Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কোচিং কারাগারে শৈশব-কৈশর

| প্রকাশের সময় : ১৮ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : ছেলের পরীক্ষার রেজাল্ট হবে ২৩ জুলাই। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। ভর্তি যুদ্ধে অবতীর্ণের প্রস্তুতি নিতে রমজান শুরুর আগেই কোচিং এ ভর্তি হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার ধকল শেষে দু’চারদিন জুড়াবে; গ্রামের বাড়ি-আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে ঘুরবে; সে জো নেই। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই কোচিং-এ ভর্তি হতে হলো মোটা অংকের টাকা দিয়ে। ভর্তির পর নানান কিসিমের সীট, নোট, বইয়ের নামে প্রায়ই টাকা গুণতে হয়। সংসারের টুকিটাকি খরচ কমিয়ে সেটা মেটাতে হয়। অতপর কোচিংয়ের ভিতরে আরেক কোচিং এ মোটা টাকা গুণতে হয়। স্কুল কলেজের শিক্ষকরাই কোচিং ব্যবসা করেন। যারা কোচিং এ পড়ান তারা কোচিংয়ে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ভিতরেই এক্সট্রা কোচিং ব্যবসা ফেঁদে বসেন। অর্থাৎ ডাবল কোচিং এ টাকা গুণতে হয়। প্রবাদে রয়েছে ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। শিক্ষা নিতে তথা পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোচিং এর অর্থের ‘খাই’ মেটাতে গিয়ে এখন পরিবারের মেরুদন্ড ভাঙ্গার উপক্রম। আগে ছেলের কোচিং-এর টাকা দাও তারপর টাকা বাঁচলে মাছ মাংস; না হলে ডালভাত। হাজার হাজার পরিবারে একই চিত্র। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর এই হাল। শুধু কি তাই! পরীক্ষা যুদ্ধ নিয়ে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিপর্যস্ততা! দেশের অসাধু শিক্ষা ব্যবসায়ীরা পরীক্ষা ‘ফোবিয়া’ শিক্ষার্থীদের মাথায় দারুণভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ শিক্ষাকে কার্যত বানিজ্যিকীকরণ করে ফেলেছে। শিক্ষকতা পেশায় গিয়ে কোচিং ব্যবসার নৈতিকতার স্খলন কেন? নৈতিক স্খলনকারীরা কি সমাজে ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন? মানুষ গড়ার এই কারিগররা তো শিক্ষার নামে ছেলেমেয়েদের শিশুকাল-কৌশর কেচিং কারাগারে নিক্ষেপ করছে । এতো গেল উপরের ক্লাস। নীচের ক্লাস!
প্রথম শ্রেণির-দ্বিতীয় শ্রেণির কচি বয়সের শিক্ষার্থীরা পীঠে ক্লাসের বই বহন করে হাড় ক্ষয় করে ফেলছে। আদালত একজন শিশু পীঠে কতটুকু ওজনের ব্যাগ বহন করতে পারবে সে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু কে শোনো কার কথা! শিক্ষার নামে প্রথম শ্রেনি থেকে শিশুদের জ্ঞানের সমুদ্রে ছুঁড়ে দিচ্ছি। শিশু বয়সে ১০ থেকে ১২টা বই পড়তে হয়। প্রথম শ্রেণিতে ইংরেজি ব্যাকরণ-গদ্য-পদ্য-বিজ্ঞানের জ্ঞান মস্তিস্কে নিতে হবে। ওপরের দিকে উঠতে উঠতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঝাঁপ দিতে হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের মহাসমুদ্রে। কত কিসিমের যে বই তার ইয়াত্তা নেই। গণিতের সৃজনশীল প্রশ্নসহ নানা কিসিমের বইয়ের সমাহার। শিশু বয়সে ক্লাসের পাঠ্যসূচির অকুল সাগরে ভাসতে হচ্ছে ছেলেমেয়েদের। আর এটা করতে গিয়ে শিশুদের শৈশব শিক্ষা নামের কারাগারে কাটাতে হচ্ছে; শিক্ষার প্রতি কচি মনে জন্মেছে ভীতি-ঘৃণা। পঞ্চম শ্রেণি এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষার প্রচলন শুরু হওয়ায় অভিভাবকদের মধ্যে ছেলেমেয়ের ভাল রেজাল্টের জন্য উদ্বিগ্ন বাড়ছে। এতে শিশুরা শুধু স্কুলের ক্লাসের বইয়ের ব্যাগের ভারে ন্যূর্জ হচ্ছে না; কোচিং নামের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। পড়াশোনার চাপে শিশু মন টেরই পায় না কখন দিন শেষ হয়ে যায়। ছেলেমেয়ের বয়সই যাই হোক; তার মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারুক না পারুক সেটা বিবেচ্য নয়; বাবা-মায়ের চাওয়া ছেলেমেয়েকে ক্লাসে রেজাল্ট ভাল করতে হবে। এমনকি প্রথম হতে হবে। শিশু ছেলেমেয়েদের ক্লাসের রেজাল্ট ভাল চাওয়ার প্রত্যাশা থেকে ক্লাসের অসংখ্য বইয়ের পাশাপাশি কোচিং সেন্টারে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রচুর টাকা যেমন খরচ করতে হয় তেমনি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার চাপও বাড়ে দ্বিগুণ। যার ধকল শিশু বয়সে অনেক ছাত্রছাত্রীর পক্ষ্যে সম্ভব হয় না। তারপরও ‘অচল গরুর মতো’ই আমরা ঠেলছি শিশুকে শিখতেই হবে; এতো এতো বই পড়তেই হবে। স্কুল-কলেজের ভর্তি ফি-মাসিক ফি এবং অন্যান্য ফি প্রচুর পরিমান দিতে হয়। এর বাইরে ভাল রেজাল্টের জন্য কোচিং ভর্তি করাতে হয় মোটা অংকের টাকা দিয়ে। এতে করে ছোট্ট ছোট্ট ছাত্রছাত্রীদের জীবন হয়ে উঠে দূর্বিসহ। কারণ একদিকে স্কুলের ক্লাসের পড়া তৈরি করতে হয়; তারপর কোচিং এর পড়া তৈরি করতে হয়। দু’টো করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ্যে কোনো পড়াই সুন্দর ভাবে তৈরি করা সম্ভব হয় না। ছেলেমেয়েরা শিশু-কিশোর বয়সের হেসে খেলে জীবন উপভোগ নষ্ট করে যে ডজন ডজন বই পড়ছে; বিশ্বের সব জ্ঞানের বই পড়ছে; তাতে কি দেশে শিক্ষার মান বাড়ছে? নাকি নতুন প্রজন্ম শিক্ষায় পূর্বসূরীদের চেয়ে বেশি মেধাবী হচ্ছে? আগে তো ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল-কম্পিউটার-ইন্টারনেটের এতো সুযোগ সুবিধা ছিল না। এতো সুযোগ সুবিধা পরও কি আমাদের ছেলেমেয়েরা অতীতের চেয়ে অধিক জ্ঞান অর্জন করছে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার ফল দেখলে সেটা মনে হয় না।
অথচ আমাদের পূর্বসুরীরা যারা নির্দিষ্ট সীমারেখার পাঠ্যসূচির মধ্যে লেখাপড়া শেষ করেছেন; টাকা খরচ করে কোচিং সেন্টারে কোনোদিন পড়তে যায়নি; তাদের অনেকেই মেধায় দেশ সেরা হয়েছেন। এমনকি অনেকেই জ্ঞানবিজ্ঞানে জগত সেরা হয়েছেন। তাদের শৈশব কৌশরে তথা শিক্ষাজীবনে ক্লাসের গাদা গাদা বই ছিল না। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধূলা এবং শিশু- কিশোর বয়স উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন। সৃজনশীল নামে কোনো পড়া ছিল না; ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির নামে এতো যুদ্ধাবস্থা ছিল না। কিন্তু তাদের বিদ্যা কোচিং সেন্টার ও শুধু ক্লাসের পাঠ্যসূচির মধ্যে সীমিত ছিল না। তারা বিচ্যুত ছিলেন না মাতৃভূমি, পৃথিবীর ইতিহাস-সংস্কৃতি শিক্ষা থেকে। লেখাপড়া ছাড়াও খেলাধূলা, সংস্কৃতিচর্চা, অনেক সৃজনশীল ও সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যা তাদের মস্তিস্ককে মেধা ধারণের সক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা সন্তানদের পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের দাস বানিয়ে ফেলেছি। যত টাকা লাগুক যতগুলো কোচিং স্টোরে পড়তে হোক ভাল রেজাল্ট চাই-ই। স্কুলের পাঠ্যসূচি এমন করেছি যেন তারা বই-খাতার ওপর থেকে মুখ তুলতে না পারে। আবার ‘মরার ওপর শাঁকের আঁর্টি’র মতোই কোচিংয়ের কারাগারে পুরে দিয়েছি ফলাফলের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে। সংসারের খরচ কমিয়ে সে টাকা ছেলেমেয়ের মানুষ গড়ার কারিগর তথা কোচিং টিচার নামে দানবদের হাতে তুলে দিচ্ছি। এতে করে আমরা কি সন্তানদের পরীক্ষার রেজাল্টের জন্যই অসীম সিলেবাসে বন্দি করে ফেলেছি না? পাঠ্যক্রম, পরীক্ষা এবং কোচিং সেন্টারে শিশু-কিশোরদের মস্তিস্কে বাড়তি চাপ দিয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তার সক্ষমতা কমিয়ে ফেলছি না? শিক্ষার নামে এটা কি সন্তানদের শৈশব ও কৈশোরকে হত্যার নামান্তর নয়?



 

Show all comments
  • সোনিয়া ১৮ জুলাই, ২০১৭, ৬:৩৬ পিএম says : 0
    বাস্তব ও তিক্ত সত্য গুলো তুলে ধরায় লেখক স্টালিন সরকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • রিপন ১৮ জুলাই, ২০১৭, ৬:৩৯ পিএম says : 0
    শিশু কিশোরদেরকে এই কারাগার থেকে মুক্ত করা দরকার।
    Total Reply(0) Reply
  • তাহমিনা ১৮ জুলাই, ২০১৭, ৬:৪২ পিএম says : 0
    এর একটা সমাধান হওয়া খুব জরুরী।
    Total Reply(0) Reply
  • Tazriya ১৮ জুলাই, ২০১৭, ৬:৪৩ পিএম says : 0
    শিক্ষার নামে এটা সন্তানদের শৈশব ও কৈশোরকে হত্যার নামান্তর
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কোচিং


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ