পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ইনকিলাব ডেস্ক : বক্সিং কিংবদন্তী মোহাম্মদ আলী ৫০ বছর আগে প্রথম যে লড়াইয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন, সেটি বক্সিং ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত লড়াইগুলোর একটি। মোহাম্মদ আলী তখনো মোহাম্মদ আলী হয়ে ওঠেননি, তিনি তখনো প্রায় অপরিচিত এক তরুণ বক্সার, ক্যাসিয়াস ক্লে। লড়াইয়ে তার প্রতিদ্ব›দ্বী বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন সনি লিস্টন। যেভাবে তিনি সেদিন সনি লিস্টনকে হারিয়ে দিলেন, সেটা ছিল অনেকের কল্পনারও বাইরে। সেই অবিস্মরণীয় লড়াইয়ের কাহিনী নিয়ে বিবিসি বাংলা’র ‘ইতিহাসের সাক্ষী’। ১৯৬৪ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারী। বক্সিং রিং-এ বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন সনি লিস্টনের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছে ক্যাসিয়াস ক্লে নামের এক আনকোরা কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ।
‘আমিই হচ্ছি বিশ্ব সেরা। মিস্টার লিস্টন একজন বৃদ্ধ মানুষ। এই বক্সিং রিং-এ আমার পাশে তার কোন জায়গা নেই। বেচারা সনি লিস্টনকে আমি সাহায্য করতে চাই। আমি তাকে একটা শিক্ষা দিতে চাই। আমি তাকে সব কিছুই শেখাতে চাই। কিন্তু সনি লিস্টন যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমার বিরুদ্ধে লড়বেন, আমার মনে হয় তার প্রথম দরকার কীভাবে ঘুষি খেয়ে পড়ে যেতে হয় সেই শিক্ষা’।
কিন্তু ক্যাসিয়াস ক্লে যতই বড়াই করুন, বক্সিংয়ের খোঁজ খবর যারা রাখেন, সনি লিস্টনকে যারা চেনেন, তারা কিন্তু এই লড়াইয়ের ফল কী হবে, তা আগে থেকেই আঁচ করে নিতে পারেন।
লড়াই দেখতে ফ্লোরিডার মায়ামি বীচে যারা জড়ো হয়েছেন, তাদের ধারণা লিস্টন আসলে ক্ল্যাসিয়াস ক্লে-কে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবেন। সনি লিস্টনের নক-আউট পাঞ্চের কথা তারা জানেন।
রবার্ট লিপ সাইড ছিলেন ১৯৬৪ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সবচেয়ে জুনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার। তার ধারণাও ছিল সেরকমই।
‘এই লড়াইয়ে ক্যাসিয়াস ক্লে এক বা দুই রাউন্ডের বেশি টিকবেন, সেরকম আশা একেবারেই ছিল না। আর এ কারণেই যেন আমাকে এই লড়াইয়ের খবর সংগ্রহ করতে পাঠানো হয়েছিল’।
‘আমার মনে হয় পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাদের সবচেয়ে অভিজ্ঞ রিপোর্টারকে এরকম একটা লড়াই কভার করতে পাঠিয়ে সময় নষ্ট করতে চায়নি। পরিবর্তে আমাকে ফ্লোরিডায় পাঠানো হলো। আমাকে নির্দেশ দেয়া হলো, মায়ামি পৌঁছেই আমি যেন যেখানটায় লড়াই হবে, সেখান থেকে সবচেয়ে কাছের হাসপাতাল পর্যন্ত গাড়ীতে একবার যাওয়া-আসা করি। তাদের আশঙ্কা ছিল, লড়াই শেষে ক্যাসিয়াস ক্লে-কে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করতে হবে। সেই খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আমি যেন পত্রিকার ডেডলাইন মিস না করি, সে জন্য তারা আগে থেকে আমাকে রাস্তাটা চিনে রাখতে বললো’।
কিন্তু লিস্টন আর ক্লের লড়াই যখন শুরু হলো, তখন সাংবাদিকরা কিন্তু তাদের মত বদলাতে শুরু করলেন। রবার্ট লিপ সাইড মনে করতে পারেন সেই লড়াইয়ের নাটকীয় মুহূর্তগুলো।
‘দুই বক্সার রিংয়ের মাঝখানে মুখোমুখি হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি কিন্তু একবারও ভাবিনি, এই লড়াইয়ে ক্যাসিয়াস ক্লে জেতার বিন্দুমাত্র আশা আছে। কিন্তু যখন তারা সামনা সামনি দাঁড়ালেন, আমি প্রথম বারের মতো বুঝলাম যে, ক্যাসিয়াস ক্লের শরীর আসলে সানি লিস্টনের চেয়ে বড়। আমরা প্রস্তুত হচ্ছিলাম ডেভিড আর গলাইয়াথের লড়াই দেখার জন্য। কিন্তু আদতে দেখলাম, আমরা যাকে ডেভিড ভাবছি, সে লিস্টনের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি লম্বা, আর প্রায় তার সমানই চওড়া। তখন আমরা ভাবছিলাম, হয়তো আজকে কোন একটা কিছু ঘটে যেতে পারে’।
‘শুরু থেকেই লড়াইয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল ক্যাসিয়াস ক্লে। সে পুরো রিং জুড়ে নেচে বেড়াচ্ছিল। যখন খুশি ঘুষি বাগিয়ে আঘাত করছিল লিস্টনকে। পঞ্চম রাউন্ডের অল্প কিছু সময় বাদ দিলে, পুরো সময়টা জুড়ে লড়াইয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল ক্যাসিয়াস ক্লের হাতে। পঞ্চম রাউন্ডে মনে হচ্ছিল লিস্টনের দস্তানা থেকে কোন ঝাঁঝালো তরল পদার্থ যেন ক্যাসিয়াস ক্লের চোখে ঢুকে গেছে’।
পরে সাংবাদিকদের দেয়া সাক্ষাৎকারে ক্লে বলেছিলেন, ঝাঁঝাঁলো কিছুতে তার চোখ জ্বলছিল, তিনি চোখে প্রায় কিছুই দেখছিলেন না। ‘ক্লের মনে হয়েছিল তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়েছিল একটা পর্যায়ে ক্লে লড়াই থামিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। হাতের গেøাভস খুলে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার প্রশিক্ষক অ্যানজেলো ডানডি তার চোখ মুছে দিলেন, তাকে আবার ঠেলে বক্সিং রিং পাঠালেন এবং বললেন, চোখ পরিস্কার না হওয়া পর্যন্ত লিস্টন থেকে দূরে দূরে থাকার জন্য। ক্লে সেকথা শুনেছিলেন এবং এরপর তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন’।
কিন্তু এর মধ্যেই লিস্টনের চোখের নিচে কেটে গিয়েছিল, সেখান থেকে রক্ত গড়াচ্ছিল। তার বাঁ হাত যেন ঠিকমত কাজ করছিল না। সপ্তম রাউন্ডের লড়াইয়ের ঘন্টা যখন বাজলো, লিস্টন কিন্তু বসেই রইলো।
‘লিস্টনের শরীরে সেরকম বিরাট কোন আঘাতের চিহ্ন আমরা দেখছিলাম না। সুতরাং আমরা আসলে বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কী ঘটছে। এটা একটা হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন্সশীপ লড়াই। জেতার জন্য এখানে বক্সাররা প্রাণ দিয়ে হলেও লড়বে, সেটাই আশা করা হয়’।
কিন্তু লিস্টন হার মেনে নিলেন। তিনি পরে বলেছিলেন, তার বাঁ হাত কাজ করছিল না, সেটা কোন কারণে অকেজো হয়ে পড়েছিল।
‘আমাদের মনে তখন প্রশ্ন জাগলো, আসলেই কি তাই, নাকি লিস্টন আসলে কাপুরুষ। নাকি তিনি আসলে ক্লের কাছে অসন্মানজনকভাবে হেরেছেন। নাকি এটা একটা পাতানো খেলা! মনে রাখতে হবে, একটা ফিরতি লড়াই খেলার জন্য লিস্টন চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু লড়াইয়ের এই ফল দেখে দর্শকরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। অনেকে আনন্দে চিৎকার করছিলেন, কেউ কেউ লিস্টনকে দুয়ো দিচ্ছিলেন। অনেকে ছিলেন বিভ্রান্ত। তারা বুঝতে পারছিলেন না কী ঘটছে। আসলে কী ঘটেছে সে ব্যাপারে কেবল একজনই যেন নিশ্চিত ছিলেন। তিনি হচ্ছেন ক্যাসিয়াস ক্লে। তিনি বক্সিং রিংয়ের দড়ি ধরে চিৎকার করছিলেন, আমি দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছি, আমিই এখন বিশ্বের রাজা’।
ক্লের কাছে লিস্টনের এই অবিশ্বাস্য হার পরের দিন সব পত্রিকার প্রধান শিরোণাম। রবার্ট লিপসাইডের রিপোর্টও ছাপা হলো নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায়। আর তরুণ ক্যাসিয়াস ক্লে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে পরবর্তী কয়েক মাস ধরে পত্রিকার শিরোণাম হয়ে থাকলেন। তার নতুন নাম হলো মোহাম্মদ আলী।
ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমি যে আল্লাহ এবং তার বার্তাবাহক মোহাম্মদের সঙ্গে আছি, এটা প্রমাণের জন্য যদি আমাকে বক্সিং ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে কাজ খুঁজতে হয়, আমি এই মুহূর্তেই সেটা করতে রাজী’।
সনি লিস্টন আবার ফিরতি লড়াইয়ে এসে আলিকে বুঝিয়ে দেবেন, কে শ্রেষ্ঠ, সেটাই আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু এই ফিরতি লড়াইটা যখন হলো, সেটি কিন্তু শেষ হয়ে গেল চোখের পলকে।
‘এই লড়াইটা আসলে এক রাউন্ডেরও কম সময়ে শেষ হয়ে যায়। রিংয়ের ভেতরে দুজনে মুখোমুখি দাঁড়ানোর পর সনি লিস্টন মোহাম্মদ আলীর কাছে সরে এলেন। আর তার পরই তিনি মেঝেতে পড়ে গেলেন’।
প্রথম রাউন্ডের লড়াই শুরু হতে না হতেই সনি লিস্টন যেভাবে মাটিতে পড়ে গেলেন, তাতে সবাই অবাক হলেন। কারণ যে নক আউট পাঞ্চে তিনি ধরাশায়ী হলেন সেটা আসলে কেউ দেখতে পাননি। রবার্ট লিপ সাইড বলছিলেন, মোহাম্মদ আলীর এই পাঞ্চটি পরে ‘ভৌতিক পাঞ্চ’ নামে পরিচিতি পায়।
‘আমি বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার হাওয়ার্ড কোসেলের পাশে বসে ছিলাম। রিংসাইডে বসা লোকজনের মধ্যে একমাত্র তার সামনেই একটি টিভি মনিটর ছিল। একারণেই আসলে মোহাম্মদ আলীর সেই ভৌতিক পাঞ্চটি আমরা বার বার দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। পুরো দৃশ্যটি এগারোবারের মতো দেখার সময় আমি দেখলাম, সনি লিস্টন সামনে এগুচ্ছেন, তার সঙ্গে মোহাম্মদ আলীর দূরত্ব খুবই কম, মোহাম্মদ আলী তার ডান হাত দিয়ে ঘুঁষি মারলেন, কিন্তু এত কাছে থেকে ঘুঁষিটি মারলেন, তা প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত করলো সনি লিস্টনের মুখে। দর্শকরা বুঝতে পারছিল না কী ঘটছে। রেফারি আসলে তার গণনা ভুলে গিয়েছিলেন। রেফারি ছিলেন সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জর্জ জো ওয়ালকট। রিংসাইডে বসে থাকা এক ম্যাগাজিন সম্পাদক, তার নাম ছিল ন্যাট ফ্লাইশার, তিনি তখন গুনতে শুরু করলেন এবং চিৎকার করে তা রেফারিকে বলতে থাকলেন। সবাই তখন চরম বিভ্রান্তিতে। কেউ বুঝতে পারছে না কী ঘটছে। যদি তখন সেখানে কোন বক্সিং কর্তৃপক্ষ দায়িত্বে থাকতেন, তাহলে হয়তো, এই পুরো লড়াইটা আবার নতুন করে শুরুর নির্দেশ দিতেন।
কিন্তু এই লড়াই আর নতুন করে শুরু হয়নি। বক্সিং ইতিহাসে এই লড়াইয়ে আলী তার প্রতিপক্ষকে নকআউটে পরাজিত করেন বলে উল্লেখ আছে। আলীর ঘুঁষি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া লিস্টন কি আসলেই সেদিন আর উঠে দাঁড়াতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন, তা নিয়ে অবশ্য আজও বিতর্ক অব্যাহত আছে। রবার্ট লিপসাইড মনে করেন, আসলে লিস্টন মেনে নিয়েছিলেন যে, তিনি এবারও পরাজিত হতে যাচ্ছেন।
‘আসলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি আবারও মার খেতে যাচ্ছেন। কাজেই তিনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আর কোন মানে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরের দিন সকালে আমি তার বাংলোয় গিয়েছিলাম। ঐ একবারই আমি লিস্টনকে খোশ মেজাজে দেখেছিলাম। আমি দেখেছিলাম, যে লোকটি লিস্টনের স্যুটকেস বহন করছে তাকে লিস্টন কয়েকটা বিশ ডলারের নোট বখশিষ দিয়েছে। লিস্টনের তরফে সেটাকে বেশ বড় বখশিষই বলতে হবে। আমি তাকে সেকথা বলার পর লিস্টন আমার দিকে তাকিয়ে বললো, কে জানে, হয়তো এই পথে আমি আবারও আসতে পারি! তারপর এমন একটা হাসি দিল, যেন সে এখন ভারমুক্ত। যার মানে হতে পারে, তার জন্য বক্সিং এর এখানেই ইতি। পরে আমি ভাবছিলাম, যে পাঞ্চটি লিস্টনকে ধরাশায়ী করেছে, সেটাও তাকে এই কথাই বলেছিল কিনা--- ওখানেই পড়ে থাক, ছেড়ে দাও, তোমার লড়াই এখানেই শেষ!
সানি লিস্টন এরপরও অবশ্য কয়েকটি লড়াইয়ে জয়ী হন, প্রতিপক্ষরা সেরকম শক্তিশালী কেউ ছিলেন না। কিন্তু পাঁচ বছর পর রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়। আর মোহাম্মদ আলী বক্সিং ইতিহাসের সবচেয়ে নামকরা বক্সারে পরিণত হন। রবার্ট লিপসাইড সাংবাদিক হিসেবে মোহাম্মদ আলীর পুরো বক্সিং জীবনের খবর সংগ্রহ করেছেন। স¤প্রতি তিনি তার আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।