতঃ পীর বা মুরশীদ ছাড়া সম্ভব নয়। তাই যে ব্যক্তি এ পথে পা রাখবে, তার জন্য মুরশীদের সন্ধান করা জরুরী। সন্ধান করে এ ধরণের পীর পেলে, তাঁর শরণাপন্ন হবে এবং পরিপূর্ণরূপে তাঁর শিক্ষা ও নির্দেশনা মেনে চলবে। কেউ যখন পীরের শিক্ষা বা ছবকানুযায়ী আমল করতে আরম্ভ করবে, তখন সে নিজেই বুঝতে পারবে যে, নিজের যাহেরী ও বাতেনী আমল সহীহ করতে জায়গায় জায়গায় পীর ও মুরশীদের প্রয়োজন পরে। একজন কামিল পীরের পথপ্রদর্শন ছাড়া তওবা ইত্যাদি পরিপূর্ণ হওয়া জটিল ব্যাপার। এখন আমাদের দেশে বহু পীর আছে, যাদের মধ্যে সবাই খাঁটি বা কামিল পীর নয়। এমন পীরও আমাদের সমাজে রয়েছে, যারা ইহুদী খৃষ্টানদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য সাধারণ মানুষকে নিয়মিত ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আপনি খাঁটি বা কামিল পীর চিনবেন কিভাবে? আসুন! এবার খাঁটি/কামিল পীরের পরিচয় জেনে নেই।
খাঁটি/কামিল পীরের পরিচয় :
খাঁটি পীর বা হেদায়াতের পথ প্রদর্শক হওয়ার জন্য ১০টি শর্ত রয়েছে। যে পীরের মধ্যে এ ১০টি শর্তের ১টিও পাওয়া যাবে না, তাহলে বুঝতে হবে সে আহলে হক তথা কামিল পীর হতে পারে না। তার কাছে গেলে মানুষ কখনোই সীরাতে মুস্তাকিমের পথ খুঁজে পাবে না এবং নিজের আত্মাও পবিত্র হবে না।
শর্তগুলি হচ্ছে :
০১. পীর সাহেব তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ ও ধর্মীয় যাবতীয় ব্যাপারে অভিজ্ঞ আলেম হওয়া আবশ্যক। অন্ততঃপক্ষে মেশকাত শরীফ ও জালালাইন শরীফ বুঝে পড়েছেন, এমন পরিমাণ ইল্ম থাকা জরুরী। ০২. পীরের আক্বীদা এবং আমল শরীয়ত মু’আফিক হওয়া অপরিহার্য। তার স্বভাব-চরিত্র ও অন্যান্য গুণাবলী শরীয়ত যে রকম চায়, সে রকম হওয়া বাঞ্ছনীয়। ০৩. পীরের মধ্যে লোভ ( টাকা-পয়সা, সম্মান-প্রতিপত্তি, যশঃ ও সুখ্যাতির লিপ্সা) থকবে না। নিজের পক্ষ থেকে কামিল হওয়ার দাবী করবে না। কেননা, এটিা দুনিয়ার মহব্বতেরই অন্তর্ভুক্ত। 
০৪. তিনি উপর ও নিম্নোল্লেখিত সকল গুনের অধিকারী এমন একজন কামিল পীরের খিদমাতে থেকে ইসলাহে বাতেন (আত্মশুদ্ধি করেছেন) এবং তরীক্বত অর্জন করেছেন, এমন হতে হবে। ০৫. সমসাময়িক পরহেযগার-মুত্তাকী আলেমগণ এবং সুন্নাত ত্বরীকার ওলীগণ তাঁকে ভালো ও হক বলে মনে করতে হবে। ০৬. দুনিয়াদার অপেক্ষা দ্বীনদার লোকেরাই তাঁর প্রতি বেশি ভক্তি রাখে, এমন হওয়া আবশ্যক। ০৭. তার মুরীদের মধ্যে অধিকাংশ এরকম হতে হবে যে, তারা প্রাণপণে শরীয়তের পাবন্দী করেন এবং দুনিয়ার প্রতি মোহ-লালসা রখেন না। ০৮. তিনি এমন হবেন যে, মনোযোগের সাথে মুরীদদের তা’লীম তালকীন করেন এবং অন্তর দিয়ে এটি চান যে, তারা আল্লাহ্ ও রাসূল স. এর পায়রবী করুক। মুরীদদের স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেন না এবং তাদের মধ্যে যদি কোনো দোষ দেখতে বা শুনতে পান, তবে তা যথারীতি (কাউকে নরমে কাউকে গরমে) সংশোধন করে দেন। ০৯. তাঁর সুহবতে কিছু দিন যাবৎ থাকলে দুনিয়া অপেক্ষা আখেরাতের চিন্তা-ফিকির বাড়তে থাকে, এমন হতে হবে। ১০. তিনি নিজেও রীতিমতো যিকির করেন, তিলাওয়াত করেন, সাধারণ সুন্নাতও ইচ্ছাকৃত বাদ দেন না, অন্ততঃপক্ষে করার পাক্কা ইরাদা রাখেন (কেননা, নিজে আমল না করলে, পাক্কা ইরাদা না থাকলে, তা’লীম-তালকীনে বরকত হয় না) এবং মুরীদদেরকেও এর উপর তাগীদ দিয়ে থাকেন। 
[প্রমাণঃ-কসদুস সাবীল, পৃঃ ৯]
আমরা যদি এতোগুলো শর্ত স্মরণ রাখতে নাও পারি, তাহলে সহজে হক-বাতিল চিনার আরো একটি উপায় রয়েছে। আর তা হলো, যে পীরের কাছে বে-নামাযী গেলে নামাযী হয়, বে-রোযাদার গেলে রোযাদার হয়, বে-পর্দাওয়ালা গেলে পর্দাওয়ালা হয়। মোট কথাঃ আগে অপরাধ করতো, পীরের কাছে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে অপরাধ ছেড়ে দেয় এবং যে পীরের মুরীদদের মধ্যে অধিকাংশ মুরীদ নবী স. এর ত্বরীকার উপর চলার প্রাণপণ চেষ্টা করে। 
উপরোল্লেখিত শর্তগুলি যাঁদের মধ্যে পাওয়া যাবে, তাঁরা খাঁটি পীর। এমন পীরের কাছে গেলে ঈমান ধ্বংস হবে না, বরং জান্নাতের সঠিক পথ চিনতে পারবো, ইনশাআল্লাহ্। আর যারা উল্লেখিত গুণে গুনান্বিতদের বাতিল, ভন্ড, কুফরী আক্বীদা ইত্যাদি বলে গালমন্দ করে, তারা নিজেরাই এ মন্দের অন্তর্ভূক্ত হবে।
ইসলাহী খিলাফাত :
আরো একটি অভিযোগ করে থাকে ঐ ভ্রান্তবাদীরা, রাসুলুল্লাহ স. কি বর্তমান পীরদের মতো সাহাবাদের খিলাফাত দিয়েছেন? দিয়ে থাকলে কোন্ সাহাবীকে সর্বপ্রথম দিয়েছেন এবং কতোজনকে দিয়েছেন? আসুন! এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক। নবীজি স. বহু সাহাবায়ে কেরামকে খিলাফাত দিয়েছেন। 
খিলাফাত মুলত; ‘খ. লাম. ফা’ তথা ‘আল খলফু’ হতে নির্গত। অর্থ- পূর্ব/পিছন (কাউকে অনুসরন করা বা উত্তরসূরী হওয়া) যেমনঃ বলা হয় ‘খলফু ছিদক্বি আন আবীহি’ অর্থঃ পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরী। ‘আল খলফু’ এর বহুবচন হলো, ‘খুলূফুন’ অর্থ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অর্থাত, যুগ যুগ ধরে অনুসরন করা এবং উত্তরসূরী হওয়া। আর ‘খলীফা’ অর্থ হলো- প্রতিনিধি, স্থলবর্তী ইত্যাদি। যার বহুবচন হলো- ‘খুলাফা-উ’ ও ‘খলা-ইফু’। খলীফা মূলত ইসমে ফায়েল ও ইসমে মাফউল উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়ে থাকে। এজন্য নিজেও কাউকে অনুসরন করা এবং তাকেও অন্যরা অনুসরন করার অর্থেই খিলাফাত ব্যবহৃত হয়। শব্দটি কারো জন্য খাছ বা নির্দিষ্ট নয়, শব্দটি আম বা সাধারণ। অতএব, খিলাফাত শুধু রাষ্ট্রের জন্যই নির্ধারিত একথা বলার সুযোগ নেই। কাউকে খিলাফাত দেয়ার অর্থ হলো, খিলাফাত প্রদানকারী কর্তৃক খিলাফাত প্রাপ্তকে তার দায়িত্ব অর্পন করা। যিনি খলীফা হবেন, সে নিজেও অনুসরনীয় হবেন এবং তাকেও অন্যরা অনুসরন করবে। যিনি খিলাফাত প্রদান করেন; তাকে আমীর, পীর, শায়খ বা মুরশীদ বলে। আর তাকে যারা অনুসরন করে; তাদেরকে মামুর বা মুরীদ বলে। 
[খিলাফাতের দলীলঃ সূরা বাক্বারা-৩০, আনআম-১৬৫, ইউসূফ-১৪, আরাফ-৬৯, ৭৪ ও ১২৯, নূর-৫৫, এবং সূরা ছোয়াদ-২৬]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ