Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাটকা আহরণে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় বাজারে ইলিশের সরবারহ বাড়বে

| প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম


নাছিম উল আলম : মৎস বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকে ৩০ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ইলিশ পোনা-জাটকা আহরণে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পরে দক্ষিণাঞ্চল সহ উপক‚লীয় এলাকার জেলেরা অনেকটা সাচ্ছন্দেই নদ-নদী ও সাগর উপক‚লীয় এলাকায় জাল ফেলছে। এতে করে বাজারে ইলিশের সরবারহ আরো কিছুটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অন্যান্য মাছের দামও কিছুটা ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে আসবে বলে মনে করছেন বাজার পর্যবেক্ষকগন।
মৎস অধিদফতরের সুপারিশের আলোকে অন্যান্য বছরের মত এবারও নিম্ন মেঘনা নদী, শাহবাজপুর চ্যানেল ও তেতুলিয়া নদীতে মার্চ ও এপ্রিল মাসে এবং পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে নভেম্বর-জানুয়ারি মাসের সময়কালকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়। এছাড়াও শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণে চাঁদপুর জেলার মতলব ও শরিয়তপুর উপজেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবিস্থিত পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকায় দেশের ৫ম অভয়াশ্রমে মার্চ-এপ্রিল মাসে ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখা হয়। বরিশালের হিজলা উপজেলার নাছকাটি পয়েন্ট, হরিনাথপুর পয়েন্ট, ধুলখোলা পয়েন্ট এবং মেহেদিগঞ্জ উপজেলার ভাষান চর পয়েন্ট এলাকার মেঘনার শাখা নদী, হিজলা উপজেলার ধর্মগঞ্জ ও নয়া ভাঙনী নদী এবং মেহেদিগঞ্জ উপজেলার লতা নদীর ৬০ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ ও জাটকার ষষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেব ঘোষণার বিষয়টিও সরকারের বিবেচনাধীন।
তবে এবার জাটকা আহরণে বিরতিকালীন সময়ে বেকার জেলেদের পূনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসস্থানের ব্যবস্থা ছিল অনুপস্থিত। পাশাপাশি এ সময়ে ক্ষতিগ্রস্থ জেলে পরিবারগুলোর জন্য চাল বিতরণ হ্রাস সহ তা সময়মত দক্ষিণাঞ্চলের অনেক উপজেলাতে বিতরণ হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি একদিকে চাল বরাদ্ধ চাহিদার ৬০ ভাগেরও বেশি হ্রাস, অপরদিকে ইলিশ উন্নয়নে গত দুটি অর্থ বছরে দেশে কোন প্রকল্প চলমান না থাকায় বিপুল সম্ভবনাময় এ খাতের উন্নয়ন অনেকটাই থমকে গেছে। তবে মৎস অধিদফতরের মতে, ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে প্রায় হাজার কোটি টাকার একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা-ডিপিপি’ বর্তমানে পরিকল্পনার কমিশনের চ‚ড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। একই সাথে ইলিশ গবেষনায় একটি ভিন্ন প্রকল্প মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউট বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।
বর্তমানে দেশের ৪০টি জেলার ১৪৫টি উপজেলার দেড় হাজার ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৪লাখ জেলে পরিবার ইলিশ আহরণের সাথে জড়িত। যার ৩২% সার্বক্ষনিক ও ৬৮% খন্ডকালীন বলে জানাচ্ছে মৎস অধিদফতর। এছাড়াও ইলিশ বিপণন পরিবহন, প্রক্রিয়াজাত করন, রপ্তানী, জাল ও নৌকা তৈরি এবং মেরামত কাজেও আরো ২০-২৫লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগেরই প্রায় দেড় লাখ জেলে পরিবার এ পেশার সাথে জড়িত। যার ৬৫% সার্বক্ষনিকভাবে ইলিশ আহরণে জড়িত বলে মৎস অধিদফতরের এক জরিপে বলা হয়েছে। তবে জাটকা সংরক্ষণ সহ ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে গত দুটি অর্থ বছরে কোন প্রকল্প না থাকায় বেকার জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও পূনর্বাসন বন্ধ সহ খাদ্য সরবারহের বিষয়টি অনেকটাই নেতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। ফলে ইলিশ-এর সার্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবার আশঙ্কার কথা বলছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দায়িত্বশীল মহল। অথচ জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান ১%-এরও বেশী। মৎস সম্পদে একক প্রজাতি হিসেবে এ মাছের অবদান প্রায় ১২Ñ১৩%। এমনকি আমাদের মৎস বিজ্ঞানীদের মতে, সারাবিশ্বে আহরিত ইলিশের ৫০Ñ৬০% এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। মায়নমারে ২০Ñ২৫% এবং অবশিষ্ট ১০-১৫% ইলিশ ভারতে আহরিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে ইলিশের উৎপাদন হৃাস পেলেও বাংলাদেশে তা প্রতি বছর ৩-৪%পর্যন্ত বাড়ছে। মৎস বিজ্ঞানী ও মৎস অধিদফতরের মতে ২০০২সালের পর থেকে প্রতিবছরই দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। মৎস অধিদফতরের মতে ১৯৮৭-৮৮সালে দেশের অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক জলাশয় থেকে সর্বমোট ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১.৮৩লাখ টন। যা ১৯৯৪-৯৫সালে ২.১৩লাখ টন ও ২০০০-০১ সালে ২.২৯লাখ টনে দাড়ায়। কিন্তু ২০০২-০৩সালে দেশে ইলিশের উৎপাদন আবার ১.৯৯লাখ টনে হ্রাস পাবার পরই ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে জাটকা নিধন বন্ধের প্রাথমিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
২০০৪সাল থেকে প্রথম পর্যায়ে ৭কোটি টাকা ব্যায়ে “জাটকা আহরনকারী মৎসজীবীদের পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান বিষয়ক উন্নয়ন কর্মসূচি” বাস্তবায়ন শুরু হয়। ২০০৭-২০১০সাল পর্যন্ত এ কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ৬কোটি টাকা ব্যায়ে বেশ কিছু জেলেদের পুণর্বাসন করা হয়েছে। প্রায় ২৩কোটি টাকা ব্যায়ে ২০০৮-০৯ থেকে ২০১২-১৩ সময়ে “জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও গবেষণা প্রকল্প” নামেও অপর একটি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। প্রকল্পটি পরবর্তীতে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত স¤প্রসারিত হয়। পরবর্তী অর্থ বছরে এলক্ষে একটি কর্মসূচি চালু রাখা হলেও ২০১৬-এর জুলাই থেকে ইলিশ উন্নয়নে কোন প্রকল্প নেই। অনেক বিলম্ব করে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় হয়ে পরিকল্পনা কমিশনে গেলেও তা এখনো একনেক-এর অনুমোদন লাভ করেনি। তবে খুব শীঘ্রই প্রকল্পটি অনুমোদন সহ চলতি অর্থবছরেই তার বাস্তবায়ন শুরুর ব্যপারে আশাবাদী মৎস অধিদফতর।
আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে পরের ২২দিন দেশের উপক‚লীয় প্রায় ৭হাজার বর্গ কিলোমিটারের ইলিশ প্রজনন এলাকায় সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকার পাশাপাশি সারা দেশেই ইলিশ-এর আহরণ, পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রতি বছর ৩০নভেম্বর থেকে ৩০জুন পর্যন্ত সারাদেশে জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপন্ন নিষিদ্ধ রাখা হচ্ছে। যা আগে ৩০ নভেম্বর থেকে ৩০ মে পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এমনকি মৎস বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকেই জাটকার সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন এনে ৯ইঞ্চির পরিবর্তে এখন ১০ইঞ্চিতে উন্নীত করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম গ্রহণের ফলে গত এক যুগে দেশে ইলিশের উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩লাখ ৯৫হাজার টনে উন্নীত হয়। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ৪ লক্ষাধিক টনে উন্নীত হবার সম্ভবনার কথা জানিয়েছেন মৎস অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল। তবে গত অর্থ বছরের পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান পেতে আরো কিছুদিন সময় লাগতে পারে।
কিন্তু নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ৮মাস জাটকা আহরন নিষিদ্ধকালীন সময়ে বেকার জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সহ পুনর্বাসন কার্যক্রম বন্ধের পাশাপাশি জেলে পরিবারগুলোর খাদ্য সংস্থানে চাল সরবারহও এবার যথেষ্ঠ সংকুচিত করা হয়। অন্যান্য বছর ফেব্রæয়ারি থেকে মে পর্যন্ত উপক‚লের জেলেদের মাসে ৩০কেজি করে চাল সরবারহ করা হলেও গত অর্থ বছরে জাটকা আহরণের মেয়াদ ৩০জুন পর্যন্ত স¤প্রসারণের পরেও চাল সরবারহ শুরু হয় এপ্রিলের শেষে। তবে বরগুনা সহ কয়েকটি জেলায় এখনো জেলেরা চাল না পাবার অভিযোগ করেছেন। এমনকি মৎস অধিদফতর থেকে গত অর্থ বছরে দেশের ২৮টি জেলার ১১৫টি উপজেলার প্রায় সাড়ে ৫লাখ জেলে পরিবারের জন্য মাসে ৪০কেজি করে ৫লাখ টান চাল বরাদ্বের আবেদন পাঠান হলেও শেষ পর্যন্ত খাদ্য ও ত্রান মন্ত্রণালয় ১৭টি জেলার ৮৫টি উপজেলায় ২.৩৮লাখ জেলে পরিবারের জন্য চাল বরাদ্ধ করে বলে জানা গেছে।
মৎস অধিদফতরের মতে, জাটকা আহরন নিষিদ্ধের ফলে ইলিশের প্রকৃতিক প্রজনন সাফল্য যথেষ্ঠ আশাব্যঞ্জক। সমিক্ষার ফলাফলে ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪সালে যথাক্রমে ৩৮.৭২%, ১৭.৬২%, ৩৩.৬৯%, ৩৬.২৭%, ৩৫.৭৯% , ৪১.০২% ও ৩৮.৭৯% প্রজননোত্তর ইলিশ পাওয়া গেছে। যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় আশা ব্যঞ্জকভাবেই বেশী হলেও এ অভিযান আরো নিবিড় ও যোরদার করার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন মৎস বিজ্ঞানীগন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইলিশ

২০ নভেম্বর, ২০২২
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ