Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

গজল সম্রাট মেহেদী হাসান

| প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব : উপমহাদেশীয় রাগ সঙ্গীতের কিংবদন্তি, গজল স¤্রাট মেহেদী হাসানের জন্ম এক ঐতিহ্যবাহী শিল্পী পরিবারে। জন্মের পর মেহেদী হাসান অক্ষর জ্ঞানের পূর্বেই সুরের ভুবনের সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯২৭ সালের ১৮ জুলাই ভারতের রাজস্থানের ঝুনঝুন জেলাধীন লুনা গ্রামে কালা ওয়ান্ত সঙ্গীত পরিবারে মেহেদী হাসানের জন্ম। তার পিতা ধ্রæপদী সঙ্গীতের প্রখ্যাত ওস্তাদ আজিম আলী খান। মেহেদী হাসানের চাচা ওস্তাদ ইসমাইল আলী খানও ধ্রæপদী সঙ্গীতের খ্যাতিমান ওস্তাদ ছিলেন। পারিবারিক পরিবেশে সঙ্গীতচর্চার মাধ্যমে বেড়ে উঠেন তিনি। মেহেদী হাসানের সঙ্গীতে হাতে খড়ি বাবা-চাচার কাছেই। বাবা-চাচাই মেহেদী হাসানের সঙ্গীতগুরু। বারোদার মহারাজা সেকালে উপমহাদেশীয় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মেহেদী হাসানও বাল্যকালে বারোদার মহারাজার দরবারে প্রথম গজল পরিবেশন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর মেহেদী হাসানের পরিবার পাকিস্তানে চলে আসে। বসতি স্থাপন করে শাহিওয়াল এলাকায়। মেহেদী হাসান তখন মাত্র বিশ বছরের যুবক। পাকিস্তানে এসে আত্মীয়-স্বজনহীন অবস্থায় অর্থ কষ্টের সম্মুখীন হয় মেহেদী হাসানের পরিবার। জীবন সংগ্রামে নামতে হয় মেহেদী হাসানকেও। পারিবারিক জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে নিদারুন দুঃখ-কষ্ট ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলার মাঝেও মেহেদী হাসান সঙ্গীতচর্চা ত্যাগ করেননি। শিল্পী জীবনের শুরুতে মেহেদী হাসান লাহোরের বেশ কটি অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাতে সাফল্য আসেনি, সাড়া পাওয়া যায়নি বোদ্ধা-দর্শক শ্রোতার। ১৯৫৭ সালে মেহেদী হাসান রেডিও পাকিস্তানের করাচী স্টুডিওতে অডিশনের সুযোগ পেয়ে ঠুমরি, রাগ খাম্বাজ, তিলক কামোদ গেয়ে শোনান। রেডিও’র কর্মকর্তা জেড. বুখারি ও রফিক আনোয়ার মেহেদী হাসানের যাদুকরি কণ্ঠে বিমুগ্ধ হয়ে এ-গ্রেডের শিল্পী হিসাবে মাসিক ৩৫ রুপী বেতনে চাকরি দেন। খোদাপ্রদত্ত মেহেদী হাসানের যাদুকরি কণ্ঠ ঠুমরি ও গজলের জন্যই যুৎসই ছিল। তাই ক্লাসিক্যাল ও গজলের প্রতি অধিকতর মনোযোগী হয়ে উঠেন। সুরের প্রতি শর্তহীন ভালোবাসা ও আনুগত্য, অবিরাম চর্চা ও অধ্যাবসায়ের ফলে মেহেদী হাসান শাহেনশায়ে গজল হিসেবে খ্যাতি ও স্বীকৃতি অর্জন করেন। তার গায়কি ঢং, আবেগ, নিজস্বধারা ও সুমিষ্ট কণ্ঠ গজলের ক্ষেত্রে এক নিজস্ব ঘরানার সৃষ্টি করে যা অনেকেই ‘মেহবুব সুর’ বলে আখ্যায়িত করেন। উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তি লতামুঙ্গেশকর যথার্থই বলেছেন, ‘মেহেদী হাসানের কণ্ঠে স্বয়ং বাস করেন ঈশ^র’। উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র মো. রফিও যথার্থ বলেছেন, ‘আমরা গান করি আম জনতার জন্য আর মেহেদী হাসান গান করেন আমাদের জন্য’।
পাকিস্তানের প্রাথমিক যুগে মেহেদী হাসান পাকিস্তানী চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু করেন। ফিল্মি গানেও অসম্ভব রকমের জনপ্রিয়তা পান তিনি। পাকিস্তানী চলচ্চিত্রের সর্Ÿকালের সর্Ÿশ্রেষ্ঠ প্লেব্যাক সিংগার তিনিই। ষাটের দশকে প্রখ্যাত পাকিস্তানী কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের লেখা ‘ফিরিঙ্গি’ ছবির গজল ‘গুলুমে রাঙ্গভারে’ মেহেদী হাসানকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দেয়। মেহেদী হাসান রাগ সঙ্গীত থেকে প্লেব্যাকে এলেও চলচ্চিত্রের হালকা-অশ্লীল গান তিনি গাননি। প্লেব্যাকেও মেহেদী হাসান সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতের সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা ছিল। মেহেদী হাসানের গাওয়া বাংলা গান, ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’, ঢাকাই চলচ্চিত্র রাজা সাহেব এর ‘ঢাকো যতনা নয়ন দুহাতে’ এবং ‘তুমি যে আমার’ আধুনিক বাংলা গানের ভক্ত শ্রোতা চিরকাল মনে রাখবেন। বাঙালি জাতি ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন মেহেদী হাসান। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে যে স্বল্প সংখ্যক পাকিস্তানী শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী পাকিস্তানী গণহত্যার বিরোধী ছিলেন তাদের মধ্যে মেহেদী হাসান অন্যতম। ১৫ জুলাই ছিল তার জন্মদিবস, ১৮ জুলাই তার মৃত্যু দিবস। আমরা তাকে স্মরণ করছি।
লেখক : অ্যাডভোকেট, হাইকোর্ট এবং সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন