চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
শাইখ বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসি
\ শেষ কিস্তি \
প্রচন্ড কামনা, অতিমাত্রায় লোভ, তীব্র প্রেম ও গভীর আসক্তি নিয়ে দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়। মজাদার ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে নিজেকে মগ্ন রাখে। পূর্ণ মমতার দ্বারা প্রতিপালনকারী মহান স্রষ্টাকে ভুলে থাকে। জীবনের পরিণতি আখেরাতের বিষয়ে চিন্তা করে না, চরিত্রহীনতার মাঝে নিমজ্জিত থাকে।
মাহে রমযানের রোযা অতি গাফিল ও দাম্ভিকদেরকে স্বীয় অপারগতা, দুর্বলতা দরিদ্রতাকে উপলব্ধি করায়। কেননা মানুষ অভুক্ত থাকার কারণে পাকস্থলিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে এবং ক্ষুধা নিবারণের জন্য রিযিকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তার দুর্বল দেহ যে কতটা ভঙ্গুর ও পচনশীল তা বুঝতে পারে। মায়া-মমতা ও অনুগ্রহের প্রতি যে কতটা মুখাপেক্ষী তাও বুঝতে পারে। তাই নফসের ফেরাউনসূলভ দাম্ভিকতা থেকে বিমুক্ত হয়ে নিজের পরম অসহায়ত্ব ও চরম দরিদ্রতার জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আর এভাবেই শুকরিয়া জ্ঞাপনের দ্বারা আল্লাহর রহমতের দ্বারে কড়া নাড়তে হাজির হয়- যদি গাফলত তার ক্বলবকে নষ্ট না করে থাকে।
ষষ্ঠ হিকমত
কুরআন-ই হাকীমের অবতীর্ণের সময়গুলোর মধ্যে রমযান মাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায়, নুযূলে কুরআনের দিক থেকেও রমযানের রোযার অসংখ্য হিকমত রয়েছে। এগুলো থেকে একটি হলো-
যেহেতু বরকতময় রমযান মাজে মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। তাই কুরআন নাযিলের এই মুবারক সময়ে ঐ ঐশী আহ্বানকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নেয়া উচিত। এজন্য রমযান মাজে জৈবিক চাহিদা থেকে বিমুক্ত হয়ে, তুচ্ছ ও অর্থহীন বিষয়গুলোকে পরিত্যাগ করে এবং পানাহার থেকে বিরত থেকে স্বীয় নফসকে ফেরেশতাতুল্য আধ্যাত্মিকতায় উন্নীত করা দরকার। আর কুরআনুল কারীমকে এমনভাবে তিলাওয়াত করা ও শ্রবণ করা উচিত যেন তা এখনই নাযিল হচ্ছে। এভাবে ঐ ঐশী আহ্বানকে সরাসরি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে অথবা হযরত জিবরাঈল আ. থেকে বা স্বয়ং অনন্ত অসীম মুতাকাল্লিম আল্লাহর
কাছ থেকে শ্রবণ করার মত আধ্যাত্মিক উন্নতির চেষ্টা করা প্রয়োজন। একই সাথে অনুবাদক ও প্রচারক হিসেবে ঐ ঐশী বাণীকে সকলের কাছে পৌঁছানো দরকার। আর এভাবেই মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিলের হিকমতকে উপলব্ধি করা সম্ভব।
মাহে রমযানে মুসলিম বিশ^ এক বৃহৎ মসজিদে পরিণত হয়। এমন এক মসজিদ যার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোটি কোটি হাফিজ ঐ ইলাহী বাণী আল কুরআন, দুনিয়াবাসীদেরকে তিলাওয়ার করে শোনায়। আর এভাবেই প্রত্যেক রমযানে (রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন) এই আয়াতটিকে নূরানী ও উজ্জ্বলভাবে উপস্থাপন করে।
এভাবে তারা রমযানকে কুরআনের মাস হিসেবে প্রমাণ করে। ঐ বৃহৎ জামাতের অন্য সদস্যদের থেকে অনেকে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে ঐ হাফিজদের তিলাওয়াত শুনতে থাকে বাকিরা নিজেরাই তিলাওয়াত করে।
এমতাবস্থায় কেউ ভোগবাদী নফসের তাড়নায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পানাহারের মাধ্যমে এরকম পবিত্র কোন মসজিদের নূরানী পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে তা হবে খুবই ন্যাক্কারজনক একটি কাজ। যা তাকে মসজিদে অবস্থিত ঐ জামাতের প্রত্যেকের ঘৃণার পাত্রে পরিণত করে। যারা পবিত্র রযমান মাসে রোযা না রেখে রোযাদারকে অসম্মান করে তারাও ঠিক একইভাবে সমগ্র মুসলিমজাহানের ঘৃণা ও লাঞ্ছনার পাত্রে পরিণত হয়।
সপ্তম হিকমত
পরকালকেন্দ্রিক চাষাবাদ ও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মানুষ এ পৃথিবীতে এসেছে। মাহে রমযানের পবিত্র রোযার মাঝে এ বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত বহু হিকমত খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এখানে একটির আলোচনা করা হল-
বরকতময় রমযান মাসে প্রত্যেক ইবাদতের সওয়াব হাজার গুণ বৃদ্ধি পায়। হাদীস অনুযায়ী পবিত্র কুরআনের প্রতিটি হরফের জন্য দশটি পুণ্য বা সওয়াব রয়েছে যা জান্নাতে ফল হিসেবে প্রকাশ পায়। মাজে রমযানে প্রতিটি হরফের জন্য দশটির পরিবর্তে হাজারটি সওয়াব দেয়া হয়। আয়াতুল কুরসীর মত মহিমান্বিত আয়াতগুলো ক্ষেত্রে প্রতিটি হাজারেরও অধিক সওয়াব দেয়া হয়। আর এই মাসের জুমার দিনে এই সওয়াবের পরিমাণ আর বৃদ্ধি পায় এবং লাইলাতুল কদরে তা ত্রিশহাজারেরও অধিক হয়।
এভাবেই প্রতিটি হরফের বিনিময়ে ত্রিশ হাজার স্থায়ী ফল প্রদানকারী কুরআনে হাকীম, মাহে রমযানে জান্নাতের এমন এক নূরানী ত‚বা বৃক্ষে পরিণত হয় যা মুমিনদেরকে কোটি কোটি বেহেশতী ফল অর্জনে সহায়তা করে।
অতএব এসো! এই পবিত্র, চিরস্থায়ী ও লাভজনক ব্যবসার দিকে তাকাও, লক্ষ্য কর এবং চিন্তা কর; আর যারা এই হরফগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করল না তারা কতটা ক্ষতিতে নিমজ্জিত তা উপলব্ধি কর।
এই মাহে রমযান হলো পরকালীন ব্যবসার জন্য অতি লাভজনক এক প্রদর্শনীস্থল ও বাজার। আখেরাতের জন্য খুবই উর্বর এক শস্যক্ষেত্র। আমলের বৃদ্ধির জন্য রহমতের এক বারিধারা। মহান আল্লাহর রুবুবিয়াতের আধিপত্যের সামনে বান্দার ইবাদতকে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপনের জাঁকজমকপূর্ণ ও পবিত্র এক রাজকীয় উৎসব। আর এ কারণেই পানাহারের মাধ্যমে গাফললে নিমজ্জিত হয়ে জৈবিক চাহিদা পূরণ, ফায়দাহীন কাজ ও প্রবৃত্তির আনুগত্য সাময়িকভাবে জৈবিকতা থেকে মুক্ত হয়ে ফেরেশতার পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে, আখেরাতের ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে কিছু সময়ের জন্য দুনিয়াবী চাহিদাকে পরিত্যাগ করে পরলৌকিক ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারে, জাগতিক দেহ এক রূহানী অবস্থায় প্রবেশ করতে পারে এবং রোযার মাধ্যমে আল্লাহর সামাদিয়াত নামের আংশিক প্রতিফলন তার মাঝে প্রকাশ পেতে পারে।
রমযান মুবারক এই নশ^র দুনিয়ার সংক্ষিপ্ত ও ক্ষণস্থায়ী হায়াতকে অনন্ত এক চিরস্থায়ী হায়াতে পরিণত করে। রমযানের এক মাসেই আশি বছরের ইবাদতের সওয়াব অর্জন করা সম্ভব। পবিত্র কুরআনের সুনিশ্চিত সংবাদ অনুযায়ী লাইলাতুল কদরের হাজার মাসের চেয়েও উত্তম হওয়া, এই গভীর অর্থের এক অকাট্য দলীল।
উদাহরণস্বরূপ, কোন এক বাদশাহ তার ক্ষমতায় আরোহণ উপলক্ষে কিংবা রাজ্যের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে জাঁকজমকপূর্ণ ও রাজকীয় উৎসবের আয়োজন করে। ঐ দিবসগুলোতে বাদশাহ তা অনুগত ও বিশ^স্ত প্রজাদেরকে সাধারণ নিয়মের বাইরে বিশেষ সাক্ষাৎ, আপ্যায়ন ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করে। ঠিক একইভাবে আঠারো হাজার জগতের ¯্রষ্টা ও পরাক্রমশালী বাদশাহ ঐ মাখলুকাতের জন্য রাজকীয় এক ফরমান হিসেবে কুরআন মজীদকে এই পবিত্র রমযান মাসে অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং বিশেষ এক এলাহী উৎসব, রাব্বানী প্রদর্শনী ও ভাবগাম্ভীর্যময় এক রূহানী মজলিস হিসেবে এই রমযান মাসকে নির্বাচন করা খুবই যুক্তিসঙ্গত।
যেহেতু রমযানই হচ্ছে আনন্দমুখর ঐ উৎসব, সেহেতু নফসের খায়েশ ও জৈবিক তাড়না থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্যই সিয়াম সাধনার আদেশ দেয়া হয়েছে। আর এই সিয়ামের পূর্ণতা প্রাপ্তির উপায় হল, পেটের মত চোখ, কান, কালব, কল্পনা ও চিন্তাসহ প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও অনুভ‚তির রোযা রাখা। অর্থাৎ হারাম ও অর্থহীন কাজ থেকে বিরত রেখে ঐসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও অনুভ‚তিকে তাদের জন্য নির্ধারিত ইবাদতে ব্যস্ত রাখা।
উদাহরণস্বরূপ, জিহŸার রোযা হলো, মিথ্যা, গীবত ও অশ্লীল কথাবার্তা থেকে বিরত
রাখা। একই সাথে কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর যিকির, তাসবীহ ও দুরুদ এবং ইসতিগফারের মাধ্যমে জিহŸাকে সদা ব্যস্ত রাখা। আর চোখের রোযা হল, হারাম থেকে বিরত রেখে শিক্ষণীয় বিষয়গুলোতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। কানের রোযা হল- অশ্লীল কিছু শ্রবণ থেকে বিরত রেখে কুরআন ও সত্যকে শ্রবণ করানো। একইভাবে অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এবং অনুভ‚তিগুলোরও রোযা রাখা দরকার।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।