হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
রাজনীতি মানুষের সেবার জন্য। যিনি রাজনীতি করেন, ধরে নেয়া হয় তিনি মানুষের সেবার জন্যই নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে থাকবেন, তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করবেন। প্রয়োজনে জেল খাটবেন, এমনকি জীবনও বিসর্জন দেবেন। একজন খাঁটি রাজনীতিবিদের নিজের বলে কিছু থাকে না। নিজের ঘরে অভাব অনটন রেখেও অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। একজন আদর্শ রাজনীতিবিদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের পক্ষ হয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া। ঊনিশ শতকের প্রায় পুরোটা এবং বিংশ শতকের অধিকাংশ সময় জুড়ে এ ধরনের আদর্শিক রাজনীতির প্রচলন ছিল বেশি। তখন নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘চল চল চল’ কিংবা ভুপেন হাজারিকার ‘মানুষ মানুষের জন্য’ বিখ্যাত সঙ্গীতে রাজনীতিবিদরা উদ্ভুদ্ধ হতেন। এ ধরনের রাজনীতি এখন দেখা যায় না। বলা যায়, বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে মুখে মুখে এখনও শোনা যায়, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমরা রাজনীতি করি। এটা যতটা না রাজনৈতিক ততটাই বাস্তবের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আসলে এ জামানার রাজনীতিতে কাউকেই দুঃখী মানুষের পক্ষে রাজনীতি করতে দেখা যায় না। দুঃখী মানুষরা হয়ে উঠেছে, তাদের রাজনীতির বিষয়বস্তু। এরা না থাকলে তাদের রাজনীতিও থাকে না। কাজেই যত বেশি দুঃখী মানুষ, তত বেশি রাজনৈতিক সুবিধা। দুঃখী মানুষ যদি নাই থাকে, তবে রাজনীতি হবে কী দিয়ে? কাজেই রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে হলে দুঃখী মানুষও টিকিয়ে রাখতে হবে। বস্তি ও উদ্বাস্তু মানুষের মিছিল দেখাতে হবে। এ ধরনের চানক্য রাজনীতি যেমন রয়েছে, তেমনি আধুনিক পুুঁজিবাদী রাজনীতিও রয়েছে। এখন রাজনীতির ধারাটাই বদলে গেছে। রাজনীতিতে অর্থনীতি প্রধান হয়ে উঠেছে। উন্নত বিশ্ব এবং যারা উন্নতি করতে চায় তারা রাজনীতিকে অর্থনীতি কেন্দ্রিক হিসেবেই নিয়েছে। আমরা যদি আমেরিকা ও ইউরোপের রাজনীতির দিকে তাকাই, তাহলে দেখব তাদের পুরো রাজনীতিই হচ্ছে অর্থনৈতিক কেন্দ্রিক। সেখানে নির্বাচন কীভাবে হবে, বিরোধী দল রাজনীতি করতে পারছে কিনা বা করতে দেয়া হচ্ছে কিনা, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দৌড়ের উপর রাখা হচ্ছে কিনাÑএসব বিষয় নেই। এর পরিবর্তে রয়েছে, মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির নানা ফিরিস্তি। তারা শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে না। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর উন্নয়নের দিকেও হাত বাড়ায়। বিশ্ব রাজনীতিতেও তারা জড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ আগে নিজের ঘর ঠিক রেখে, পরে অন্যের ব্যাপারে নাক গলায়। আমাদের দেশের রাজনীতিতেও পরিবর্তন হয়েছে। এখানেও অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে রাজনীতির সূচনা হয়েছে। যাকে বামপন্থীরা পুুঁজিবাদী ও বুর্জোয়া রাজনীতি বলে আখ্যায়িত করেন। অবশ্য তাদের এ আখ্যায় কিছু যায় আসে না। পুরো বিশ্বই এখন বুর্জোয়া রাজনীতির ধারায় আবর্তিত হচ্ছে। আমাদের এখানেও এ ধারাই চলছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে, বুর্জোয়া বা অর্থনৈতিক কেন্দ্রিক রাজনীতি করতে গিয়ে অধিকাংশ রাজনীতিবিদ ও তাদের নেতা-কর্মীরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, নিজেদের উন্নতিটাকেই সবার আগে প্রাধান্য দিচ্ছে। আমাদের রাজনীতির দিকে যদি তাকানো যায়, তবে দেখা যাবে যারা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী তাদের চেহারা-সুরত ও চলন-বলনের ধারাটাই একেবারে বদলে গেছে। ঢাকা শহরে যে দীনহীন হয়ে একসময় চলাফেরা করত, ক্ষমতার দাপটে স্বল্প সময়েই গাড়ি-ফ্ল্যাট, ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক হয়ে গেছে। বিরোধী দলে যারা আছে তারাও একসময় অর্থনৈতিক রাজনীতি করতে গিয়ে এরকমই হয়েছিল। তারা এখন ক্ষমতায় নেই বলে তাদের চকচকে ভাব দেখা যায় না। অর্থাৎ এখন রাজনীতি হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক কেন্দ্রিক এবং এ অর্থনীতি কেবল ক্ষমতাসীনদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। সেখানে সাধারণ মানুষের সুবিধা নেই বললেই চলে। বরং সাধারণ মানুষের অর্থ লোপাটের মাধ্যমেই ক্ষমতাসীনদের অনেকের রাজনীতি চলছে। বিগত এক দশকের রাজনীতির বিবেচনা করলে দেখা যাবে, ক্ষমতার কাছাকাছি একদল লোক বেসুমার অর্থকড়ির মালিক হয়েছে। তাদের অর্থের সীমা-পরিসীমা নেই। বলা বাহুল্য, এসব অর্থ হয়েছে ক্ষমতার জোরে। ব্যাংক লোপাট, বড় বড় প্রকল্পের দুর্নীতি, কমিশন ব্যবসা, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে হেন কোনো উৎস নেই যেখানে থেকে অর্থ কেড়ে নেয়া হয়নি। এই কিছু লোকের বড় লোক করতে গিয়ে অনেক সাধারণ লোক নিঃস্ব হয়েছে, জীবনে টানাপড়েনে পড়েছে, সরকারও নব্য এই ধনীক শ্রেণীকে দেখিয়ে বলছে, মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি অনেক হয়েছে। মাথাপিছু আয়ের অংকটিও বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক যতটা না এগিয়েছে তার চেয়ে বেশি দেখিয়ে দিচ্ছে। এক জিডিপির হিসাব নিয়ে কী হুলুস্থুল ঘটনা। আগামী অর্থ বছরে জিডিপি ৭.৪ হবে বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ বিশ্ব ব্যাংক স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে জিডিপি ৬.৮ শতাংশের বেশি হবে না। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকারের মধ্যে সবকিছুতেই বাড়িয়ে বলে ক্রেডিট নেয়ার এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে।
দুই.
গত এক দশকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। একজন দিনমজুরের কথা যদি বিবেচনা করা হয়, তবে তার মজুরি তিন থেকে সাড়ে তিনশ’ টাকা হয়েছে। একজন মুচিও দৈনিক তিন-চারশ’ টাকা আয় করে। রিকশাওয়ালা আয় করে তার চেয়ে একটু বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে, এ আয় দিয়ে কি তার জীবন চলে? আগের চেয়ে সে কি ভাল আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, আগের চেয়ে এখন তিন গুণ আয় করছে ঠিকই, সেই সাথে ব্যয়ও বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। আয়ের সাথে সাথে সবকিছুর দামও বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম এতটাই বেশি যে আয়কৃত অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয়তা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমন হতো আয় বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম এ তুলনায় বাড়েনি, তবে বলা যেত উন্নতি হয়েছে। আয় দিয়ে ব্যয় মিটিয়ে সঞ্চয় করাসহ অন্যান্য সাধ-আহলাদও মেটানো গেলে বলা যেত মানুষ স্বাচ্ছন্দে আছে। আমাদের দেশের মানুষের কি এখন এ অবস্থা আছে? অথচ সাধারণ মানুষকে এ অবস্থার মধ্যে রাখা যেত, যদি ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি সামাল দেয়া যেত। কতটা দুর্নীতি হলে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে এক সভায় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ক্ষমতা হারালে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। যে সম্পদ আহরণ করা হয়েছে, তা দেশে কাজে লাগাতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের যেসব নেতা-কর্মী আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন, ক্ষমতা হারালে তারা হয়তো কেউ দেশ ছেড়ে পালাবেন, কেউ হয়ত দেশেই থেকে যাবেন, তবে ক্ষমতায় থাকতে থাকতেই যারা বিদেশে অর্থ পাচার করে দিচ্ছে, তাদের ধরবে কে? বলা হচ্ছে, এক বছরেই ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। প্রতি বছরই হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। সব অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে, পাচারকারিরা সেখানেই বসবাসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করছে। অর্থাৎ আমার দেশের মানুষের অর্থ লোপাট করে নিচ্ছে অতীব ক্ষমতাশালী কিছু লোক। তারা এই অর্থ পাচার করতে পারছে নিশ্চয়ই ক্ষমতার কাছাকাছি লোকদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় এবং প্রশাসনের উদাসীনতায়। তা নাহলে এত পাচার হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এত অর্থ যদি বিদেশে পাচার হয়ে যায়, তবে দেশের উন্নতি হচ্ছে, এটা কীভাবে বলা হয়। শুধু বড় বড় অনুৎপাদনশীল ফ্লাইওভার, ব্রিজ-কালভার্ট করে দেখালেই কী উন্নতির করছি বলে ধরে নেয়া যায়! দেশের সার্বিক অর্থনীতি বিবেচনায় এগুলোকে যদি বলা হয়, ‘গরীবের ঘোড়া রোগ’ তবে খুব বেশি বলা হবে না। এমন হতো দেশের মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে, তাহলে এসব উন্নয়নের যৌক্তিকতা থাকে। সরকারের তরফ থেকে প্রায়ই বলা হয়, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। হ্যাঁ, বেড়েছে, তবে তা কিছু লোকেরÑযাদের সম্পদের কোনো হিসাব নেই। চালের কেজি যদি ১০০ টাকাও হয়ে যায়, তাতেও তাদের কিছু যায় আসে না। এসবের খোঁজই তারা নেবে না। এমনকি চাল, ডাল, তেল, নুনের কেজি কত তাও তারা বলতে পারবে না। এ শ্রেণীর লোকজনের ক্রয়ক্ষমতাকে যদি স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়, তবে তা মাথাপিছু গড় আয়ের মতোই শুভংকরের ফাঁকি হয়ে থাকবে। মাথাপিছু আয়কে যেভাবে হিসাব করা হয়, তা যে একটা ফাঁকা বুলি তাতে সন্দেহ নেই। সরকারি হিসেবেই দেশে নাকি ২৬ লাখ বেকার। এখন প্রশ্ন যদি করা হয়, এই ২৬ লাখের আয়ও কি গড়ে ১৬০২ ডলার? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। কাজেই মাথাপিছু আয়ের হিসাবটি বাস্তবতার মধ্যে পড়ে না। তেমনি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এ হিসাবটিও মাথাপিছু গড় আয়ের মতোই। সরকারি হিসাব বাদ দিলে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি সংস্থার হিসাবে দেশে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ বেকার। তাহলে এই কোটি কোটি বেকারের কি ক্রয়ক্ষমতা আছে? যার আয়ই নেই, তার ব্যয় করার কী ক্ষমতা থাকে? কাজেই সরকার যে কথায় কথায় বলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, তা পুরোপুরি সঠিক নয়। একটা কথা বুঝতে হবে, বাঁচতে হলে কিনতে হবে। এটা চিরন্তন। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ তার মৌলিক চাহিদানুযায়ী ক্রয় করতে পারছে কিনা? এ প্রশ্নের উত্তর যদি সাধারণ মানুষের কাছে করা হয়, তবে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ যে বলবে তারা মৌলিক চাহিদা অনুযায়ী ক্রয় করতে পারছি না, তাতে সন্দেহ নেই। এ একটি প্রশ্ন নিয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে গেলেই বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্র পাওয়া যাবে।
তিন.
একটি সরকার যখন যেনতেনভাবে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকে, তখন তার লক্ষ্যই হয়ে উঠে অসত্য ও অর্ধসত্যকে ধারণ করে টিকে থাকা। মানুষের উন্নতি করছি, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়নের মহাসড়কেÑএসব মুখরোচক শ্লোগান তার হাতিয়ার হয়ে উঠে। নিজের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা আড়াল করতে এসব শ্লোগান সর্বস্ব বিলবোর্ড সামনে নিয়ে আসা হয়। এসবের আড়ালে প্রকৃত সত্য ঢাকা পড়ে থাকে। কেউ এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেই, বাক্য এবং অস্ত্রের দ্বারা আক্রমণ করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে যদি পর্যাপ্ত সক্ষমতার অধিকারী নয় এমন সরকার অধিষ্ঠিত থাকে, তখন অর্থনীতি ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকে। এই মরা অর্থনীতির সামনে উন্নয়নের যতই বিলবোর্ড তুলে ধরা হোক না কেন, কোনো না কোনোভাবে অর্থনীতির করুণ চিত্র বের হয়ে আসবেই। আমাদের দেশের অর্থনীতির করুণ চিত্র দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। সরকার যেভাবে উন্নতির প্রচার করছে, সেভাবে যদি উন্নতি হতো, তবে দেশ সিঙ্গাপুরের কাছাকাছি চলে যেত। অর্থাৎ চলার গতি কম, আওয়াজ বেশি। আমরা যদি বিনিয়োগের দিকে তাকাই তবে দেখব, সেখানে বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরে খরা চলছে। দেশের উন্নতির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিনিয়োগ। বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান হয়, উৎপাদন বাড়ে, উৎপাদন বাড়লে রপ্তানি হয়Ñএভাবে চেইন রিঅ্যাকশনের মতো অর্থনীতি এগুতে থাকে এবং পরিধি বৃদ্ধি পায়। এটাতো এক বিস্ময়কর ব্যাপার যে, বিনিয়োগ নেই, উন্নতি হচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব? আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে, বিনিয়োগ বলতে যে কিছু নেই, এ নিয়ে সরকারের তেমন মাথাব্যথা নেই। কেন বিনিয়োগ হচ্ছে না, কি সমস্যা, এসব নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় না। অর্থনীতির অন্তর্নিহিত এই সমস্যা বজায় রেখে বা অর্থনীতির আত্মা শূন্য রেখে উন্নতির কথা কেমন করে বলা হয়, তা সচেতন মানুষের বোধে আসার কথা নয়। সরকারের উন্নয়নের বিলবোর্ডের ভাষায় দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে চলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে মানুষটি ঋণে জর্জিরিত, সে উন্নতি করে কী করে। যাকে প্রতি নিয়ত ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চলতে হয়, সে উন্নতি করেছে, এ কথা কি বলা যায়? সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই মুহূর্তে যে শিশুটির জন্ম হলো তার মাথার উপর ৪০ হাজার টাকা ঋণ ধার্য হয়ে রয়েছে। অর্থাৎ দেশে এখন মাথাপিছু ঋনের পরিমাণ ৪০ হাজার টাকা। এটা কী ভাবা যায়, যে ব্যক্তি ৪০ হাজার টাকা বা এক টাকাও আয় করতে পারে না, তার ঋনের পরিমাণ ৪০ হাজার টাকা এবং এ ঋণ তাকে শোধ করতে হবে! প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থমন্ত্রী নতুন যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, তাতে মাথাপিছু ঋণ বেড়ে হবে ৪৬ হাজার ১৭৭ টাকা। অর্থাৎ যে বাজেট দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে ঋণ নিতে হবে এবং জনগণের উপর এই ঋণের বোঝা চাপাতে হবে। একে ‘ঋণ নিয়ে ঘি খাওয়া’র ব্যবস্থা বলা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! পরিস্থিতি যদি এই হয়, তাহলে আমরা কোথায় আছি? সরকার আমাদের কী স্বপ্ন দেখাচ্ছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? সরকার কী করে উন্নতি দাবী করছে? আমরা তো দেখছি, উন্নয়নের মহাসড়কে চলা দূরে থাক, উন্নয়নের কানাগলিতে আটকে আছি। ঋণের এই ভয়াবহতার মাঝে উন্নয়নের রাজনীতি কতটা মানায়? দেশের জনগণের মাথার উপর ঋণের বোঝা আগেও ছিল। তবে তা যে দিনে দিনে বেড়ে এত হবে, তা কেউ কল্পনা করেনি। এই সময়ে এসে তা অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছে। যে সরকারকে ঋণ নিয়ে চলতে হয় বা ঋণের উপর নির্ভর করতে হয়, সে সরকার উন্নতি করছেÑতা এখন বলা যুক্তিযুক্ত কিনা এ প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। আবার এ ঋণ পরিশোধ করার জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যেভাব পারা যায় সেভাবে অর্থ আদায় করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে ঋণগ্রস্ত মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো কেন? এর সরল উত্তর, সরকার পরিচালনায় সরকারের দুর্বলতা এবং ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা সৃষ্টি হয়েছে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারের কারণে। ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট এবং তাদের মিত্রদের অনেকের মেগা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া, অর্থনীতিকে স্থবিরতার দিকে নিয়ে গেছে। ক্ষমতা সংশ্লিষ্টদের কমিশন বাণিজ্যের ব্যাপকতাও অর্থনীতির গতি পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে।
চার.
এখন রাজনীতি অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে হলেও রাজনীতি অর্থনীতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আমাদের রাজনীতিতে অর্থনৈতিক উন্নতি গৌণ হয়ে রয়েছে। রাজনীতিবিদদের কথায় অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের উন্নতি কথার কথায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের দৃষ্টি কীভাবে ক্ষমতায় থাকা যায়। বিরোধী দলের দৃষ্টি কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায়। অথচ উভয় দলেরই উচিত দেশের অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করা এবং এ অনুযায়ী জনসাধারণের কথা বলা। দুঃখের বিষয়, রাজনৈতিক দলগুলোকে তা করতে দেখা যায় না। আমরা ইতোমধ্যে বর্তমান সরকারের আমলে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হতে দেখেছি। ব্যাংকে যেভাবে লুটপাট হয়েছে তা আগে কখনো দেখা যায়নি। এসবই সরকারের চোখের সামনে ঘটেছে, অথচ এগুলোর প্রতিকারে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অর্থমন্ত্রী একদিকে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিকে কোনো টাকাই মনে করেন না, অন্যদিকে ব্যাংকে যাদের এক লাখ টাকা আমানত রয়েছ তাদের বলছে সম্পদশালী। দেশের অর্থমন্ত্রী যদি এমন বিপরীতধর্মী কথা বলেন, তবে অর্থনীতি কী অবস্থায় রয়েছে, তা বুঝতে বাকি থাকে না। দুঃখের বিষয়, বর্তমানে সুরাজনীতি বলেও কিছু নেই। যে রাজনীতি মানুষের সুখ-দুঃখের কথা বলবে, অর্থনৈতিক মুক্তি দেবে, সে রাজনীতি হয়ে পড়েছে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ণের অন্যতম হাতিয়ার। এখন রাজনীতি করা মানেই বঞ্চিত ও শোষিতের অর্থে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন। আর উচ্চকণ্ঠে বলা, আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।