Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

আমদানী কর প্রত্যাহারে দক্ষিণাঞ্চলে কমছে চালের দাম

সরকারি মজুদ স্থিতিশীল হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে

প্রকাশের সময় : ২৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১০ এএম, ২৪ জুন, ২০১৭


নাছিম উল আলম : বিদেশী চাল আমাদানীতে শুল্ক হ্রাসের ঘোষনার সাথে দক্ষিনাঞ্চলসহ সারা দেশেই চালের দাম স্থিতিশীল হবার পাশাপাশি কোথাও কোথাও তা হ্রাস পেতেও শুরু করেছে। তবে শুল্ক হৃাসের সরকারী সিদ্ধান্তনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোন চাল খালাশ হয়নি বেনাপোল ও হিলিসহ দেশের প্রধান স্থল বন্দরগুলোতে। গত দিন পনের যাবতই এসব বন্দরে বিপুল সংখ্যক চাল বোঝাই ট্রাক দাড়িয়ে আছে খালাশের অপেক্ষায়। শুল্ক হৃাসের কাগজ বন্দর কাস্টমস দফ্তরে পৌছার সাথেই আমদানীকারকগন ট্রাকগুলো থেকে চাল খালাশের কাজ শুরু করবেন বলে জানা গেছে। সরকারীভাবেও আগামী দিন পনের মধ্যে ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানীর কথা বলা হয়েছে। বেসরকারী আমদানীকারকগন আমদানী শুল্ক হৃাসের বিষয়টি আগাম আঁচ করতে পেরেই বাংলাদেশের বন্দরে পৌছা চাল খালাশ করেনি গত দিন দশেক যাবত।  
চাল আমদানী ইতোপূর্বে করশূণ্য থাকলেও কৃষকদের ধানের ন্যায্যমূল্য প্রপ্তির স্বার্থে বছর দুয়েক আগে তার ওপর দশ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার ফলে বাজারে ধানের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কিছুদিন আগে চাল আমদানীতে কর ও শুল্ক হার ১০শতাংশ থেকে ২৮শতাংশে উন্নীত করার পরেই বাজারে এর বিরূপ প্রভাব পরে। আমদানীকারকরা চাল আমদানী হ্রাস করে। বাজারে দাম বেশী থাকায় সরকারী ক্রয় কার্যক্রমও ব্যার্থ হয়। পাশাপাশি সময়মত আমদানী করে ‘নিরাপদ মজুদ’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উদাশীনতার সুযোগে চালকল ও মজুদদাররা বড় ধরনের মজুদ গড়ে তুলে পুরো বাজারের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে। ফলে চালের বাজার গতবছরের একই সময়ের তুলনায় দেড়গুনেরও বেশী বৃদ্ধি পায়। দক্ষিনাঞ্চলের বাজারে মোটা চালের সর্ব নিম্ন দর গত সপ্তাহের শুরুতেও ছিল ৪৫টাকা কেজি। ‘বিআরÑ২৮’ নামে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর চাল বিক্রী হয়েছে ৪৭-৪৮টাকা দরে। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের পছন্দের মিনিকেট বিক্রী হয়েছে ৫৫-৫৬টাকা কেজী দরে। কিন্তু আমদানী কর হ্রাসের খবরে সব ধরনের  চালের দরই প্রকার ভেদে ৩Ñ৪টা পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে প্রতি কেজীতে।
অথচ সরকারী গুদামে না থাকলেও দেশের অভ্যন্তরীন বাজারে চালের খুব একটা সংকট নেই বলেই জানা গেছে। দক্ষিনাঞ্চল সহ সারা দেশেই সরকারী গুদামে চালের বড় ধরনের  ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। বরিশাল সিএসডি সহ দক্ষিনাঞ্চলের ৬টি জেলায় ৮৩হাজার টন ধারন ক্ষমতার গুদামগুলোতে চালের বর্তমান মজুদ মাত্র ১৬হাজার টনের মত। এসব গুদামে গম রয়েছে ২২হাজার টনের মত। বিগত রবি মওশুমে হাওর এলাকায় ব্যাপক ঢলের কারনে বোরো ধানের যথেষ্ঠ ক্ষতি হয়। পাশাপাশি বøাষ্ট নামক ছত্রাকবাহী রোগেও দেশের বেশ কিছু এলাকার বোরো ধানের ক্ষতি হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, এতে দেশে বোরো ধানের সার্বিক উৎপাদন ঘাটতি ছিল সর্বোচ্চ ৭লাখ টনের মত। বাজার বিশ্লেষকদের মতে এ ঘাটতি বাজারে চালের মূল্য পরিস্থিতি সহ সরবারহেও কোন সংকট সৃষ্টি করার কথা নয়।
বিগত রবি মওশুমে দেশে প্রায় ১কোটি ৯১লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ নিয়ে ৪৭.৯৭লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ সম্পন্ন করে কৃষকগন। ৪৮লাখ হেক্টরে আবাদ লক্ষ শতভাগ পুরন না হলেও উৎপাদন লক্ষ অর্জনে আশাবাদী ছিল কৃষি স¤প্রসারন অধিদফ্তর-ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল। কিন্তু হাওর এলাকায় ব্যাপক ক্ষতির পাশাপশি বøাষ্ট রোগের ক্ষয় ক্ষতির পরে বোরো থেকে ১কোটি ৮৪লাখ টনেরও বেশী চাল পাবার কথা বলছেন একাধীক দায়িত্বশীল মহল। বিগত ‘খরিপ-২’ মওশুমে দেশে ৫৫.৬০লাখ হেক্টরে আমন আবাদ লক্ষমাত্রার অতিরিক্ত কুড়ি হাজার হেক্টরে আবাদ সম্পন্ন হওয়ায় প্রায় ১কোটি ৭০লাখ টনের মত চাল উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল মহল। এতে করেও বর্তমান চলমান সংকট তৈরী হবার কথা নয়।
ওয়াকিবাহাল মহলের মতে, সরকারী ক্রয় ব্যার্থতার বিষয়টি মাথায় রেখে খাদ্য মন্ত্রনালয় সময়মত সরকারী মজুদ গড়ে তোলার কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারেনি। আর সরকারী গুদামে চালের সংকটের পাশাপাশি ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী-কাবিখা’র কার্যক্রমও প্রায় গুটিয়ে ফেলে চালের পরিবর্তে টাকায় ‘কাবিটা’ কার্যক্রম চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অথচ কাবিখা চালু থাকলে সে চাল বাজারেই আসত। ফলে বাজারে সরকারী চালের যোগান ঠিক থাকলে মূল্য ও সরবারহ পরিস্থিতি স্বভাবিক থাকত। কিন্তু সরকারী চাল সরবারহ হ্রাস পাওয়ায় চাল কল মালিক ও ব্যাবসায়ীরা বাজারের পুরো নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে দাম বাড়িয়ে ফেলে।
তবে কৃষি স¤প্রসারন অধিদফ্তরের একাধীক দায়িত্বশীল মহলের মতে, বিগত বোরো মওশুমে হাওর বিপর্যয় ও কিছু এলাকায় বøাষ্ট রোগের সংক্রমনে চাল উৎপাদনে সর্বোচ্চ ঘাটতি ৭লাখ টনের নিচে। সে হিসেবে বোরোর মোট উৎপাদন ১কোটি ৮৫লাখ টনের মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু মাত্র দু-আড়াই মাস আগে কৃষকের ঘরে ওঠা এত বিপুল পরিমান চাল কোথায়? সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ওয়াকিবাহাল মহলের মতে, সরকারী ক্রয় কার্যক্রমের ব্যর্থতার সুযোগে উৎপাদিত চাল চলে গেছে ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকদের কাছে। পাশাপাশি কৃষকদের সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধির ফলেও তারা ভাল দামের আশায় এখন আগের মত মাঠে থেকেই ফসল বিক্রী করছেন না। ফলে কৃষকের ঘরেও এখনো বেশ কিছু ধান ও চালের মজুদ রয়েছে। বিগত বোরো মওশুমের শুরুতে সারা দেশে ধানের গড়মূল্য ৭শ টাকার মধ্যে থাকলেও পরে তা ৯শ থেকে হাজার টাকায়ও উন্নীত হয়। বর্তমানে তা ১১শ টাকায়ও বিক্রী হচ্ছে। তবে চাল আমাদানী কর হ্রাসের ফলে বাজার নিয়ন্ত্রনে আসতে শুরু  করায় কৃষকরাও এখন তাদের মজুদ ছেড়ে দেবে। ফলে আগামী দিন পনেরর মধ্যে চালের বাজার আরো অনেকটাই নিয়ন্ত্রনে আসবে বলে আশা করছেন ওয়াকিবাহাল মহল।
পাশাপাশি চলতি ‘খরিপ-১’ মওশুমে দেশে প্রায় ১১লাখ হেক্টরে অন্তত ৩৫লাখটন আউশ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যা আগামী ৩ মাসের মধ্যে বাজারে আসবে। ইতোমধ্যে আউশ আবাদ লক্ষমাত্রা অতিক্রম করেছে। পরবর্তিতে আরো অতিরিক্ত ১লাখ হেক্টর আউশ আবাদ লক্ষ বৃদ্ধি করেছে কৃষি মন্ত্রনালয়। তাও অর্জিত হচ্ছে। এ কার্যক্রমের আওতায় বরিশাল সহ দক্ষিনাঞ্চলে দুই লক্ষাধীক হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। এধান থেকে প্রায় সাড়ে ৫লাখটন চাল আসবে কৃষকের ঘরে।  উপরন্তু দেশের দ্বিতীয় প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল আমন আবাদ কার্যক্রমও শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। দক্ষিনাঞ্চলে আমন বীজতলা তৈরীর কার্যক্রম শুরু হয়েচে।
এদিকে আসন্ন ‘খরিপ-২’মওশুমে দক্ষিনাঞ্চল সহ সারা দেশে ৫৩লাখ ৫হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ স্থির করেছে কৃষি মন্ত্রনালয়। যা থেকে প্রায় ১কোটি ৪০লাখ টন চাল উৎপাদনে আশাবাদী মন্ত্রনালয়। এর মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল অঞ্চলেই প্রায় সাড়ে ৭লাখ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হচ্ছে। প্রায় ১৫লাখ ৭৫হাজার টন চাল পাবার লক্ষে কাজ শুরুও করেছে দক্ষিনাঞ্চলের কৃষকগন।
বাজারে চালের কোন ঘাটতি নেই বলে স্বীকার করছেন চালকল ও ব্যাবসায়ীরাও। বর্তমানে বেসরকারী পর্যায়ে চালের যে আমদানী পত্র খোলা হয়েছে আগামী দিন পনের মধ্যে তার অনেকটাই বাজারে আসতে শুরু করবে। সরকারী পর্যায়ে চালের বর্তমান প্রায় শূণ্য মজুদ কাটিয়ে উঠতে পারলে পরিস্থিতি যথেষ্ঠ স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
গত কয়েক মাস ধরেই সারা দেশের মত দক্ষিনাঞ্চলেও চালের দর গত বছরের  প্রায় দেড়গুন বৃদ্ধির বিষয়টিকে কিছুটা মনুষ্য সৃষ্ট ও কিছুটা খাদ্য বিভাগের উদাশীনতা বলে মনে করছেন ওয়াকিবাহাল মহল।
সরকার বিদেশ থেকে খাদ্য সংগ্রহের যে বিলম্বিত পদক্ষেপ গ্রহন করেছে, সে চালও বরিশাল সিএসডি সহ দক্ষিনাঞ্চলের এলএসডি গুদামগুলোতে কবে নাগাদ পৌছবে তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাল

১১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ