পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
উবায়দুর রহমান খান নদভী : মোহাম্মদ আলী দ্য গ্রেটেস্টের ইন্তেকালের সংবাদটি প্রচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু টিভি চ্যানেল মারাত্মক হীনমন্যতার পরিচয় দিয়েছে। এটা মালিক, পরিচালক, সংবাদকর্মী কিংবা অন্য কোনো দায়িত্বশীলের ক্ষুদ্রমনের ছাপ কি না জানা নেই। তবে শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে একজন মহান ব্যক্তির মৃত্যু সংবাদ দেয়ার সময় চিরাচরিত ধর্মীয় বিধি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়া বা লেখা হবে না এমন অবাক করা কাজটি অবলীলায় করেছে কিছু নিন্দিত ও ঘৃণিত লোক। মুসলমান মাত্রেরই জানা আছে যে, মৃত্যু আমাদের জীবনে একটি ধর্মীয় বিষয়। এতেও ঈমান, বিশ্বাস, সুন্নাহ ও শরীয়তের দখল আছে। মুসলমানের মৃত্যু কোনো নিছক জৈবিক পরিণতি নয়। জীবজন্তু বা পশুপাখির জীবনাবসান আর মুসলমানের মৃত্যু একই শ্রেণীভুক্ত বিষয় নয়। মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও সভ্যতার মূল্যবোধ বিস্মৃত হয়ে একশ্রেণীর লোক এখন মৃত্যুকে অবহেলার বিষয়ে পরিণত করেছে। টিভি চ্যানেলে দেখা যাবে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যু সংবাদ প্রচারের বেলায় দেখা যায়, বলা হচ্ছে, তিনি মারা গেছেন। আগে বলা হতো মৃত্যুবরণ করেছেন। অথচ হাজার বছরে বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত শব্দ হলো, ইন্তেকাল করেছেন। এর মধ্যে ধর্মীয় দার্শনিক অবস্থার বিষয়টি লুক্কায়িত রয়েছে। মৃত্যু মানে জীবনের পরিসমাপ্তি নয়। এ হচ্ছে রূহ বা আত্মার লোক পরিবর্তন। ইহলোক থেকে পরলোকে গমন বা স্থানান্তর। যার লাগসই শব্দ হচ্ছে ‘ইন্তেকাল’। তা ছাড়া মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লাশ, কাফন, দাফন, জানাজা, দোয়া ইত্যাদি বলা। এখন দেখা যায় একশ্রেণীর লোক মরদেহ, শেষকৃত্য, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, প্রার্থনা বলতেই বেশি উৎসাহী। মৃত ব্যক্তিকে ‘মরহুম’ বা আল্লাহর রহমত প্রত্যাশী, ক্ষমাপ্রার্থী না বলে বলা হয় ‘প্রয়াত’। যার সাথে ইসলামী তাহযীব ও তামাদ্দুনের কোনো সম্পর্ক নেই। রহমত, মাগফিরাত ইত্যাদির কোনো সংশ্লেষ নেই। এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। সচেতনভাবে ইসলামী পরিচিতিমূলক শব্দ পরিভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে হবে। মৃত্যু সংবাদ শুনে ‘ইন্না লিল্লাহি’ পাঠ যেমন মুসলমানের পরিচায়ক ঠিক তেমনি কারো ইন্তেকালের সংবাদ শুনে এই আয়াত পাঠ করলে পাঠক শত শত সওয়াব লাভ করেন। মৃত ব্যক্তিটির জন্যও দোয়া হয়। ফাতিহা, কুল, কালাম, দোয়া ও মুনাজাত করলে তার রূহের আরো শান্তি-স্বস্তি-উন্নতি হয়। বিশ্বব্যাপী মুসলমানের হাজার বছরের এ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রীতি বাংলাদেশেও প্রচলিত। কিন্তু একশ্রেণীর মিডিয়া ও কিছুসংখ্যক হীনমন্য বাজে লোক এমন আচরণ করছেন যেন তারা এ দেশের মানুষের জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই ইসলাম, মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোনো চিহ্নই বাকি রাখতে রাজি নন। তাদের এ দুরভিসন্ধির বিষয়ে সবাইকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। এই দুষ্টচক্রকে মোকাবেলা করতে হবে এবং আরোপিত ধ্বংসাত্মক অপসংস্কৃতি রুখতে হবে। কেননা এসব ঔদ্ধত্য নাস্তিকতা, বস্তুবাদ ও ধর্মদ্রোহিতা থেকে সৃষ্ট। ঈমানী ভাবধারা সুরক্ষিত রাখতে হলে প্রতিটি মুসলমানকে ধর্মীয় পরিচয়, রীতি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য শক্ত হাতে অবলম্বন করার বিকল্প নেই। মহান মুসলিম আদর্শ ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আলীর ইন্তেকালের বিষয়ে বাংলাদেশের কিছু মানুষের অজ্ঞতা, মূঢ়তা ও হীনমন্যতার জন্য জাতি হিসেবে আমরা যেন ছোট না হই, এ প্রত্যাশা রেখে মরহুমের বিষয়ে স্মৃতি অর্পণমূলক কিছু কথা তুলে ধরছি।
যুক্তরাষ্ট্রে নিজ জন্মশহর লুইসভিলে আজ জুমাবার দাফন করা হচ্ছে মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীকে। কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন কম্পাউন্ডে আয়োজন করা হয়েছে নামাজে জানাজার। যেখানে ২০ হাজার মুসল্লির স্থান সঙ্কুলান হবে। আমেরিকার একটি ছোট্ট জনপদে ২০ হাজার মুসল্লি জানাজায় সমবেত হওয়া অনেক বড় কথা। এ ছাড়াও লাখো মানুষ দি গ্রেটেস্ট আলীর শেষ বিদায়ী অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, যারা নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষ। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আলীর ভক্ত। নামিদামি মিডিয়ার পরিবেশিত সংবাদ ও ছবির মাধ্যমে বিশ্ববাসী দেখছে এই বিশ্বপ্রতিভার শেষ যাত্রা। লাশবাহী গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে কিংবদন্তির কফিন, কালো মখমলের ওপর আয়াত উৎকীর্ণ চাদরে ঢেকে দেয়া। আগেই বলে দেয়া হয়েছে, মোহাম্মদ আলীর জানাজার আগে তার পরিবার সমবেতভাবে দোয়া করে তাকে বিদায় জানাবে। এর পর তার স্মৃতি শহরে প্রদক্ষিণ করবে তার জানাযা মিছিল। ধর্মীয় রীতিতে পড়া হয়েছে তার নামাজে জানাজা। যে মার্কিন শায়খ নামাজ পড়ান তিনি তিনটি আরব দেশে দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন। তরুণ বয়সে ইসলাম গ্রহণের পর বহু বর্ণিল জীবন পাড়ি দিয়ে একজন সুন্নি মুসলিম, আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর অনুগত বান্দা, মুক্তমনা, উদার মানবতার কল্যাণে নিবেদিত সুফি ব্যক্তি হিসেবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী ৩ জুন শুক্রবার ইন্তেকাল করেন। তার মতো মহান ব্যক্তির চলে যাওয়ার সংবাদ বিশ্বব্যাপী দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত তার ভক্তদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায় দোয়া খতম, তিলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে তার রূহের মাগফিরাত ও পারলৌকিক কল্যাণ কামনা করতে থাকে। বিশ্বসেরা মুসলিম ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আলীর ওফাতের খবর শুনে ভূপৃষ্ঠে কী পরিমাণ মানুষ ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়েছেন, কত ভক্ত যে ফাতিহা, কুল, সুরা, কালাম, দোয়া পড়ে তার রূহের প্রতি সওয়াব রেসানি করেছেন, কত মসজিদ মাদরাসা, খানকাহ ও ইসলামিক সেন্টারে কোরআন খতম ও ইসালে সওয়াব করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে তার কোনো গণনা নেই। ১০ জুন তার জানাজা ও দাফনে দৈহিকভাবে লাখো মানুষ যোগ দিলেও এ মহান মুষ্টিযোদ্ধার বিদায়ে শোকাভিভূত শত কোটি মুসলমান আত্মিকভাবে শরিক রয়েছেন। ইসলাম গ্রহণ করে পরকালে মুক্তি ও শান্তির পথে এগিয়ে আসা এ মহান যোদ্ধা বিশ্বের সৌভাগ্যবান লোকদের অন্যতম, যিনি ক্রীতদাসের মতো জীবন থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামের সম্মান ও গৌরবময় জীবনে পদার্পণ করেন। তারুণ্যের সে কেসিয়াস ক্লে জুনিয়র পরবর্তীতে হন মোহাম্মদ আলী ক্লে। প্রথমত ন্যাশন অব ইসলাম মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরবর্তীতে তিনি মুসলিম বিশ্বের বিখ্যাত নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী সুন্নি ঘরানার মুসলিম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ইন্তেকালের পর আরব বিশ্বে তার ভক্তরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঐতিহাসিক সে ছবিগুলো প্রচার করতে শুরু করেন, যা তার সাড়া জাগানো বৈপ্লবিক জীবনেরই স্মারক। আরব জাতীয়তাবাদের নেতা জামাল আবদুন নাসেরের সঙ্গে, ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে হাস্যোজ্জ্বল মোহাম্মদ আলীকে। প্রজাপতির মতো নেচে নেচে মৌমাচির মতো হুল ফোটানোর কৌশল ছিল আলীর মুষ্টিযুদ্ধে আকর্ষণীয় দিক। ক্রীড়াবিশ্ব একমত যে, মোহাম্মদ আলীই বক্সিংকে খেলা থেকে শিল্পে পরিণত করেছেন।
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও তাকে মার্কিন সমাজে বহু হেনস্থা হতে হয়েছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ তাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে পাঠাতে চাইলে তিনি তার স্বভাবসুলভ সরল ভাষায় বলে দেন, ভিয়েতনামিদের কেন আমি মারতে যাব? ওরা আমার কী ক্ষতি করেছে। ওরা তো আমায় কালো বলে গালি দেয়নি। আমার নাকে ঘুষি মারেনি। এ জন্য তাকে শাস্তি পেতে হয়। তার দু’বারের চ্যাম্পিয়নশিপ ও খেতাব কেড়ে নেয়া হয়। তাকে কারাদ-ে দ-িত করা হয়। অবশ্য উচ্চ আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণ থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয় ঘটে। মোহাম্মদ আলী মার্কিন যুদ্ধনীতির প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে দেশে-বিদেশে সমাদৃত হন। মানবতার সপক্ষে তার সাহসী ভূমিকা তাকে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। তখন থেকেই যদি মার্কিন নীতি শাস্তি ও মানবতার সপক্ষে পরিচালিত হতো তাহলে বিশ্বব্যাপী মানুষ আজ পরাশক্তির সুবিচার ও ন্যায়নীতির সুখ্যাতি করত। এখানে রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তি মোহাম্মদ আলীর গ্রহণযোগ্যতা ও সমাদর অধিক উজ্জ্বল।
অনন্য প্রতিভা হিসেবে মুষ্টিযোদ্ধা আলী হয়তো বাংলাদেশেও পরিচিতি পেতেন কিন্তু ইসলাম গ্রহণের ফলে এদেশের সঙ্গে তার আত্মীয়তার বন্ধন রচিত হয়। তার বাংলাদেশ সফরের সময় এ দেশের গণমানুষের ভালোবাসায় তিনি মুগ্ধ হন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট প্রদান করেন তখন আবেগাপ্লুত মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন, আমেরিকা যদি কখনো আমাকে তাড়িয়ে দেয় তাহলে আমি বাংলাদেশে এসে থাকব। এ দেশকে আমি ভালোবাসি। এটি একটি বেহেশত। মোহাম্মদ আলী তার গোটা জীবনটিই মানুষের জন্য নিবেদন করে গেছেন। বহু বছর পারকিনসন রোগে ভোগেও তিনি তার ঈমানের জোর, যুদ্ধজয়ের মানসিকতা, সুবিবেচক স্নেহপ্রবণ মানবিক অন্তর ও ইসলামী আখলাকের ছটায় বিশ্ববাসীকে আলোকিত করে গেছেন। বাংলাদেশের মানুষ তার ঈমানী উত্তরণকে পরম অভিভূত হয়ে গ্রহণ করে। তাকে ভালোবেসে কক্সবাজার ও সিলেটে তাকে দুই ভক্ত কিছু জমিও উপহার দেন। তার মৃত্যু বাংলাদেশের ৯২% মুসলমানের জন্য যেন কোনো আত্মীয়ের চলে যাওয়া। আলীর পরিবার একটি আদর্শপ্রেমী মুসলিম পরিবার। মৃত্যুর মুহূর্তটি তারা কীভাবে বরণ করেছিল তা বর্ণনা করতে গিয়ে তার মেয়ে হানা বলেন, ‘আমরা শোকে কাতর। তারপরেও আমরা খুশি যে, বাবা মুক্ত হয়েছেন। চলে যাওয়ার সময় বাবাকে ফিসফিসিয়ে বলছিলাম, তুমি চলে যাও বাবা। তোমার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা তোমাকে ভালোবাসি। এখন তুমি আল্লাহর কাছে যেতে পার।’ ৭৪ বছর বয়সী এ বিশ্বতারকা ৩৩ বছর ধরে অসুস্থতায় কাটালেও ২১ বছর তিনিই ছিলেন, মুষ্টিযুদ্ধের মঞ্চের সম্রাট। ৬১টি লড়াইয়ের মধ্যে ৫৬টিতে তিনি বিজয়ী হন। অ্যারিজোনা রাজ্যের এক হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় আলীকে তার চারপাশে থাকা স্বজনরা জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন। কেউ কেউ তার হাত কোলে নিয়ে বসেছিলেন। অনেকেই তাকে চুমু খাচ্ছিলেন। সবার মুখেই ছিল দোয়া, কালাম ও তিলাওয়াত।
তিনবারের হেভিওয়েট ও একবার লাইট ওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। ১৯৬৪ সালে ইসলাম গ্রহণের পর তার পরিচিতি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক শোকবার্তায় বলেন, যেভাবে সারা বিশ্ব তাকে স্মরণ করছে তাতেই তার বর্ণিল জীবন সম্পর্কে ধারণা করা যায়। আলীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। তিনি বলেন, মোহাম্মদ আলী তার সময়ের চেয়ে বড় মাপের মানুষ ছিলেন।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী ৭৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করলেন। তার মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী যে সাড়া পড়ল তা দেখে অনেক তত্ত্বজ্ঞানীর ধারণা হয়েছে যে, মোহাম্মদ আলী মূলত একজন কামেল সূফী ব্যক্তি ছিলেন। পৃথিবীতে মহান আল্লাহর দু’টি ব্যবস্থাপনা রীতি কার্যকর রয়েছে। ১. নেযাম তাকভীনি ২. নেযাম তাশরীয়ী। তাকভীনি অর্থাৎ সৃষ্টি, বিবর্তন ও পরিচালনাগত ব্যবস্থা মহান রাব্বুল আলামীন তার যে কোন বান্দাকে ব্যবহার করে পরিচালনা করেন। আর তাশরীয়ী অর্থাৎ দীন, ধর্ম ও শরীয়তগত ব্যবস্থা পরিচালনা করেন মুসলিম বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দ্বারা। তাকভীনি নেযামে নিযুক্ত লোকবলের পরিচিতি খুবই বর্ণাঢ্য। তাদের কেউ কুতুব, আবদাল, গউস, কেউ সামান্য কুলি-মজুর পেশাজীবী। এ কাজে সম্রাট, শাসক, দিগি¦জয়ীসহ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদেরও নিয়োগ দেয়া হয়। যাকে নির্বাচিত করে কাজ দেয়া হচ্ছে তিনিও জানেন না তাকে দিয়ে সর্বশক্তিমান কী কাজ নিচ্ছেন। সৃষ্টিকর্তার মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিশাল কর্মকা-ে কোন অংশটুকু তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে।
২২ বছরের এক তরুণকে ইসলামের দুয়ারে টেনে আনার পেছনে কী এমন বিধি লিপিবদ্ধ ছিল। যার নাম আজ লেখা হয়ে গেল বিশ্ব ইতিহাসের স্বর্ণফলকে। ৭০০ বছর আগের মুফতি মুহাদ্দিস ও যুগশ্রেষ্ঠ দার্শনিক মাওলানা জালালুদ্দীন রুমিকে আল্লাহ প্রেম ও মানবতার জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। আবদাল শামসে তাবরেযির সংস্পর্শে এসে রুমি চির অমর হয়ে গেলেন। মসনবী রচনা করে বিশ্বের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলেন। একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বসেরা প্রতিভার উপর নানারকম জরিপ চালায়। টাইমের জরিপে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে সমান গ্রহণযোগ্য ও কাম্য, মিলেনিয়ামের সেরা মরমী কবি নির্বাচিত হন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি। তুরস্কের কওনিয়ার এ আধ্যাত্মিক কবি ও মহান দার্শনিকের আত্মাকে নিজের অন্তরাত্মা ও মননে আবিষ্কার করে, ইতিহাসে খ্যাত হন উপমহাদেশের কবি আল্লামা ইকবাল। মোহাম্মদ আলী ক্লে নির্বাচিত হয়েছেন শতাব্দীর সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। বিখ্যাত ক্রীড়া ম্যাগাজিন ‘স্পোর্টস ইলস্ট্রেটেড’ এর ‘স্পোর্টসম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি’ খেতাবে ভূষিত হন আলী। বিবিসির ‘স্পোর্টস পার্সনালিটি অব দ্য সেঞ্চুরি’ খেতাবও দেয়া হয় তাকে। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি তার আত্মজীবনী গ্রন্থেও রয়েছে। ১৯৭৬ সালে ‘দি গ্রেটেস্ট : মাই ওন স্টোরি, ও ২০০৪ সালের ‘দ্য সউল অব অ্যা বাটারফ্লাই’ বহুল আলোচিত।
মোহাম্মদ আলী ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলার সময় বলেছিলেন, ইসলাম ও মানবতার নীতি এ যুদ্ধের অনুমতি দেয় না। দাসোচিত জীবন থেকে মুক্তির ধর্ম মহান ইসলামে প্রবেশের পর দীর্ঘ জীবনে তিনি নিষ্ঠা, সাহস, বীরত্ব, প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, মোহাম্মদ আলী ছিলেন মুসলিম জাতির জন্য একটি শতাব্দীর প্রতীক ব্যক্তিত্ব। ১৯৬৪ সালে তিনি যখন খ্যাতির শীর্ষে তখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সনি লিটনকে নক আউট করে যে হুংকার দেন তাতে বিশ্ব কেঁপে ওঠে। তিনি বলেন, আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট। আজ থেকে আমি আর ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে নই, আজ থেকে আমি মোহাম্মদ আলী। মাথা উঁচু করেই থাকব আজ থেকে। কারণ, মোহাম্মদ কখনো মাথা নীচু করতে জানে না।
মোহাম্মদ আলী মাথা উঁচু করেই জীবন কাটিয়ে গেছেন। একজন সূফী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইতিহাসে দেখা যায়, মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির জানাযায় মুসলমানদের ঢল নামে। ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও ক্রন্দনরত অবস্থায় মাওলানার অন্তিমযাত্রায় শরিক হয়। আজ লুইসভিলের কেঙ হিল কবরস্থানে সূফী মোহাম্মদ আলীকে দাফনের সময়ও সবধর্মের মানুষ তার শোকাচ্ছন্ন শেষযাত্রায় শামিল রয়েছেন। মোহাম্মদ আলী সবসময়ই বলতেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের বিষয়টা হল নিজেকে ইসলামের জন্য বিলীন করে দিতে পারা।’ ‘অ্যাকসেট্যান্স অব ইসলাম বাই গ্রেট পারসনালিটিজ অ্যান্ড থিংকার্স’ গ্রন্থে উল্লেখিত মোহাম্মদ আলীর বক্তব্য দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। তিনি বলেন, ১৯৬৪ সালে ফ্লোরিডায় সর্বপ্রথম আমি শুনলাম, সৃষ্টিকর্তা একজন। যারপরনাই অবাক হলাম। ও সময়ই আমি জানতে পারি যে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী। যিশুখৃষ্টও আল্লাহর প্রেরিত নবী। এটা ছিল আমার কাছে একেবারেই নতুন এবং এটা আমার উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। ইসলাম গ্রহণ করার পর আমি সত্যিকারের শান্তি এবং সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম। কীভাবে সালাত আদায় করতে হয়, রোজা রাখতে হয় এবং সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় তা শিখতে থাকলাম। ধার্মিক মুসলমান হওয়ার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়ে দেব মানুষের মাঝে। আল্লাহর রহমতে আমি ২০ লাখ আমেরিকানকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করতে পেরেছি।
ইসলাম জগতে মোহাম্মদ আলীর গুরুত্ব, অবদান ও অবস্থান এ থেকেই আন্দাজ করা যায়। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উচ্চাসন দান করুন। বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক মানুষ ইসলামের ব্যাপারে যে হীনম্মন্যতার পরিচয় দিচ্ছে তাদের সুমতি হোক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।