Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১১ জুন ২০২৪, ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বুয়েট থেকে পাস করে আত্মঘাতী জঙ্গি

ধর্মীয় অপব্যাখ্যায় বিপথগামী হচ্ছে মেধাবীরা : আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী

| প্রকাশের সময় : ২১ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


স্টাফ রিপোর্টার : ধর্মীয় অপব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িত হচ্ছে দেশের অনেক মেধাবীরা। নম্র-ভদ্র এবং এলাকার সকলের প্রিয় অত্যন্ত মেধাবী তরুণদের বিপথগামী হওয়ার খবরে শুধু তাদের পরিবারে নয় পুরো এলাকার মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। দেশের নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েট থেকে পাস করে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে আত্মঘাতী হওয়ার কারণে হতবাক হয়ে পড়ছেন পরিবারের সদস্যরা। শুধু প্রকৌশলী নয় ডাক্তারী পাস করার পড়েও কেউ কেউ বিপথগামী হচ্ছেন। এ তথ্য জানিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। র‌্যাব বলেছে, বুয়েট থেকে পাস করা অলি ও আনোয়ার জঙ্গিদের বোমা বিশেষাজ্ঞ।
র‌্যাবের আইন ও গণ মাধ্যম শাখার প্ররিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, জঙ্গিরা মেধাবী তরুণদের দলে ভিড়াতে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালায়। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে, কোরআন সুন্নাহর বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে জঙ্গিরা বিভিন্ন পেশার মানুষকে দলে টানে।
তিনি বলেন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, আইনজীবী বিভিন্ন পেশার মেধাবীরা জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত হচ্ছে। এটা হলো মতার্দশের বিষয়। জঙ্গিরা মেধাবীদের টার্গেট করে দলে নেয়ার চেষ্টা করে, কারণ উচ্চ শিক্ষিতদের দলে নিতে পারলে তাদের জন্য প্রচারণা চালানো ও দলের ভাবমর্যাদা বাড়ানো সুবিধাজনক। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন মুসলমানরা নির্যাতিত হয়, হামলার শিকার হয় তখন জঙ্গিরা মেধাবী তরুণদের কাছে এসব মানবিক বিষয় উপস্থান করে সহজেই মেধাবীদের প্রভাবিত করতে পারে। এসব কারণেই এখন উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী শিক্ষার্থী এবং ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের দলে টানতে পারছে। এদের রক্ষা করতে প্রয়োজন পরিবারের সচেতনতা এবং যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষালাভ করা।
র‌্যাব জানায়, গত ২০ মার্চ বুয়েট থেকে পাস করা দুই প্রকৌশলী অলিউজ্জামান ওরফে অলি ও আনোয়ারুল আলমসহ ৫ জনকে রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত অলি একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করতো। ২০১২ সালে সে বুয়েট থেকে ইলেক্টিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নেয়। আর আনোয়ার পড়াশোনা করেছে বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। গ্রেফতারের পর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে রাজধানীর উপকণ্ঠ দোহার ও মিরপুর থেকে আরও দশজনকে গ্রেফতার কর হয়।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছে, দেশের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারীরা জঙ্গি সংগঠনের বোমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নাম লেখাচ্ছে বলে। তারা বলছেন, এই উচ্চশিক্ষিত জঙ্গিদের হাত ধরেই অল্পশিক্ষিত জঙ্গিরা বোমাবিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, জিহাদের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিরা এসব যুবককে তাদের দলে ভিড়িয়েছে।
র‌্যাব ও পুলিশের তথ্যানুযায়ী, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এসব যুবকের মধ্যে অধিকাংশকেই গ্রেফতার করা গেছে নাশকতার অনেক আগেই। আর এর মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে।
গত ২৬ এপ্রিল র‌্যাব-১০-এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে মুশফিকুর রহমান ওরফে মুশফিক মার্টিন ওরফে জেনি (৩০) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে। র‌্যাব জানিয়েছে, জেনি আইইডির (ই¤েপ্রাভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। র‌্যাব জানায়, তার কাছে বিপুল পরিমাণ দূর নিয়ন্ত্রিত আইইডি এবং বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। জেনি ২০০৫ সালে বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে ভর্তি হলেও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে আর ডিগ্রি শেষ করতে পারেনি। তবে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তার ছাত্রত্ব ছিল। এদিকে, গত ২৮ এপ্রিল রাতে সাভারের রাজপুলবাড়িয়া এলাকার একটি বাস থেকে নব্য জেএমবির তিনজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতারকৃতরা হলো, ইসলাম ধর্মান্তরিত তামিম দ্বারী ওরফে আব্দুল্লাহ আল হাসান ওরফে আজিজুর রহমান ওরফে আব্দুল্লাহ আল জাফরি ওরফে আমীর হামযা ওরফে আল হুযাইফা ওরফে শ্রী গৌরাঙ্গ কুমার মÐল, কামরুল হাসান ওরফে কাজল ওরফে নূরউদ্দিন ও মোস্তফা মজুমদার ওরফে শিহাব ওরফে হামজা। এরা নব্য জেএমবি’র নিহত সারোয়ার -তামিম গ্রæপের সদস্য।
র‌্যাব জানায়, তামিম দ্বারী জেএমবির অন্যতম নেতা তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা ছিল। সে ধর্মান্তরিত মুসলিম ২০০৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। ২০০৫ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তামিম দ্বারী। এরপর মেরিন একাডেমি থেকে পাস করে ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ‘বাংলার কাকলী’সহ বিভিন্ন জাহাজে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করে। সমুদ্রপথে বিস্ফোরকে এনে নাশকতা পরিচালনার পরিকল্পনা ছিল তাদের। র‌্যাবের তথ্যানুযায়ী বুয়েট শিক্ষার্থী জেনি বোমা বিশেষজ্ঞ।
র‌্যাব ও পুলিশ জানায়, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ৮৬ সদস্যকে ফ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ৬ জন। এছাড়া জেএমবি সদস্য ৬৪ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৪ জন, হুজির ১৪ জন, হিযবুত তাহরীর ৩ জন, শহীদ হামজা বিগ্রেডের ১ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
র‌্যাব-১০-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী বলেন, ‘জঙ্গিরা প্রথমে টার্গেট করে বন্ধুত্ব করে। আমরা যে বুয়েট শিক্ষার্থী জেনিকে গ্রেফতার করেছি, তার সঙ্গে প্রথমে সালমান, অলি নামে কয়েকজন জঙ্গির বন্ধুত্ব হয়। এরপর জেনি আইইডি তৈরিতে পারদর্শী ছিল। বন্ধুত্ব করে জেনিকে অলি কনভিন্স করে। জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করে। জেনিকে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে তারা ডিভাইস তৈরির কৌশল এঁকে নিয়ে যায়। আমরা ওই নকশায় জেনির হাতের লেখা পেয়েছি। এভাবে অন্য জঙ্গিরাও বোমা তৈরি শিখছে।
এরআগে, ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি বøগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর জঙ্গি হামলার পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জঙ্গিবিরোধী ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মিডিয়া শাখার প্রধান মোরশেদ আলমকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মোরশেদ ২০১১ সালে ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সাইন্সে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার হয়। ওই বছরের ১১ নভেম্বর মিডিয়া শাখার অন্য সদস্য সিভিলি ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ ওয়াদুদ জুম্মান ওরফে সাফুলকে। এরা সবাই বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ছিল।
র‌্যাব ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গিদের একজন কোনও কিছুতে পারদর্শী হলে তারা সেই কর্যক্রম অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয়, যেন অন্য জঙ্গিরাও বোমা, গ্রেনেড তৈরি করে নাশকতা করতে পারে। গত ফেব্রæয়ারির শেষ দিকে বোমা বিশেষজ্ঞ বড় মিজানকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। পুলিশকে সে জানায়, বোমা বিশেষজ্ঞ সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজানসহ কয়েকজন আইইডি তৈরিতে পারদর্শী। তারা বেশ কয়েকজনকে এই প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, ‘জঙ্গি কার্যক্রমে ব্যবহৃত বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির কৌশল ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেয়া আছে। সেখান থেকে তারা শিখছে। এছাড়া যারা মেধাবি, তাদের টার্গেট করে দলে বেড়ানোর চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ