Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দারিদ্র্যপীড়িত বগুড়ার ৩ উপজেলায় ঈদ উদযাপন

| প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শহরে যখন শপিং হয় গ্রামে বসে শ্রমের হাট, কেউ ব্যস্ত বাঁশের খাঁচা তৈরীতে কেউ আবার চিকন সেমাই বা টুপি সেলাইয়ে দু’টাকা বাড়তি রোজগারের আশায়
মহসিন রাজু, বগুড়া ব্যুরো : শহরের আলো ঝলমল মার্কেটে যখন উচ্চবিত্ত¡, মধ্যবিত্ত¡ বা নি¤œবিত্ত¡ ঘরের ছেলে মেয়েরা শপিং এ ব্যস্ত,তখন বগুড়া জেলার নদী ভাঙ্গা এলাকা হিসেবে চিহ্ণিত বগুড়ার ৩ উপজেলা সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার মানুষেরা কিভাবে ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, কিভাবে ওই ৩ উপজেলার অসহায় দরিদ্র পরিবারের ছেলে, মেয়ে বা বউরা কি করছে ?
খবর নিতে গিয়ে দেখা গেছে, বগুড়া শহরের সর্বস্তরের মানুষ যখন ব্যস্ত ঈদের কেনা কাটা নিয়ে তখন গ্রাম এলাকায় দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র ভিন্ন ব্যস্ততা। যেমন নদী ভাঙ্গা এলাকা হিসেবে পূব বগুড়া অঞ্চলের বেশির ভাগ পরিবারের সক্ষম পুরুষ সদস্যরা, রিক্সা-ভ্যান চালিয়ে বাড়তি দুটো পয়সা রোজগারে কেউ গেছে বগুড়া শহরে, কেউ আবার আরো দুরের রাজধানী ঢাকা বা বিভাগীয় সিলেট নগরীতে। ওইসব শ্রমজীবী মানুষেরা বাড়তি কিছু রোজগারের টাকায় ঈদ সামগ্রী কিনে গ্রামে ফিরবে চাঁদ রাতের দিনে বা রাতে। একই ভাবে গার্মেন্টস সেক্টরে কর্মরত নারী- পুরুষ শ্রমিকরাও আসবে কেউ ঈদের একদিন আগে বা রাতে। তারপর জমবে তাদের ঈদ !
জানা গেছে, দরিদ্র পীড়িত ওই অঞ্চলের ৪০ শতাংশ দরিদ্র ও অর্ধশিক্ষিত শ্রেনীর মানুষই এখন ঢাকা, চট্রগ্রাম, খুলনা ও সিলেট অঞ্চলে গিয়ে শ্রমঘন পেশায় জড়িত থাকে। ঈদের আগের দিনে বা চাঁদরাতে তারা নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসে। তারা আসে একত্রে দল বেঁধে বাস- ট্রাক রিজার্ভ করে। আবার ঈদের ছুটি শেষ হলে ওই রিজার্ভ গাড়িতেই আবার তারা ফিরে যায় নিজ নিজ কর্মস্থলে। ঈদের ছুটি কাটাতে আসা এইসব মানুষেরা যেসব রিজার্ভ গাড়িতে গ্রামে আসে ওই সব রিজার্ভ গাড়ির চালক- হেলপার ও তাদের এ্যাসিসটেন্টদের এসময় জামাই আদরে রেখে দেয় নিজেদের এলাকায়। এটাও এখন এই অঞ্চলের একটি নতুন কালচারে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে গ্রামে বসবাসকারীরা ও বসে নেই। তারাও দু’পয়সা বাড়তি রোজগারের জন্য কেউবা বগুড়ার বিখ্যাত চিকন সাদা সেমাই, কেউ হাতে বানানো সেমাই, কেউ আকার সেমাই রাখার জন্য বাঁশের ঝুড়ি তৈরীতে ব্যস্ত রয়েছে। অর্থাৎ শহরবাসি যখন ঈদের শপিং এ ব্যস্ত গ্রামে গ্রামে বসেছে তখন শ্রমের হাট !
পূর্ব বগুড়ার সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি এলাকাটি এখন সেমাই রাখার বাঁশের খাঁচা ও চিকন সাদা সেমাই তৈরীর জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ঈদকে সামনে রেখে বগুড়ার ধুনট উপজেলায় গ্রামে গ্রামে টুপি তৈরীর ধুম পড়েছে। এক সময়ে যেসব গ্রামীণ নারীরা সংসারের কাজ কর্ম সেরে দিনের বেশীর ভাগ সময় ঘরে বসে থাকত। কিংবা পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে গল্প গুজবে সময় কাটাতো। এখন তারা টুপি তৈরীর কাজে এতোটাই ব্যস্ত যে করো সাথে কথা বলার সময় টুকুও নেই। তবে এই ব্যস্ততা ঈদের আগে আরো বেড়ে গেছে। টুপি তৈরীর কাজে শুধু গৃহবধুরাই ব্যস্ত নয়। স্কুল কলেজ পড়–য়া মেয়েরাও টুপি তৈরীর কাজে এখন ব্যস্ত সময় পার করছে। বগুড়ার ধুনট উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে টুপি তৈরী করার এসব দৃশ্য। ধুনটের গ্রামীণ নারীদের হাতে তৈরী করা টুপি দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রীর পাশাপাশি রপ্তানী হচ্ছে সৌদিআরব, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে। এ উপজেলার প্রায় ৮০ হাজার নারী টুপি তৈরীর কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। টুপি সেলাই করে ওরা পুরুষের পাশাপাশি বাড়তি আয় করে সংসারে সহযোগিতা করছে। এছাড়া স্কুল কলেজে পড়–য়া মেয়েরা টুপি তৈরী করে তাদের লেখাপড়ার খরচও যোগাচ্ছে। উপজেলার ২শ’২১ টি গ্রামের মধ্যে প্রায় সবগুলো গ্রামেই এখন টুপি তৈরীর কাজ চলছে।
উপজেলার চৌকিবাড়ী গ্রামের গৃহবধু মোমেনা খাতুন জানায়, ছেলের বাবার একলার কামাই দিয়া আগে আমাগোরে খুব কষ্টে দিন যাচ্ছিল। কিন্তু এখন আর আমাগোরে তেমন কোন কষ্ট করতে হচ্ছে না। মোমেনা খাতুন ৫/৬ বছর আগে থেকে টুপি তৈরীর কাজ শুরু করেছে। ঘর গৃহস্থ্যের কাজ শেষে দিনের যে টুকু সময় পায় সেই সময়েই দৈনিক ৩/৪ টা টুপি সেলাই করতে পারে। সে জানায় টুপি বিক্রী করতে কোন হাটে বাজারে যেতে হয়না। বাড়ি থেকেই পাইকাড়রা এসে প্রতি সপ্তাহে টুপি কিনে নিয়ে যায়। সব খরচ বাদে তার প্রতিমাসে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা বাড়তি আয় হয়।
শুধু মোমেনা খাতুনই নয় তার মতো ওই গ্রামের গৃহবধু লাকি, সনি, কুলসুম, রানু, পারুল সহ আরো অনেকেই টুপি সেলাই ও বিক্রী করে এখন স্বাবলম্বী হয়েছে।
গোপালনগর ইউনিয়নের মহিশুরা ইউএকে উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্রী সমাপ্তী খাতুন ও জেসমিন আকতার। তারা লেখাপড়ার পাশাপাশি মায়ের কাছে টুপি তৈরীর করার কাজ শিখে ৩য় শ্রেণী থেকে টুপি তৈরী করছে। তারা প্রতিমাসে টুপি বিক্রি করে ৪শ’ থেকে ৫’শত টাকা আয় করে। তাদের লেখাপড়ার খরচ বাবা মার কাছ থেকে আর নিতে হয় না।
টুপি সেলাই কাজে ব্যস্ত মহিলারা জানায়, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সময়ে টুপির চাহিদা বেশী হওয়ার কারনে ঈদের আগে থেকেই তারা টুপি সেলাইয়ের কাজে বেশী সময় ব্যায় করছে।
গ্রামের মহিলাদের টুপি সেলাইয়ের কাজে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয় সুতা ও ক্রুস কাটা। সুতা ও ক্রুস কাটা পাইকাড়রা সরবরাহ করে থাকে। পাইকাড়রা ২৫ টাকায় ক্রুস কাটা এবং ৫০ থেকে ১০০ টাকার সুতার ডলার সরবরাহ করে। কারো টাকা না থাকলেও বাকীতে ওই সব কাঁচামাল যোগান দেয় তারা। পরবতীতে টুপি ক্রয় করার সময় সময় ক্রুসকাটা ও ডলারের দাম কেটে রেখে বাকী টাকা দেয়।
চালাপাড়া গ্রামের পাইকাড়ী টুপি ব্যাবসায়ী বাচ্চু মিয়া জানান, প্রতি সপ্তাহে গ্রামে গ্রামে গিয়ে সুতা ও ক্রুসকাটা সরবরাহ করতে হয়। পরের সপ্তাহে সেলাই করা টুপি কিনে আনি। প্রতিটি টুপির দাম প্রকার ভেদে ২০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। তিনি আরো জানান, আগে শুধু এক ডিজাইনের টুপি তৈরী হতো। কিন্তু এখন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমানে পোষাকের যেমন বাহারী নাম করন হয়েছে। তেমনি টুপিরও বাহারী নাম ও ডিজাইন দেওয়া হয়েছে। যেমন নব্বইফুল, কলারফুল, বকুলফুল, তালাচাবি, স্টার, গুটি, বিস্কুট, আনারস, মৌচাক ও মাকড়াশার জাল। ডিজাইন ভেদে সবচেয়ে বেশী দাম নব্বই ফুল ও আনারস টুপির। নব্বইফুল টুপির দাম ৯০ থেকে ১০০শত টাকা, আনারস টুপি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, মৌচাক ২৮ থেকে ৩০ টাকা, মাকড়াশার জাল ২০ থেকে ২৫ টাকা, বিস্কুট ২৫ থেকে ৩০ টাকা। স্থানীয় এসব ব্যাবসায়ীরা গ্রামের মহিলাদের সেলাই করা টুপি কিনে নিয়ে ঢাকার চকবাজার, বাইতুল মোকারম মস্জিদ মার্কেট সহ রাজধানির বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রী করেন। সেখান থেকে গ্রামের মহিলাদের তৈরী করা টুপি রপ্তানী হয় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদ


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ